পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলা তিন যুগের বেশি সময় ধরে দেশের বিভিন্ন স্থানের ক্রিকেটপ্রেমীদের খেলার চাহিদা পূরণ করে আসছে। নেছারাবাদের তৈরি ব্যাট মানসম্মত ও কিছুটা সস্তা হওয়ায় দেশজুড়ে রয়েছে এর ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু কারখানার সংখ্যা আর জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে এ শিল্প।

অজপাড়াগাঁয়ের মাটির রাস্তা ধরেই যেতে হয় উপজেলার বিন্না গ্রামে। যেখানে বিভিন্ন স্থানে স্বল্প পরিসরে গড়ে ওঠা অনেক কারখানায় চলে ক্রিকেট ব্যাট তৈরির কার্যক্রম। আমড়া, কদম, ডুমুর আর ছাতিম গাছ থেকে উৎপাদিত ব্যাট রাস্তার পাশে স্তূপ করে রোদে শুকানো হয় ব্যাটের প্রাথমিক কাঠামো।

জানা যায়, নেছারাবাদ উপজেলা সদরের পশ্চিমে বেলুয়া নদীর পূর্বপাড়ে বিন্না গ্রামের অবস্থান। ১৯৮৮ সালে আব্দুল লতিফ বিন্না গ্রামে নিজেই শুরু করেন এই ব্যাট তৈরির কার্যক্রম। এই গ্রামে পিরোজপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যাট বানানোর জন্য আমড়া, কদম, ডুমুর আর ছাতিম গাছ কিনে আনা হয়। ৭টি স্তরের প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় ব্যাট। গাছ করাতকলে নিয়ে প্রথমে মূল অংশ তৈরি করে তাতে লাগানো হয় হাতল। এরপর ফিনিশিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হয় ব্যাটের কাঠামো।

প্রথমে বিন্না গ্রামে ব্যাট তৈরির কার্যক্রম শুরু হলেও বর্তমানে কাঁচামালের সুলভ মূল্য থাকায় আশপাশের চামি, ডুবি, আদর্শ, বয়া, পঞ্চবেকী ও আউরবুনিয়া গ্রামেও বর্তমানে চলে এই কার্যক্রম। এসব কারখানায় কাজ করেন বিভিন্ন এলাকার শ্রমিক ও সহযোগিতা করেন বাড়ির নারী সদস্যরাও। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে ব্যাট কিনে নেন প্রয়োজনমতো।

ব্যাট কারখানার শ্রমিক সোহেল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমড়া, কদম, ডুমুর আর ছাতিমগাছসহ আরও কয়েকটি গাছের সমন্বয়ে ব্যাট তৈরি করা হয়। ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজিতে গাছ কিনতে হয়। কারখানায় ব্যাট তৈরি সম্পন্ন হওয়ার পর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আমরা পাইকারি ও খুচরায় বিক্রি করি।

শ্রমিক মো. শাওন হাওলাদার বলেন, দুই-তিন বছর হলো এই ব্যাট বানানোর কারখানায় কাজ করছি। ২০ থেকে ২৫ দিন লাগে একটি ব্যাট তৈরি হতে। গাছ কেটে রোদে শুকিয়ে করাতকলে এনে মাপমতো কেটে একটি ব্যাট তৈরি করতে চার-পাঁচজন শ্রমিক লাগে।

স্টিকার শিল্পী মো. আহাদুল ইসলাম বলেন, ব্যাটের স্টিকার ঢাকা থেকে কিনে আনতে হয়। দামি ব্যাটের স্টিকার কিনতে সেটসহ প্রতি ব্যাটে ১৫ টাকা খরচ হয়। অল্প দামি ব্যাটের স্টিকার সেটসহ ৩ থেকে ৫ টাকায় কিনতে হয়। এখান থেকে ব্যাট তৈরি ও স্টিকার লাগানোর পরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সেগুলো পাইকারি দামে বিক্রি হয়।

কারখানার মালিক আব্দুল লতিফ ঢাকা পোস্টকে জানান, আশপাশের কিছু জেলা থেকে ব্যাট বানানোর কাজ শিখে গ্রামে এসে নিজের উদ্যোগে ব্যাট তৈরি শুরু করি। পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রামে এখন ব্যাট তৈরি চলছে। কাঁচামালের যে দাম, তাতে ব্যাট তৈরি করে বিক্রির পর তেমন কিছুই থাকে না।

শাওন স্পোর্টের কারখানার মালিক মো. সান্টু মিয়া বলেন, প্রায় ১২ বছর ধরে এই ব্যাট তৈরির কাজ করি। বছরে ২৮ থেকে ৩০ হাজার ব্যাট তৈরি করি। সব উপকরণের দাম বাড়লেও ব্যাটের দাম কম। এতে আমরা লাভের মুখ দেখি না। এদিকে ভারতীয় ব্যাট আসে দেশে। যে কারণে দেশের ব্যাট তেমন একটা চলে না। করোনায় আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর অনেকে ছবি তুলে নিয়ে গেছে সহযোগিতা করবে বলে। কিন্তু আমরা কিছুই পাইনি। সরকারিভাবে সহজ কিস্তিতে কিছু ঋণসহায়তা পেলে আমরা আরও ভালো থাকতে পারতাম।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) জেলা উপব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) মিলটন চন্দ্র বৈরাগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিরোজপুরের নেছারাবাদে বিন্না, ইন্দেরহাট, ঝিলবাড়ি, চামি, ডুবি, কুড়িবুনিয়া, পঞ্চবুটি, বলদিয়াসহ ১৫টি গ্রামের ৫০টি কারখানায় ২ হাজার ৫০০ জন ব্যাট শিল্পী কাজ করেন। যাদের হাত ধরেই দেশের ৭০ ভাগ ব্যাটের চাহিদা পূরণ হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উপজেলা তাদের জন্য বিসিকে রয়েছে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি। বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের মাধ্যমে তৈরি ব্যাট পিরোজপুরসহ দেশের চাহিদা পূরণ করবে। করোনায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত। শিল্পীরা আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় সল্প ও সহজ শর্তে ঋণ পেতে পারেন। বিসমিল্লাহ কুটিরশিল্পকে আমরা ইতিমধ্যে সহজ শর্তে পাঁচ লাখ টাকা অনুদান প্রদান করেছি।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারেফ হোসেন জানান, নেছারাদের বিন্না গ্রামের ব্যাটশিল্প রক্ষার্থে সরকারি যেকোনো সহযোগিতার প্রয়োজনে আমরা শিল্পীদের পাশে আছি। তাদের এই ব্যবসার প্রচার ও প্রসারের স্বার্থে তাদের পাশের থেকে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে। তাদের সমস্যা নিয়ে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলছি। এই সংশ্লিষ্ট কোনো প্রণোদনা পেলে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাদের পৌঁছে দেওয়া হবে।

এনএ