বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. এসএম শফিকুল ইসলাম কানু

‘দিনরাত সমানে চলত শুধুই আহাজারি। রাত হলেই জ্বলে উঠত আগুন। পরের দিনে রাস্তাঘাটে, গর্তে, জঙ্গলে পড়ে থাকত নারী-পুরুষের লাশ। ক্ষতবিক্ষত শরীরগুলো কখনো উলঙ্গ, আবার কখনো ছিল কাপড়ে মোড়ানো। বাড়িঘরে আগুন, লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিত্যদিনের রুটিন। এ দৃশ্য চোখের সামনে বারবার পড়লে নিজেকে আর স্থির রাখতে পারিনি। চলে গেলাম মুক্তিযুদ্ধে শত্রুমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের আশায়। যুদ্ধে জয়ী হয়েই দীর্ঘদিন পর ফিরে আসি মা-বাবার ছায়াতলে।’

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অংশগ্রহণের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিমাখা কথাগুলো বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা লিডার ড. এস এম শফিকুল ইসলাম কানু। ঢাকা পোস্ট তার সেসব দিনের কথাগুলো তুলে ধরেছে তরুণ প্রজন্মে জন্য।

বীর মুক্তিযোদ্ধা কানু বলেন, আমরা বাঙালিরা হঠাৎ করেই অস্ত্র হাতে তুলে নিইনি। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। সেই বিজয় মেনে নেয়নি আইয়ুব সরকার। তারা সরকার গঠনে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিভিন্নভাবে টালবাহানা শুরু করে। নিরীহ বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। পরে ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলেন। সেই এক ভাষণই বাঙালিদের অনুপ্রেরণা ও সাহস জুগিয়েছিল।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার পর রংপুর থেকে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসি। তখন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর গতিমতি ভালো ছিল না। সবার ধারণা ছিল, কিছু একটা হতে যাচ্ছে। হঠাৎ ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতভাবে হামলা শুরু করল। পরদিন ২৬ মার্চ থেকে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ বলে জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, তখন আমার বাবার সহযোগিতায় অবাঙালিদের হত্যা করে তাদের অস্ত্রগুলো ছিনিয়ে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি আমরা। চারদিকে শুরু হয় তুমুল প্রতিরোধ। পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা তখন বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালায়। বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ-নির্যাতন করে। এসব দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারিনি।

মা-বাবার আশীর্বাদ নিয়ে শুরু হয় আমার যুদ্ধযাত্রা। পরিবার সাহস না দিলে হয়তো দেশের মানুষের জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তাম না। ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি এক কাপড়ে।

ঝড়-বৃষ্টি, গরম-শীত সবই এই এক কাপড়েই কেটেছে। খাওয়াদাওয়া নিয়ে ভাবার সময় ছিল না। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা, দেশকে শত্রুমুক্ত করার ক্ষুধা ছিল আরও তীব্র। তবে তাদের দোসরদের দেওয়া যন্ত্রণা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল। কারণ, আমাদের লক্ষ্য ছিল দেশ স্বাধীন করা পর্যন্ত লড়ে যাব।

বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করার দৃশ্য দেখেছি। এসব দৃশ্য এখনো চোখে ভাসলেই আঁতকে উঠি। পাকিস্তানি হানাদাররা যে কত নিষ্ঠুর ছিল, তা বর্ণনা করে শেষ করার মতো নয়। বিশেষ করে নারীদের প্রতি তারা সবচেয়ে বেশি অমানবিক অত্যাচার করেছে। পরিবারের সামনেই সবাইকে গুলি করে হত্যা করত। এসব দৃশ্য এখনো চোখেমুখে ভেসে ওঠে। আমরা এখন অনেক শান্তিতে রয়েছি। যদি বাংলাদেশ স্বাধীন না হতো, তাহলে দেশের মানুষ বুঝত পাকিস্তান আমলে আমরা কতটা অসহায় ছিলাম।

যুদ্ধ শুরুর আগে প্রশিক্ষণ নেন ভারতে

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগে প্রথমে ভারতের সীতাইতে যান কানু। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করেন। পরে কুচবিহার জেলার তুর্ষা নদী পার হয়ে টাপুরহাট বিএসএফ ক্যাম্প থেকে মুজিব ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ শুরু করেন।

জানতে চাইলে তিনি বলেন, গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। থ্রি নট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এসএমজিসহ বিভিন্ন অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছি। প্রায় দেড় মাসের প্রশিক্ষণে নিজেকে পাকিস্তানি আর্মিদের বিরুদ্ধে গেরিলাযোদ্ধা হিসাবে তৈরি করতে সক্ষম হই।

প্রশিক্ষণ শেষে পশ্চিমবঙ্গের সীতাইতে ক্যাম্প স্থাপন করি আমরা। সেটি বাংলাদেশের হাতীবান্ধার পাশেই। সেখানে আমরা প্রতি রাতে পাকিস্তানি আর্মির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে দুপক্ষের গোলাগুলি শুরু হতো। আমরা যে অঞ্চলে যুদ্ধ করি, সেটি ৬ নম্বর সেক্টরের অধীনে। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খাদেমুল বাসার। পরবর্তীতে তিনি বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া আমার কোম্পানি কমান্ডার মাহাতাব উদ্দিন (বীর প্রতীক) ও আমি ওই কোম্পানির টু-আইসি ছিলাম। আমি মুক্তিযোদ্ধার একটি প্লাটুন পরিচালনা করি।

