আজ ১ ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবস। অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে এইচআইভি এইডসে আক্রান্তের হার কম হলেও কিছু কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমেই তা বেড়ে চলছে। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ যৌনপল্লি হিসিবে পরিচিত রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া যৌনপল্লির যৌনকর্মী ও খদ্দেরসহ যৌনপল্লি সংশ্লিষ্টরা।

যৌনপল্লি সংশ্লিষ্ট বেসরকারি একটি সংগঠনের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, যৌনপল্লিতে তালিকাভুক্ত যৌনকর্মীর সংখ্যা ১৫২৬ জন। এ ছাড়া যৌনকর্মীদের সর্দারের সংখ্যা ৫৬২, বাড়িওয়ালি ২৮১ এবং তাদের শিশুর সংখ্যা ৬৫৩ জন। এর বাইরেও বয়স্ক নারী ও নানাবিধ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মিলে আরও প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস এ পল্লীতে। অর্থাৎ যৌনপল্লির প্রায় ৫ হাজার বাসিন্দা প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এইচআইভি এইডসসহ নানাবিধ যৌনরোগের চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।

দৌলতদিয়ায় ‘মুক্তি মহিলা সমিতি’ নামে পতিতাদের একটি রেজিস্টার্ড সংগঠন রয়েছে। এই সংগঠনের রিপোর্ট অনুযায়ী বর্তমানে এই পতিতালয়ে পতিতার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। এখানে প্রায় তিনশ থেকে সাড়ে তিনশ সর্দারনী রয়েছে। এসব সর্দারনীর অধীনে সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ জন করে পতিতা কাজ করেন। সর্দারনী বা বাড়িওয়ালির প্রতিদিনের সর্বনিন্ম আয় ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা। ‍এ ছাড়াও অবস্থাশালী বাড়িওয়ালিদের আয় দিনে আনুমানিক ২ থেকে ৩ লক্ষ টাকা।

জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন কয়েক হাজার পুরুষ এ পল্লিতে যাতায়াত করে। এর মধ্যে স্কুল ছাত্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকার ট্রাকচালকরাও রয়েছে। যার বেশিরভাগ লোকজন দৈহিক মিলনে কনডম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনাগ্রহী। খদ্দেরের ইচ্ছা ও বেশি টাকার লোভে বেশিরভাগ মেয়েই প্রতিনিয়ত অনিরাপদ মিলন করে থাকে। এ ছাড়া পল্লীর বহু মেয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাদকাসক্ত। তাদের আয়-রোজগার কম। নেশার টাকা যোগানো, খাবার ও ঘর ভাড়ার টাকা যোগাতে এ সকল মেয়েরা দৈহিক মিলনে নিজেদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করার সুযোগ পায় না।

এ ছাড়া কিছু মেয়ে বাড়িওয়ালিদের কাছে জিম্মি। যার ফলে দৈহিক মিলনে এদেরও নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভাবার সুযোগ নেই। করোনার কারণে পল্লিতে খদ্দের আসা কমে যাওয়ায় যৌনকর্মীরা যেকোনো উপায়ে খদ্দের টানতে মরিয়া থাকে। অর্থাৎ সেখানে অবাধ যৌনতার কারণে দৌলতদিয়া যৌনপল্লিতে এইচআইভি এইডস আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

গত প্রায় ১০-১১ বছর আগে এ পল্লিতে এইডস রোগী সনাক্তের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবি যৌনকর্মীদের রক্তের নমুনা নিয়েছিল। যদিও তার ফলাফল জানা জায়নি। এর মাঝে দীর্ঘকাল এ পল্লিতে এইডস নিয়ে কোনো কাজ ছিল না। তবে কিছুদিন থেকে বেসরকারি সংগঠন পায়াক্ট বাংলাদেশ এইচআইভি এইডস ও যৌনরোগ নিয়ে এ পল্লীতে কাজ শুরু করেছে। এর ফলে কিছু যৌনকর্মী সচেতন হলেও করোনা, অভাব, মাদকাসক্তিসহ বাড়িওয়ালিদের কাছে জিম্মি থাকায় সেই সচেতনতা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে না।

পায়াক্ট বাংলাদেশ দৌলতদিয়া ঘাট শাখার ব্যবস্থাপক মজিবর রহমান জুয়েল ঢাকা পোস্টকে জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে তারা এখানে এইচআইভি এইডস বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে নানাধরনের কর্মসূচি পালন করছেন। পাশাপাশি তারা দুইজন অভিজ্ঞ মেডিকেল এসিস্টেন্টের (কাউন্সিলর) মাধ্যমে নানাবিধ যৌনরোগ সনাক্ত এবং বিনামুল্যে ওষুধ ও চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। কর্মসুচির অংশ হিসেবে তারা প্রতি মাসে যৌনকর্মীদের মাঝে প্রায় দেড় থেকে পৌণে ২ লাখ কনডম বিনামূল্যে বিতরণ করছেন। সচেতনতা বাড়াতে পল্লিতে তাদের নারী কর্মীরা প্রতিদিন উঠান বৈঠক, আলোচনাসভা, পোস্টার ও লিফলেট বিতরণ করছেন। তবে যৌনকর্মীদের নানাবিধ ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে কর্মসুচিগুলোর সুফল পেতে বেগ পেতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আসিফ মাহমুদ বলেন, দৌলতদিয়া যৌনপল্লির সব যৌনকর্মী ও খদ্দের মারাত্মক এইডস ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ জন্যে এইডস ও অন্যান্য যৌন রোগের ঝুঁকি কমাতে বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগ এ পল্লিতে নানাবিধ কাজ করছে। তাদের কাজের নিয়মিত মনিটরিং ছাড়াও জটিল এবং সন্দেহজনক রোগীদের ক্ষেত্রে তারা চিকিৎসা ও পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সবার মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়াতে আজ পহেলা ডিসেম্বর বিশ্ব এইডস দিবসে গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ ও পায়াক্ট বাংলাদেশ দৌলতদিয়া ঘাট শাখার পক্ষ থেকে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, শিশুদের মধ্যে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, যৌনকর্মীদের মধ্যে কুইজ প্রতিযোগিতাসহ নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

মীর সামসুজ্জামান/আরআই