ফাল্গুনী সাহা

জীবন তাকে পদে পদে আটকে দিয়েছে। অঙ্গহানি, অর্থনৈতিক বৈকল্য আর সামাজের বাঁকা চোখ কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। শৈশবে দুই বছর স্কুলে যেতে পেরেছিলেন আনন্দে। তারপর একটি দুর্ঘটনায় বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে পরিবারের অনুপ্রেরণায় তীব্র দারিদ্র্যের মধ্যেও হাল ছাড়েননি। সেই সংগ্রাম করেছেন টানা ১৯ বছর। সফলও হয়েছেন প্রত্যেক স্তরে। 

সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) বাসি বিয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। অবশ্য তার আগের দিন বুধবার (১ ডিসেম্বর) দুই পরিবারের সম্মতিতে সাত পাকে বাঁধা পড়েন প্রেমিকের সঙ্গে।

গল্পটি সবার পরিচিত সেই অদম্য ফাল্গুনী সাহার। ফাল্গুনী এক অনুপ্রেরণার নাম। সাহসিকতার নামও বললেন স্বামী সুব্রত মিত্র। তিনি বলেন, ওর জীবনের করুণ অধ্যায়টি আমাদের সকলের জানা। দুজনের বাড়ি  একই জেলায়। ফাল্গুনীকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম। ওর হাত হারানো দুর্ঘটনাটি হৃদয় ছুঁয়ে যায়। এসএসসি, এইচএসসিতে সেরা ফলাফল করে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো তখন থেকে ফেসবুকে কথা হতো নিয়মিত। দিন দিন দুজনের মধ্যে আন্তরিকতা বাড়ে।

সুব্রত মিত্র বলেন, কথাবার্তায় এক সময়ে অনুধাবন করলাম ফাল্গুনী তার হাত হারানোর ঘটনাটি নিয়ে বেশ হতাশ। তার ভালো ফলাফল, সবকিছু করতে পারাটাকে গুরুত্ব না দিয়ে হতাশায় ভুগছে। তখন শুধু লেখাপড়াটাই সীমাবদ্ধ মনে করতো, সামনের দিকে আগানোর কোনো চিন্তা ছিল না। তখন থেকেই তাকে সাহস জোগাতাম। উৎসাহ দিতাম।

একজন মানুষের হাত নেই বা পা নেই এটি কোন মুখ্য বিষয় হতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি ওকে স্বপ্ন দেখাই, আমি ওকে ভালোবাসা শেখাই এবং আমি ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিই। সর্বশেষ আমরা বিয়েও করেছি। আমি সব সময়ে ফাল্গুনীর সাফল্য কামনা করি। কারণ বর্তমান সময়ে সে একটি দৃষ্টান্ত।

ফাল্গুনীর জীবনযুদ্ধ শুরু হয় ২০০২ সালে। পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা সদরের জগদীশচন্দ্র সাহা ও ভারতী সাহার চার মেয়ের মধ্যে ফাল্গুনী তৃতীয়। তখন তিনি গলাচিপা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী। নিজেদের বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে দুই হাত দিয়েই বিদ্যুতের তার ধরেন ফাল্গুনী। বিদ্যুতায়িত হয়ে হাত পুড়ে যায়। দেশে চিকিৎসায় উন্নতি না হওয়ায় ভারতে চিকিৎসা করাতে নেয় তার পরিবার। 

স্বামী সুব্রত মিত্রের সঙ্গে ফাল্গুনী সাহা

কিন্তু সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, বিদ্যুতের তারে ক্ষতস্থানে পচন ধরেছে। ফাল্গুনীকে বাঁচাতে দুই হাত কেটে ফেলা হয়। এরপর থেকেই পঙ্গু ফাল্গুনী। ওই বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকলেও পরের বছর একই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। তখন দুই হাত দিয়ে কলম ধরে লেখার চেষ্টা করলেও প্রথমে পারতেন না। তবে অদম্য মনোবলের কারণে দিনরাত চেষ্টা চালিয়ে যান। সেই চেষ্টায় কলম ধরার স্থানে ঘা হয়ে যায়। চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছিলেন যেন ঘায়ের স্থান দিয়ে কলম না করে। দরকার হলে কিছু দিন লেখা বন্ধ রাখুক। কিন্তু ফাল্গুনী সেই পরামর্শ উপেক্ষা করে পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি অর্জন করেন।

