পাবনায় অনলাইনে জন্মনিবন্ধনের আবেদন করতে গিয়ে আবেদনকারীদের গলদঘর্ম অবস্থা হচ্ছে। কাগজগত্র ত্রুটিসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের সব জায়গায় বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। পৌরসভা ও ইউনিয়নের পরিসেবাগুলোয় দৈনন্দিন মানুষের ভিড় লেগেই থাকছে। ফলে সময়মতো নাগরিক সুবিধাদি পাচ্ছে না মানুষ।

ভুল সংশোধন এবং নতুন করে জন্মনিবন্ধন সনদ পাওয়ার ক্ষেত্রে কয়েক সপ্তাহ, তারপর মাস পেরোলেও কাঙিক্ষত সময়ে হাতে পাচ্ছে না জন্মনিবন্ধন। ফলে অনেকেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন কাজে দরখাস্ত বা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য গেলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

সূত্র জানায়, আগে মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়েই পরিবারের অন্যদের জন্মনিবন্ধন করা যেত। কিন্তু এ বছরের জানুয়ারি থেকে নতুন নিয়ম হয়। ফলে সন্তানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সঠিক সময়ে জমাদানে বিড়ম্বনায় পড়ছেন মা-বাবারা।

ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার বিভিন্ন অফিসে জন্মসনদ সংগ্রহে আসা কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, সন্তানের জন্মসনদ সংগ্রহের জন্য বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন মা-বাবারা। কেননা সন্তানের জন্মসনদের জন্য আবেদন করলে অফিস থেকে বলা হচ্ছে সন্তানের আগে মা-বাবার ডিজিটাল জন্মসনদের কপি বা নিবন্ধন নম্বর লাগবে। আবার মা-বাবার জন্মসনদের জন্য আবেদন করা হলে তাদের বাবা-মা অর্থাৎ দাদা-দাদি বা নানা-নানির জন্মসনদও চাওয়া হচ্ছে।

তবে এ ক্ষেত্রে দাদা-দাদি বা নানা-নানিকেও মারা গেলে তাদের মৃত্যুসনদও জমা দিতে বলা হচ্ছে। আবার অনেকেই বলছেন, কার্যালয়গুলোতে উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নাগরিকদের স্পষ্ট কোনো নির্দেশনা দিচ্ছেন না। সনদ সংশোধনের ক্ষেত্রেও নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চাহিদামতো কাগজপত্র যাচাই সাপেক্ষে নির্দিষ্ট কয়েক দিন পর জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে থাকেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০১ সালের পরে জন্মগ্রহণকারীদের জন্মনিবন্ধনের জন্য মা-বাবার জন্মসনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা অনেককে সমস্যায় ফেলেছে। আগে জন্মনিবন্ধনের জন্য অভিভাবকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বরই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন নিয়ম হওয়ায় অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন।

কথা হয় পাবনা শহরের পেশায় শিক্ষক হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে। তিনি বলেন, স্কুলে ভর্তির বিষয়ে তার মেয়ের জন্মসনদের জন্য আবেদন করার পর কর্তৃপক্ষ তার জন্মসনদ চায়। যখন আমি আমার জন্মসনদ ও প্রশংসাপত্রের জন্য আবেদন করেছিলাম, তারা আমার মা-বাবার জন্মসনদ ও প্রশংসাপত্রের নম্বর চেয়েছিল। এখন আমার মা-বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। তাদের তো জন্মসনদ বা প্রশংসাপত্র ছিল না।

তিনি আরও বলেন, নতুন নিয়ম অনুসারে ২০০১ সালের পরে জন্মগ্রহণকারী তাদের সন্তানদের জন্মসনদের জন্য অনলাইনে আবেদন করার আগে অভিভাবকদের অবশ্যই তাদের জন্মনিবন্ধন করতে হবে। তবে সেই সময়ের আগে জন্মগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে অনেককে।

