বানার নদের দুঃখ রঙিন পানি
নদীতে প্রবাহিত পানির রং দেখে যে কেউ আঁতকে উঠতে পারেন। মনে হতে পারে এ যেন রক্তের বন্যা। তবে এ রং বদলে কখনও হয় নীল, কখনও খয়েরি, আবার কখনও ধবধবে সাদা কিংবা কুচকুচে কালো।
বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হলেও এমন দৃশ্যের দেখা মিলবে ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় বয়ে যাওয়া বানার নদে। এই নদটি গিয়ে মিশেছে উপজেলার খিরু নদীতে। আর এই খিরু নদীর প্রবাহ গিয়ে মিশেছে শীতলক্ষ্যায়।
বিজ্ঞাপন
যে জলধারার পানি দিয়ে হতো কৃষিকাজ, খাওয়ানো হতো গবাদিপশুকে, সেই পানি এখন স্থানীয়দের কাছে রীতিমত আতঙ্ক। বিষাক্ত এই রঙিন পানির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। রোগাক্রান্ত হচ্ছে গবাদি পশু-পাখি, হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী।
বিজ্ঞাপন
আক্ষেপের সুরে ত্রিশালের আমিরাবাড়ি ইউনিয়নের নারায়ণপুর গ্রামের কৃষক চান মিয়া বলেন, এই নদের তীরেই আমার জন্ম, বড় হওয়া। আমরা এক সময় এখানে গরু-বাছুরকে গোসল করিয়েছি, নিজেরাও গোসল করেছি। নদের পাশে রবি শস্যসহ নানা রকম ফসলের আবাদ করতাম। কিন্তু পানি নষ্ট হওয়ায় এখন কোনো ফসলই হয় না। ধানের বীজতলা করলেও মরে যায়।
তিনি বলেন, নদটি দিয়ে একেক সময় একের রঙের পানি প্রবাহিত হয়। ক্ষণেক্ষণে পানির রঙ বদলায়। এক সময় যায় টুকটুকে লাল, এরপর আসে একদম কালো পানি। এছাড়া সাদা, নীল রঙের পানি আসে নদটি দিয়ে।
শাহাবুদ্দিন নামে স্থানীয় আরেক কৃষক বলেন, এলাকায় যাগর এইডা দেহার দায়িত্ব হেরা পকেট জাম (পকেট ভারী) কইরা লইয়া বইয়া রইছে। অহন গরু-ছাগল, হাঁস নদীর পাড়ো আইবার পায় না। নদীর মইধ্যে নামলেই ওই হাঁস মইরা যায়। আগে দুই পাশ দিয়া জালা (বীজতলা) ফালতাম, অহন ১৫-২০ দিন বয়স অইলেও হেই জালা মইরা যায়। আমরা অহন কি করমু, কার বুগুলো (কাছে) যামু। টিক মাইরা বইয়া থাহা ছাড়া আঙ্গর ত কিছুই করার নাই।
বানার নদের পানি কেন রঙিন এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে এবার যাত্রা উজানের দিকে। মাইল পাঁচেক যাওয়ার পর সন্ধান পাওয়া গেল একটি খালের। যার নাম চৌহার খাল। দুই দিক থেকে দুই রঙের পানি এসে মিশছে এ খালে। যেখানে দেখা যায়, এক দিক থেকে আসছে সাদা পানি অন্য দিক দিয়ে আসছে নীল পানি। যা মিশে গড়িয়ে পড়ছে বানার নদে।
আশপাশে ঘুরে দেখা যায়, চৌহার খালের ওপর রয়েছে আকিজ সিরামিক কোম্পানির স্থাপনা। তার পশ্চিমে ১০-১৫ একরের বাতাইন্না বিল। বাতাইন্না বিল ও সরদান বিলের পানি নিষ্কাশন হয় কৃষিজমি ঘেঁষা চৌহার খাল দিয়ে। আকিজ সিরামিক ও তার পূর্বপাশের আর কে ব্রিকসের বড় বড় আরসিসি পাইপলাইনে কারখানাগুলো থেকে তরল বর্জ্য এসে মিশছে খালের পানিতে।
এবার খালটি ধরে আরও এগিয়ে গেলে গুজিয়াম-আমিরাবাড়ি সড়কে পাওয়া যায় একটি কালভার্ট। যার নিচে একটি সুরঙ্গ দিয়ে অবিরাম বেরুচ্ছে রঙিন পানি, উঠছে ধোঁয়া। বিষাক্ত সেই পানিই খাল দিয়ে যাচ্ছে নদীতে।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে সুরঙ্গটির মূল অবস্থান। যেটি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ড্রেসডেন টেক্সটাইলস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির। সেখানে গিয়ে কথা হয় কোম্পানির এজিএম নুরে আলম খোকনের সঙ্গে। তার কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি প্রথমে এড়িয়ে যান। পরে তাদের ইটিপি প্লান্ট বা শোধনাগার সচল রয়েছে কি না তা দেখতে চাইলে তিনি বলেন, কোম্পানিটিতে ইটিপি স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি। শিগগিরই এটি চালু করা হবে।
তবে এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, চার-পাঁচদিন পর আপনাদের নিয়ে এসে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখাব। আপাতত এ ব্যাপারে নিউজ কইরেন না।
বিষয়টি ময়মনসিংহ বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের নজরে আনা হলে পরিচালক ফরিদ আহমদ বলেন, শোধনাগার চালু না থাকায় কারখানাটি বন্ধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। আমার জানা মতে, প্রতিষ্ঠানের এসব পানি নিষ্কাশন বন্ধ রয়েছে। তবে যেহেতু তারা আমাদের নিষেধ অমান্য করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাই দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং তাদের বড় ধরনের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
তবে সচেতন মহল বলছেন, পরিবেশ অধিদফতরের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কীভাবে দিনের পর দিন চলছে এমন দূষণ, তার সঠিক জবাব সংশ্লিষ্ট মহলকেই দিতে হবে।
উবায়দুল হক/এসপি