ওই সময় পাকিস্তানি আর্মিদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে বিভিন্ন স্থানের রেললাইন তুলে ফেলতাম। এ ছাড়া টেলিফোনের তার কেটে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিতাম। রেললাইনের সেতুগুলো বোমা দিয়ে উড়িয়ে দিই। এতে পাকিস্তানি আর্মিরা তাদের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের প্রতি আক্রমণ করি। এভাবেই সম্মুখযুদ্ধে আমাদের সঙ্গে না পেরে পাকিস্তানিরা পিছু হটে। তারপর ৬ ডিসেম্বর লালমনিরহাট হানাদারমুক্ত হয়।

১০ ডিসেম্বর হাতীবান্ধা থেকে রংপুরের উদ্দেশে রওনা করেন শফিকুল। তখনো দেশ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়নি। খুনিয়াগাছ হয়ে হারাগাছ দিয়ে রংপুর শহরে পৌঁছান তিনি। মুক্তিবাহিনী যত্র অগ্রসর হতে থাকে, ক্রমেই পরাস্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটতে থাকে। অবশেষে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসর্মপণের মধ্যে দিয়ে দেশ পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত হয়, যোগ করেন শফিকুল ইসলাম কানু।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর তার আহ্বানে সবার সঙ্গে অস্ত্র জমা দেন শফিকুল ইসলাম। এ সময় তাকে ৩০ টাকা দেওয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে শফিকুল ইসলাম বলেন, অস্ত্র জমা দেওয়ার পর ৩০ টাকা পেয়েছিলাম। ওই সময়ে শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। পায়ে স্যান্ডেলও ছিল না। ওই টাকা থেকে কিছু কাপড় আর জিনিসপত্র কিনেছিলাম। হাতে ছিল আর ১৩ টাকা। সেই ১৩ টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। শত্রুকে খতম করেই বাড়ির দিকে রওনা হই। বাড়ি পৌঁছালে দীর্ঘদিন পর আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা-বাবা। পরিবারের সবাই আমাকে দেখে আকাশের চাঁদ হাতে পান। কারণ, ফিরে আসব, এটা ছিল কল্পনাতীত। তাই অশ্রুসিক্ত হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন।

৫০ বছরে শফিকুল ইসলামের চোখে বাংলাদেশ

স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ অনেক এগিয়েছে। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সঙ্গে বেড়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা। কিন্তু এই প্রাপ্তিতেও মন ভরেনি শফিকুল ইসলামের। তিনি ব্যথিত হন যখন শোনেন নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধার নাম।

অনেকটা আক্ষেপ করে শফিকুল বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, যারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করবে। কিন্তু এতদিন পর আজ আমরা কী দেখছি? ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সময়ে একটি প্রজ্ঞাপন গেজেট আকারে প্রকাশ হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সেই গেজেট মানা হয়নি। বরং ১৬ বার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা পরিবর্তন করা হয়েছে। যেখানে ৮০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল, সেখানে আড়াই লাখের অধিক মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করা হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া বড় কষ্টদায়ক ও হতাশার।

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসনের বিষয়টিতে আজও তেমন গতি নেই। কষ্ট লাগে অনেক অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকার এখন রাজনৈতিক ও আত্মীয়তার আশ্রয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে গেছেন। একজব মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটা আমার লজ্জা, বিষয়টি আমাদের জন্য অনেক বেদনাদায়ক। জীবনের মায়া ভুলে দেশমাতৃকার জন্য যুদ্ধ করেছি। তখন যারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করেছে, আজ তারাই নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে।

এদিকে বর্তমানে লালমনিরহাটে হিসাব ছাড়া মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে বলে দাবি মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক জেলা কমান্ডার মেজবাহ উদ্দিন আহমেদের।

তিনি ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বলেন, প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধা বেড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না কখন কীভাবে বেড়ে যায়। এ নিয়ে আমরা ভীষণ চিন্তিত। বর্তমানে জেলায় কতজন ভাতা পাচ্ছেন, কতজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আছেন, সেটিও আমাদের অজানা। মুক্তিযোদ্ধা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বসহকারে খতিয়ে দেখতে হবে। না হলে এটা ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

উল্লেখ্য, লালমনিরহাট সদরের গোড়ল ইউনিয়নের লোহাকুচির গ্রামের সীমান্তে বসবাস শফিকুল ইসলাম কানুর। ১৯৭০ সালে তিনি রংপুরের বদরগঞ্জ কলেজের ছাত্র ছিলেন। রাজনীতির হাতেখড়ি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন থেকে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন কানু। তার বাবা অলি উদ্দিন আহমেদ। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় এস এম শফিকুল ইসলাম কানু। বড় ছেলে সালেবিন সুফি সেনাবাহিনীর লেফট্যানেন্ট কর্নেল পদে কর্মরত, ছোট ছেলে সাইফবিন সুফি স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী।

এনএ/এমএসআর