আটঘরিয়ায় সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে আসা মনিরুল ইসলাম জানান, তার জন্মসনদ ইংরেজিতে ও তার স্ত্রীর বাংলায় থাকায় তারা আবেদন করতে পারেননি। তিনি বলেন, আমি বুঝতে পারছি না কীভাবে এই নতুন সিস্টেমে যেতে হবে। মা-বাবার সনদ ইংরেজিতে থাকলে সন্তান ইংরেজিতে জন্মসনদ পাবে। মা-বাবার সনদ বাংলায় হলে সন্তানের সনদও বাংলায় হবে। কিন্তু যদি দুটি সনদ ভিন্ন ভাষায় হয়, তাহলে তারা তাদের সন্তানদের জন্মসনদের জন্য আবেদন করতে পারবেন না।

পৌরসভার আরিফপুরের আতাউর রহমান বলেন, তার ও তার স্ত্রীর জন্মসনদ নেই। তারা যখন তাদের সন্তানের স্কুলে ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধনের আবেদন করেছিলেন, তখন বাড়িওয়ালার কাগজপত্র জমা দিতে বলা হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, অনেক ঝামেলার পর আমরা আমাদের বাড়িওয়ালার কাছ থেকে এনআইডি কার্ড এবং পানির বিলের কপি জমা দিয়েছিলাম। তারপর আমাদের নিবন্ধন করা হয়েছে। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানের জন্মনিবন্ধন না করেই ইউনিয়ন পরিষদ অফিস থেকে ফিরে আসছেন। কারণ, তাদের নিজের কাছে সনদ নেই।

সদর উপজেলার সাদুল্লাপুর ইউনিয়নের হানযালা ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, আতাইকুলা ইউনিয়নের মাসুদ রানাসহ বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন, শুধু এ ঝামেলাই নয়, নির্ধারিত ফি আদায়ে সরকারি নির্দেশনা মানছে না ইউনিয়ন পরিষদ ও ইউপি কেন্দ্রের তথ্যসেবা কেন্দ্র। সরকারের নির্ধারিত ফি থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকা দিয়েও সময়মতো জন্মনিবন্ধন পাওয়া যাচ্ছে।

এ বিষয়ে আতাইকুলা ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আইয়ুব আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, জনগণের ভোগান্তি হলেও আমাদের কিছু করার নেই। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগে অভিযোগ করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তিনিও জন্মনিবন্ধন-প্রক্রিয়ার সহজ পদ্ধতি চালুর করার দাবি জানান।

পাবনা পৌরসভার মেয়র শরিফ উদ্দিন প্রধান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সার্ভার সমস্যাসহ বিভিন্ন স্তর পার হওয়ার কারনে জন্মনিবন্ধন সনদ পেতে দেরি হচ্ছে। ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি উল্লেখ করেন যেমন ভুল জন্মনিবন্ধন সংশোধনের ক্ষেত্রে স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছ থেকে প্রত্যয়ন নিয়ে অনলাইনে আবেদন করার পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ক্লিয়ারেন্স (ছাড়পত্র) পেলেই জন্মসনদ পাওয়া যায়।

এগুলো করতে যতটুকু সময় লাগছে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আবার শিশু জন্মগ্রহণের দেড় মাস অর্থাৎ ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করার নির্দেশনা রয়েছে। অথচ অনেকেই এই নির্দেশনা অনুযায়ী এ কাজ করেননি। তাদের কারণে কাজের চাপ পড়ায় ভিড় হচ্ছে বেশি।

পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়ায় যে জটিলতা হচ্ছে, সেটি সার্ভারের কারণে হচ্ছে। এ ছাড়া জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদনকারীদের কাগজপত্রে ত্রুটির কারণে ছাড়পত্র পেতে দেরি হচ্ছে। সার্ভার জটিলতা দূর করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। দ্রুত সমাধান হবে।

এনএ