এর কিছু দিন পরে মারা যান ফাল্গুনীর বাবা জগদীশচন্দ্র সাহা। আবারও অনিশ্চয়তায় পড়ে পুরো পরিবার আর ফাল্গুনীর লেখাপড়া। তখন মা ভারতী সাহা মিষ্টির প্যাকেট বানিয়ে সংসার চালানো শুরু করেন। সেই কাজ ফাল্গুনীও করেছেন। 

ফাল্গুনীর মা ভারতী সাহা বলেন, কোনো দিন ফাল্গুনীকে কোনো কিছুতে নিরুৎসাহিত করিনি। ও যা করতে চেয়েছে বলেছি, তুমি পারবে। ২০১১ সালে গলাচিপা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এই খবর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়লে ঢাকার ট্রাস্ট কলেজের অধ্যক্ষ বশির আহমেদ তাকে ঢাকায় নিয়ে তার কলেজে ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে থেকে ২০১৩ সালে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করে ফাল্গুনী।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কোচিংয়ের জন্য ফার্মগেটে একটি মেসে থেকে লেখাপড়া করতো। সেখানে দেড় হাজার টাকায় একটি টিউশনি শুরু করে। তবে এক মাসের মধ্যেই সেই টিউশনিটি চলে যায়। কারণ যে বাসায় টিউশনি করছিল তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না হাত হারানো ফাল্গুনী আসলেই কিছু শিখাতে পারবে। তবে আত্মীয়-স্বজন ও পরিবারের সহায়তায় সূত্রাপুরে থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যায় ফাল্গুনী। ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে। ওর অক্লান্ত সংগ্রামের বিষয়ে জানতে পেরে এগিয়ে আসে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন। তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শেষ হয় অনার্স। যতটুকু লেখাপড়া করেছে তা দিয়ে আবেদন করে উন্নয়ন সংস্থা ব্রাকে। ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর ব্র্যাকে হিউম্যান রিসোর্স অফিসার পদে নিয়োগ পায় ফাল্গুনী।

সুব্রত মিত্রের ছোট বোন শ্রাবন্তী মিত্র বলেন, দুজনের মধ্যে দুই বছরের অধিক সময় ধরে প্রেম ছিল। পরিবার থেকে বিষয়টি জানতাম। শেষে দাদা নিজেই ইচ্ছা প্রকাশ করলেন বিয়ের। আমাদের পরিবারও অসম্মতি জানায়নি। দুই পরিবারের সম্মতিতে বুধবার রাতে লগ্ন ছিল তখন বরিশাল নগরীর শংকর মঠ মন্দির প্রাঙ্গণে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। সুব্রত দাদাও বেসরকারি একটি উন্নয়ন সংস্থায় ফিল্ড অফিসার পদে কর্মরত।

তিনি আরও বলেন, অনেকেই বিয়ে দেখে অবাক হয়েছেন। আমি তাদের বলবো আর পাঁচটা বিয়ে যেমন এদের দুইজনের বিয়েও তেমনি। অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন দুই হাত হারানো মানুষকে কেন বিয়ে করলেন সুব্রত দাদা। তাদের বলবো সবার মানসিকতা আমার ভাইয়ের মতো হওয়া উচিৎ। পঙ্গুত্ব কোনো বাধা হতে পারে না।

জীবন সংগ্রামে অপরাজিত ফাল্গুনী সাহা বলেন, আমার জীবনে দুর্ঘটনার পর কেউ হয়তো ভাবতে পারেন আমি অবজ্ঞার শিকার ছিলাম। বস্তুত বিষয়টি তেমন না। জীবনের এইটুকু সময় পার করতে  আমাকে প্রতিকূলতা পার হতে হয়নি। সকলেই আন্তরিকতার সঙ্গে সহায়তা করেছে। সমাজে সবাইতো এক মানসিকতার নয়, কে কোন মেন্টালিটির সেটা তার ওপর ডিপেন্ড করে। যার মেন্টালিটি ভালো সে এগিয়ে আসবে, যার পক্ষে এমন বিয়ে সম্ভব না তার দূরে থাকাই ভালো। আমি আমার জীবনের সংগ্রাম নিয়ে দুশ্চিন্তা করি না। বরং আপনাদের কাছে আশীর্বাদ চাই যেন আগামী দিনগুলোতে আমরা ভালো থাকি।

তিনি জানান, কিছুদিনের জন্য গলাচিপা শ্বশুড়বাড়িতে যাবেন। এরপর আবার বরিশালে এসে কাজে যোগ দেবেন।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর