যশোরের শার্শা উপজেলার বাগআঁচড়া ইউনিয়নে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। রোববার (২৮ নভেম্বর) রাতে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিজয় মিছিল থেকে এ হামলা চালানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এই ইউনিয়নে নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুলকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আনারস প্রতীকের আব্দুল খালেক। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, নৌকায় ভোট দেওয়ায় তাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন তার কর্মী-সমর্থকরা।

স্থানীয়রা অভিযোগ করেন, ভোট গণনা শেষে রোববার রাতে ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড ২ নম্বর কলোনিতে আনারস প্রতীকের বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে ফেরার পথে নৌকার সমর্থকদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই পাড়াতেই অন্তত ১০টি বাড়ি ও দোকানপাট, মিনিবাস, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়েছে। এ সময় বাধা দিতে গিয়ে আহত হয়েছে অন্তত ১০ জন। এলাকার পুরুষরা ভয়ে পালিয়ে গেছেন। আতঙ্কে আছে এলাকার নারী ও শিশুরা।

বাগআঁচড়া ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড ২ নম্বর কলোনিতে ভাঙা ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে তাসলিমা বেগম বলেন, ঘর ভাঙচুর করে কোলের দেড় মাসের বাচ্চার দিকে হাত বাড়িয়ে হামলাকারীরা বলে, ‘নৌকায় ভোট দিস! বাচ্চা দে, আছাড় মেরে দিই, তাইলে তোর স্বামীর খোঁজ পাওয়া যাবে!’ পরে তাদের হাত-পা ধরে নিজে ও সন্তানের প্রাণ বাঁচিয়েছি। সকালে স্বামীকে (জামাল হোসেন) খুঁজতে আবার আসবে বলে হুমকি দিয়ে গেছে।

ট্রলিচালক মিঠুন হোসেনের স্ত্রী জেসমিন খাতুন বললেন, তাদের বাড়ি ও দোকান ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। তার ছেলেকে জবাই করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে গেছে। ভয়ে স্বামী বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। ২০০১ সালে নৌকায় ভোট দেওয়ায় তারা এমন হামলার শিকার হয়েছিলেন। সেই দিন কি আবার ফিরে এসেছে; এ প্রশ্ন জেসমিনের।

এলাকার বৃদ্ধ গণি পাঠান জানান, তার ছেলে সুখচান নৌকায় ভোট দেওয়ায় তার বাড়ির সামনে বোমা মেরেছে। কুপিয়ে পিটিয়ে ভাঙচুর করেছে টিনের ঘর। ধারদেনা করে ঘরটি তৈরি করেছেন; এখনো দেনাও শোধ হয়নি।

নাসির উদ্দিনের স্ত্রী নুরনাহার অভিযোগ করেন, আব্দুল খালেকের লোকজন সন্ত্রাসীদের ভাড়া করে নিয়ে এসে হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীদের সাথে দুজন পুলিশও ছিল। কিন্তু তারা কোনো ভূমিকা রাখেনি বলেও তিনি অভিযোগ করেন।

বৃদ্ধা ফাতেমা বেগম হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তার উঠানে ভাঙা পড়ে আছে মিনিবাস। বিদেশ থেকে মেয়ের পাঠানো টাকায় গাড়িটি কেনা। সেটি ভাঙার পর তার বাড়ির দরজা-জানালা ভেঙে তছনছ করেছে। ঘরে শুয়ে থাকায় ভাঙা কাচে তার কপালও কেটে গেছে।

শুধু ২ নং কলোনিতেই নয়; হামলার ঘটনা ঘটেছে ২ নং ওয়ার্ডে, পিপড়াগাছি গ্রামে, মহিষাকুড়া এলাকায়। সব মিলিয়ে অন্তত শতাধিক ঘরবাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মহিষাকুড়া বাজারে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা ভাঙচুর চালিয়ে নৌকার প্রতিকৃতি খুলে এনে আনারসের কার্যালয়ের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।

বাগআঁচড়া ইউনিয়নে পরাজিত নৌকার প্রার্থী ইলিয়াস কবির বকুল অভিযোগ করেন, প্রশাসনের সহযোগিতায় নির্বাচনে তাকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াতের লোকজন এনে আনারসকে বিজয়ী করা হয়েছে। ফলাফল ঘোষণার পর তার কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি ঘরে হামলা ভাঙচুর তাণ্ডব চালানো হয়েছে। ভয়ে কর্মী-সমর্থকরা বাড়ি থাকতে পারছেন না।

তবে হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল খালেক। তার দাবি, প্রত্যেক ওয়ার্ডে ৭-৮ জন মেম্বার প্রার্থী ছিলেন। তাদের সমর্থকরাই বিরোধ, সংঘর্ষ ও ভাঙচুরে জড়িয়ে পড়েছেন। তিনি এলাকায় পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হলে তিনি কোনো দায় নেবেন না। অপরাধীদের আইনের হাতে সোপর্দ করা হবে।

তিনি আরও দাবি করেন, তিনি নিজেই হামলার শিকার হয়েছেন। তার কর্মী-সমর্থকরাও আহত হয়েছেন। এদিকে রোববার রাতের ওই হামলার পর সোমবার এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

যশোর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (নাভারণ সার্কেল) জুয়েল ইমরান সাংবাদিকদের বলেন, যেসব এলাকা থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেখানে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ গ্রহণসহ পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

জাহিদ হাসান/এনএ