অনশন বাস্তবায়ন করেন তাজরীনেরই শ্রমিক জরিনাসহ কয়েকজন

পোশাক শিল্পের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিভীষিকাময় অধ্যায় তাজরীন ট্র্যাজেডি। সেই আগুনের লেলিহান শিখায় এখনও জ্বলছে শত শত আহত শ্রমিক। অসুস্থতা আর দৈন্যদশায় কাতর শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণের আশা নিয়ে এখনও সেই ভবনের আশেপাশেই ভাড়া থাকেন।

ক্ষতিপূরণের আশ্বাস পেলেই অনশনে বসতেও দ্বিধা নেই তাদের। নামধারী শ্রমিক নেতার উসকানির শিকার শ্রমিকরা প্রতারিতও হচ্ছেন বার বার। তাই তো অনশনের ৩০০ টাকার ব্যানারের মূল্য ২৪ হাজার টাকা। অগ্নিকাণ্ডে আহতের অনেকেই হারিয়েছেন কর্মক্ষমতা।

তাই বেঁচে থাকার তাগিদে ক্ষতিপূরণের আশা ছাড়েননি কেউ। এই দুর্বলতাকে পুঁজি করে বিভিন্ন শ্রমিক নেতার পরিচয়ে অনেকেই করছেন জমজমাট ব্যবসা। কর্মসূচির ডাক দিয়ে বাস্তবায়নের জন্য শ্রমিকদেরই পকেট কাটছেন তারা। চাঁদার নামে হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৯ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনসের কার্যক্রম শুরু হয়। কারখানায় প্রায় ১ হাজার ৬৩০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। ৩ বছরের মাথায় কারখানায় আগুন লেগে পুড়ে যায়। প্রাণ যায় ১১৪ জন শ্রমিকের। আহত হন ২ শতাধিক শ্রমিক। আর এই আহতরাই শ্রমিক নেতারুপি অনেকের কাছে প্রতারিত হচ্ছেন নানাভাবে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্প্রতি তাজরীন ফ্যাশনের প্রায় ৪৮ জন শ্রমিক উসকানি পেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ক্ষতিপূরণের দাবিতে ৪ মাস ধরে  অনশন করেন। তবে এসব শ্রমিক নিজের ইচ্ছায় এরকম সিদ্ধান্ত নেননি। শ্রমিকদের মধ্যে অনেকে নেতা সেজে উসকানি আর ক্ষতিপূরণ নিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা অনশনে নামেন।

অনশনকারী এক শ্রমিক হলেন নাটা বেগম

এই অনশনের প্রধান আয়োজন ও বাস্তবায়ন করেন তাজরীনেরই শ্রমিক জরিনা ও সোলাইমান। তারা দুজনই ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জলি তালুকদারের নাম ভাঙিয়ে শ্রমিকদের উসকানি দিয়েছেন। তাদের দুইজনের কথামতো অনশনের একটি ব্যানার তৈরির জন্য ৪৮ জন শ্রমিককে জনপ্রতি ৫০০ করে দিতে হয়েছে মোট ২৪ হাজার টাকা।

এই ৫০০ করে টাকা দিয়েছেন তাজরীনের আহত শ্রমিক রত্না, মুক্তা বানু, মোনিন, রূপা, রাজবানু, ভানুরানী, রেহেনা, নাসিমা, আলে, মোকাদ্দেস, আনিস, মনোয়ারা, সালমা, সায়মা, চায়না, কালু, আসাদ, রাশেদা, রোকসানা, বিলকিছ, বেল্লাল, সুমী, নাজমাসহ ৪৮ জন শ্রমিক।

এছাড়া অনুদান, ক্ষতিপূরণের চেক পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে ৪৮ জনের কাছ থেকে নিয়েছেন ৬ হাজার টাকা করে মোট ২ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। আর দীর্ঘদিনের ক্ষতিপূরণের অবসানের আশায় শত কষ্ট হলেও এই টাকা সংগ্রহ করে তুলে দেন নামধারী এসব নেতার হাতে।

জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশন করেন আহত শ্রমিকরা আর নামিদামি হোটেল-মার্কেটে খাবার ও কেনাকাটা করেন নেতারা। অনশনকারী একজন শ্রমিক হলেন নাটা বেগম। তিনি তাজরীন ফ্যাশনে বুয়ার কাজ করতেন।

আহত শ্রমিক খালেদা

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের তারা কৌশলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অনশনে বসিয়ে সন্ধ্যা হলেই তারা দামি হোটেলে খেতে যান। একটানা ৪ মাস কষ্ট করেছি আমরা আহত ৪৮ জন শ্রমিক। এত কষ্টের পরেও লোকসান হয়েছে। ঋণ করে তাদের টাকা দিয়ে আমরা এখন বিপাকে। আর কাউকেই বিশ্বাস করতে পারি না। শ্রমিক নেত্রী জলির কথা বলে আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয় জরিনা ও সোলাইমান।

অপর শ্রমিক খালেদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাছে একটি ব্যানার বানানোর কথা বলে ৫০০ করে টাকা নিয়েছে। মোট ২৪ হাজার টাকা প্রথম দিনই তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। তাদের কথামতো অনশনে বসলাম। কিন্তু তারাই আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করলেন। আমরা অসহায় আল্লাহর কাছে বিচার দেওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করার নাই। আমাদের নিয়ে সব নেতাই ব্যবসা করেছেন। 

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হয় জরিনার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা এ ধরনের কোনো কাজ করিনি। সব শ্রমিকসহ আলোচনা হয়েছিল যে, টাকা পেলে আমরা সবাই চলে যাব। আমরা অনেক কষ্ট করেছি। তাই শ্রমিকরাই খুশি হয়ে আমাদের টাকা দিয়েছেন সামর্থ্য অনুযায়ী। তবে নেতাদের পার্টি অফিসে কিছু টাকা খরচ বাদে অনেকের টাকাই পরবর্তীতে ফেরত দেওয়া হয়। যার হিসাব সোলাইমানের কাছে আছে।

সোলাইমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি খোঁজ নিয়ে তার বাসা পর্যন্ত গেলেও তার দেখা মেলেনি।

জলি তালুকদার বলেন, এ ঘটনা ঘটার কিছু দিন পরেই আমরা জানতে পেরে সোলাইমান ও জরিনাকে চাপ দিয়ে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করেছিলাম। অনেককেই তারা টাকা ফিরিয়েও দিয়েছে। তবে অনুদানের ব্যাপারে কিছু জানা নেই।

বাংলাদেশ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সারোয়ার হোসেন বলেন, কিছু কথিত শ্রমিক নেতা অসহায় শ্রমিকদের টার্গেট করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। শ্রমিকরা লোভে পরে তাদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তাজরীন ও রানা প্লাজার আহত শ্রমিকদের প্রতি আমার অনুরোধ কারো প্রতারণার শিকার হবেন না।

এমএসআর