বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক। দীর্ঘদিন ছিলেন গাজীপুর পৌরসভার মেয়র। ২০০৮ সাল থেকে একাধারে গাজীপুর-১ আসন (কালিয়াকৈর-সিটির আংশিক) সংসদ সদস্য তিনি। এখন দায়িত্ব পালন করছেন বর্তমান সরকারের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি তিনি। এলাকায় সজ্জন হিসেবে পরিচিতি রয়েছে তার।

কিন্তু মন্ত্রীর আসনে বিগত কালিয়াকৈর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী পরাজিত হন। অভিযোগ ছিল, মন্ত্রী নিজেই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে সংসদ সদস্য থাকলেও কালিয়াকৈর পৌরসভা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি।

সদ্য শেষ হওয়া চতুর্থ দফা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে পৌরসভাসহ উপজেলাজুড়েই ভরাডুবি হয়েছে নৌকার। যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে না পারা, দলীয় কোন্দলে বিভক্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মাত্র একটি ইউপিতে জয়ী হয়েছেন। কালিয়াকৈর পৌরসভাসহ বাকি ৬টি ইউনিয়নে জয়লাভ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। মন্ত্রীর আসনে নৌকার এভাবে ভরাডুবি স্থানীয়দের মধ্যে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছে। 

উপজেলা আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাকর্মী ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০৮ সালের পূর্বে কালিয়াকৈর-শ্রীপুর নিয়ে ছিল গাজীপুর-১ আসন। সে সময় প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এডভোকেট রহমত আলীর নেতৃত্বে সুসংগঠিত ছিল আওয়ামী লীগ। আসন বিন্যাসের ফলে কালিয়াকৈর সংযুক্ত হয় মহানগরীর সাথে। আওয়ামী লীগের দায়িত্ব পান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক। এরপর থেকেই মূলত বিভেদ ও দলীয় কোন্দল বাড়তে থাকে।

বিগত উপজেলা নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম রাসেল পরাজিত হওয়ার পর থেকেই বাড়তে থাকে দলীয় বিরোধ। দীর্ঘদিনেও আর তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি আওয়ামী লীগ। সদ্য সমাপ্ত পৌরসভা নির্বাচন ও উপজেলা নির্বাচনের পরাজিত প্রার্থী বর্তমান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাসেল দলীয় মনোনয়ন পান। পরে নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মজিবুর রহমানের কাছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। 

কালিয়াকৈর পৌরসভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি সদস্য, কালিয়াকৈর পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র মো. মজিবুর রহমান মোবাইল ফোন প্রতীকে ২৩ হাজার ৬২৩টি ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকে মো. রেজাউল করিম রাসেল পান ১৭ হাজার ১৭১টি ভোট।

এ ছাড়া ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ প্রার্থী শাহ্ আলম ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নে জয়লাভ করেন। বাকি বোয়ালী ইউনিয়নে মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে আফজাল হোসেন খান, আটবহ ইউনিয়নে অটোরিক্সা প্রতীকের শাখাওয়াত হোসেন শাকিল মোল্লা, মধ্যপাড়া ইউনিয়নে ঘোড়া প্রতীকে সিরাজুল ইসলাম, ঢালজোড়া ইউনিয়নে মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে ইমাম উদ্দিন, সূত্রাপুর ইউনিয়নে আনারস প্রতীক নিয়ে সোলাইমান মিন্টু, চাপাইর ইউনিয়নে মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে সাইফুজ্জামান সেতু জয়লাভ করেন।

কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুরাদ কবির বলেন, দেশের বেশ কিছু স্থানের মতো গাজীপুরে আওয়ামী লীগের অবস্থান খুবই সুসংগঠিত। এখানে দলীয় প্রতীক দেওয়ায় তৃণমূলে দল বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। গাজীপুর আওয়ামী লীগের ঘাঁটি, এখন অনেকেই মনোনয়ন চান, নির্বাচন করতে চান। মনোনয়ন না পেলেই তারা ‘বিদ্রোহী’ হয়ে ওঠেন। এখানে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে নৌকার সাথে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের।

তিনি বলেন, কয়েক স্থানের মতো এখানেও দলীয় প্রতীক প্রত্যাহারের প্রয়োজন ছিল। ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের আমরা বহিষ্কার করেছি। তারা এতেও নিবৃত্ত হননি। এ ছাড়া বিদ্রোহী প্রার্থীদের জয়ের পেছনে স্থানীয় বিএনপিরও ইন্ধন দেওয়ার ঘটনা রয়েছে পৌর নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল ছিল বলে অভিমত তার। তবে তৃণমূলে শৃঙ্খলা আনা এখন খুবই জরুরি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ক ম মোজাম্মেল হক যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করায় তার বক্তব্য নেওয়া যায়নি।

এদিকে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা কাজী ইস্তাফিজুল হক আকন্দ জানান, কালিয়াকৈর পৌরসভার নির্বাচনে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র মো. মজিবুর রহমান। তার নির্বাচনী প্রতীক ছিল মোবাইল ফোন, তিনি ২৩ হাজার ৬২৩টি ভোট পেয়ে জয়লাভ করেছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকা প্রতীকে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল করিম রাসেল পান ১৭ হাজার ১৭১টি ভোট।

কালিয়াকৈরের মধ্যপাড়া ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সিরাজুল ইসলাম ৯ হাজার ৫০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। আটাবহ ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সাখাওয়াৎ হোসেন ৫হাজার ৭২১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। চাপাইর ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. সাইফুজ্জামান সেতু ১১ হাজার ১৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। সূত্রাপুর ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী সোলায়মান মিন্টু ১১ হাজার ৭৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। ফুলবাড়িয়া ইউপিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. শাহ আলম সরকার ১৫ হাজার ৯০৯ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। ঢালজোড়া ইউপিতে মো. ইছাম উদ্দিন ৬ হাজার ৮৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। বোয়ালী ইউপিতে মো. আফজাল হোসেন খান ৬ হাজার ৩৮০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন।

শিহাব খান/এনএ