বাড়ির উঠানে বসে কান্না আর আহাজারি করছিলেন তপন হালদারের স্ত্রী সুন্দরী রানী ও ছেলে অজয় হালদার। নিজেদের শেষ সম্বল হারিয়ে এখন নিঃস্ব তারা। দুই সপ্তাহ ধরে চলছে তাদের এই আহাজারি। দীর্ঘ দিনের জমানো টাকা ও ঋণ নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন বাড়িটি। কিন্তু হঠাৎ পাগলা নদীর ভাঙনে ধসে পড়েছে তাদের সদ্য নির্মিত ঢালায় বাড়ি।  

একই অবস্থা তাদের প্রতিবেশী শ্রী সুধীর হালদারের ছেলে রূপচাঁন হালদারের। টাইলস দিয়ে পাকা বাড়ি তৈরির মাস তিনেক হয়েছে মাত্র। বাড়ির কাজ শেষ হলেও আড়াই লাখ টাকা ঋণ রয়েছে এখনও। বাড়ি নির্মাণ করেও সেই বাড়িতে বসবাস করতে পারলেন না রূপচাঁন হালদারের পরিবার। বাড়ির অর্ধেক হঠাৎ করে ধসে গেছে। 

জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে হঠাৎ করে পাগলা নদীর একটি উপশাখার ভাঙনে ধসে পড়েছে প্রায় ৩১টি বসতবাড়ি। বেশকিছু বাড়ির মাঝামাঝি স্থানে দেখা দিয়েছে বিশাল ফাটল। ইতোমধ্যে বিলীন হয়েছে বেশ কিছু পাকা বাড়ি। এতে আকাশ ভেঙে পড়েছে ওই নদীর পাশে বসবাসরত মানুষের। এরপর থেকে ঘুম নেই ওই গ্রামের মানুষদের। সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

বুধবার (১১ নভেম্বর) সকাল থেকে শিবগঞ্জ উপজেলার মোবারকপুর ইউনিয়নের জোহরপুর গ্রামে এ ধস শুরু হয়। প্রথমে ফাটল ধরার পর তলিয়ে যায় পাকা পাকা ঘরবাড়ি। এছাড়া বেশ কিছু বসতবাড়িতে ফটল দেখা দিচ্ছে। 

স্থানীয়রা জানান, ৩০ বছর আগে গ্রামটি গড়ে ওঠে। বর্তমানে দুই শতাধিক পরিবারের বসবাস এখানে। কিন্তু হঠাৎ ১১ নভেম্বর থেকে প্রায় ৩১টি বাড়িতে ফাটল দেখা যায়। বেশ কিছু পাকা ঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কিছু কিছু ছাদের ঘর ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এই গ্রামে সর্বপ্রথম ধসে পড়ে অনিল হালদারের বাড়ি। তার স্ত্রী জয়ন্তী রানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রথমে ফাটল দেখতে পায়। দুই-তিন দিন পর হঠাৎ ধসতে শুরু করে। হঠাৎ বাড়ি ধসে ছেলে ও ভাগনের ওপর ইট পড়ে। 

রূপচাঁন হালদার জানান, গত বুধবার সকালে বাড়ির উঠানে একটি ফাটলের দৃশ্য দেখতে পাই। কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। তার কয়েক দিন পর হঠাৎ সকালে দেখি আমার একটি ছাদের ঘরসহ টয়লেট ভেঙে নদীতে পড়ে গেছে। আমি একজন জেলে। সারা জীবনের জমানো টাকায় এই বাড়ি বানিয়েছিলাম। এখন আমি কোথায় থাকব? এ ঘর ভাঙাতে বুক ফেটে যাচ্ছে। কোথায় থাকব? কী খাব? আমি দিশেহারা হয়ে গেছি। এখনও বাড়ি তৈরির আড়াই লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। 

ভ্যানচালক কুরবান আলী বলেন, কিছুই বুঝতে পারছি না। কী কারণে বাড়ির পেছন দিকে নদীর পাড়ে সব বাড়ি নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ করেই এটি হচ্ছে। এই গ্রামের প্রায় সবাই দিন আনে দিন খাই। বাড়ি ধসের কারণে সবাই এখন নিঃস্ব। এখন আমরা রাস্তায় নেমে গেছি। প্রধানমন্ত্রীর কাছে অন্য কোথাও ঘর নির্মাণ করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি। 

তিনি আরও বলেন, ৪০ বছর ধরে নদীর এমন অবস্থা কোনো দিন দেখিনি। গত দুই বছর স্লুইসগেট খুলে দেওয়ার কারণে পানিশূন্য অবস্থায় রয়েছে নদী। পানি থাকলে এমন ধস দেখতে হতো না। 

সব হারিয়ে নির্বাক তপন হালদারের স্ত্রী সুন্দরী রানী। ঢাকা পোস্টকে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, হঠাৎ বাড়িতে ফাটল দেখার পর আত্মীয় স্বজনদের খবর দেই। ঘর থেকে আসবাবপত্র বের করে নেওয়া সময়টুকুও পায়নি। তার আগেই বাড়ি তলিয়ে গেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, নদীর পাড় বেঁধে দিলে আমরা একটু ভরসা নিয়ে পলিথিনের নিচে হলেও বসবাস করতে পারব। তানাহলে আমাদের কোনো থাকার জায়গা নেই। 

মোবারকপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তৌহিদুর রহমান মিয়া বলেন, বাড়িধসের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। বিষয়টি নিয়ে ভূতত্ত্ববিদরা ভালো বলতে পারবেন। ঘটনার পর সংসদ সদস্য, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। উপজেলা প্রশাসনকে অসহায় পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়াতে অনুরোধ করা হয়েছে। 

মুঠোফোনে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাকিব আল রাব্বি ঢাকা পোস্টকে জানান, খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। তবে কেউ যদি ভূমিহীন থাকে, তাহলে সে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর পাবে। আর যাদের জমি আছে বাড়ি নেই, তারা আপদকালীন সময়ের জন্য উপহারের ঘরে বসবাস করতে পারবেন। এছাড়াও খাবারের প্রয়োজন হলে, সে ব্যবস্থাও করা হবে। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সারোয়ার জাহান সুজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত বুধবার (১৮ নভেম্বর) পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীদের নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। দেখা গেছে, বাড়িগুলো নতুন মাটিতে তৈরি করা হয়েছিল। এছাড়াও বাড়ি নির্মাণের সময় সঠিক নিয়ম মেনে করা হয়নি। বাড়িগুলো নদীর পাড়ের দিকে নামছে না, বরং মাটির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। পাড়ে পানি চলাচলের জন্য ধস হয়নি। বাড়িগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধিগ্রহণ করা জায়গাতে বলেও জানান তিনি। 

জাহাঙ্গীর আলম/এসপি