এদের এক নামে চেনে সবাই— ‘টয়লেট বাড়ির’ লোক

‘এই দুনিয়াতে অনেক মানুষ থাকে। তাদের ঘর আছে। আমাগো নাই। আমাগো একটা ঘর দরকার। এইখানে থাকতে পারি না। ল্যাট্রিনে (গণশৌচাগার) খুব কষ্ট হয়।’ কথাগুলো বলছিল লামচর ক্ষুদ্রকা‌ঠি সরকা‌রি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী মিম। 

জানা যায়, মিমের বয়স ১০ বছর। এর বাইরে পরিচয় দেওয়ার মতো আসলে কিছু নেই। পুরো উপজেলায় এক নামে চেনে ‍‘টয়লেট বাড়ির’ লোক। মিমের বাবা সুমন খা মানসিক ভারসাম্যহীন। ফলে মা সাথী বেগমই তাদের মুখে দু-বেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার সহায়।

তাদের থাকার নিজেদের কােনো ঘরও নেই। যখন একটু বুঝতে শিখেছে তখনই দেখেছে তারা পাবলিক টয়লটের সেপটিক ট্যাংকের ওপরে থাকে। মিমের পরে আরও দুইভাই আছে। ৮ বছরের সাগর ও ৬ বছরের ইমন। ওদের ভূমিষ্ঠ হতে দেখেছে সেই সেপটিক ট্যাংকের ঘরে। মিমের বড় আরও দুই ভাই আছে। ১৪ বছরের শাওন এবং ১২ বছরের শান্ত। তারা লেখাপড়া করে না। অন্যের কাজ করে যা পায় তা এবং মায়ের রোজগার দিয়ে দুইবেলা খেয়ে জীবন চলছে।

বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার বন্দর বাজারে এই পরিবারের বসবাস। এক বা দুই দিন নয়, দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর ধরে বন্দর বাজারের পাবলিক টয়লেটের সেপটিক ট্যাংকের ওপরে বসবাস করছেন মিমের পরিবার। মিম বলে, স্কুলে তার সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না। বলে ‘দূরে যা তোর গা (শরীর) দিয়া গন্ধ আসে।’ তবুও মিম স্কুলে যায়। এখন তার অনুরোধ একটি ঘর।

কথা হয় মিমের মা সাথী বেগমের সঙ্গে। তিনি বললেন জীবনের গল্পটা। মূলত তিনি বরিশাল জেলার বাসিন্দা নন। মাদারীপুর উপজেলার করিম তালুকদারের মেয়ে। আঠারো বছর আগে তার বয়স যখন ৭ বছর তখন বাবা করিম তালুকদার দ্বিতীয় বিয়ে করেন। ফলে গর্ভধারিনী মা ওদের ছেড়ে চলে যান। বিপরীতে সৎমা প্রচণ্ড রকমের জ্বালাতন করতো। শেষে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন।

সুমন খান— সাথী বেগমের মানসিক ভারসাম্যহীন স্বামী

সাথী বেগম বলেন, অনেক কষ্ট করে ১৮ বছর আগে বরিশালে আসেন। সেখানে ছিন্নমূল শিশু হিসেবে কয়েকদিন থাকার পর রোজগার করতে পারছিলেন না। এরপর বরিশাল ছাড়েন। ফিরতি বাসে এসে নামেন বরিশাল শহরের উপকণ্ঠ বাবুগঞ্জ উপজেলায়। এখানের বন্দরবাজারে দোকানে দোকানে পানি টেনে জীবনকে থিতু করেন।

২ বছর পর স্থানীয়রা উদ্যোগ নিয়ে ওই এলাকায় থাকা বাগেরহাট জেলার বাসিন্দা সুমন খানের সঙ্গে তাকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ করে দেন। সুমন পেশায় সুইপার। তখনও কোথাও থাকার জন্য ঘর ছিল না। সর্বশেষ ছেলে ইমন ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যখন বয়স তিনদিন তখন মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরেন সুমন খান। তার ওপরে অন্যের সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে গিয়ে ডান পায়ে পচন ধরে। একপর্যায়ে পায়ের কিছু অংশ কেটে ফেলতে হয়। কয়েক বছর নিরুদ্দেশ থাকার পর ভারসাম্যহীনভাবেই ফিরে আসে বাবুগঞ্জের বন্দরবাজারে।

সাথী বেগম বলেন, এই জীবনে সরকারি কোনো সাহায্য আমরা পাইনি। মাঝখানে করোনায় সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেলে স্থানীয় সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে কিছু খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন। এমনকি শীত পোশাক বা রাতে গায়ে দেওয়ার কম্বলও তাদের নেই। ফলে ঘরের সামনে আগুন জ্বালিয়ে রাতে শীত নিবারণ করেন।

সেই টয়লেট বাড়িতেই চলে মিম ও সাগরের লেখাপড়া। সাগর এ বছর দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। ওদিকে ইমন স্কুলে যাবে না। সে মাদ্রাসায় লেখাপড়া করবে বলে মাকে বলেছে।

সাথী বলেন, আমার জীবনের ইচ্ছা ছেলেমেয়ে কয়টাকে লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে চাই। ‘স্বপ্ন দেখেছি মুজিববর্ষে একটা ঘর পাবো। কিন্তু কেউতো দিলো না।’

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে বাবুগঞ্জে ১৭০টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মধ্যে প্রথম ধাপে ১১০টি পরিবারের মাঝে ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে সেই তালিকায় নাম নেই সুমন-সাথী দম্পতির। বিষয়টির দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় উপেজলা নির্বাহী অফিসার আমিনুল ইসলামের। সংবাদ পেয়ে তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

ইউএনও আমিনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই দম্পতির জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তাছাড়া তারা বাবুগঞ্জের স্থায়ী বাসিন্দাও নন। যে কারণে তালিকায় নাম আসেনি। আশ্রয়ণ প্রকল্পে যেন ঘর পেতে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করব। সরকার এই পরিবারের জন্য সর্বাত্মক সহায়তা করবে।

এমএসআর