মার্চ মাস ছিল আন্দোলন ও সংগ্রামের। উত্তাল, উত্তেজনায় ভরপুর চারপাশ। ক্ষণে ক্ষণে বদলে যাচ্ছিল দৃশ্যপট। একদিকে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গড়িমসি, অন্যদিকে দেশব্যাপী প্রতিরোধ-সংগ্রাম। ঠিক এমন সময় রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হয়ে দেশ স্বাধীনের প্রত্যয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে লাফিয়ে পড়েন।

মা-বাবা দেশমাতৃকাকে রক্ষায় অনুমতি দিলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন দুই ভাই একসঙ্গে। কুড়িগ্রাম হয়ে চলে যান ভারতে। শেখানে প্রশিক্ষণ শেষে যোগ দেন সম্মুখসমরে। ৩০ থেকে ৩৫টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে দেশে ফেরেন পরিবারের কাছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা ওয়াসিকার মো. ইকবাল মাজু। গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের মিয়া বাড়িতে তার জন্ম। বর্তমানে গাইবান্ধা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে। ঢাকা পোস্ট পাঠক ও তরুণ প্রজন্মের জন্য তুলে ধরেছে তার সাহসিকতাপূর্ণ ও বিভীষিকাময় সেসব স্মৃতিমাখা কথা।

মা-বাবা ও বঙ্গবন্ধুর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হই
মা-বাবার অজান্তে একাত্তরের উত্তাল দিনগুলোতে সদ্য কলেজে যাওয়া ছেলেটি জন্মভূমি আর মানুষকে ভালোবেসে গোপনে প্রতিবাদী মিছিল আর সমাবেশে যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার পর তিনি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনস্থির করেন। পরে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা তরুণদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণে আহ্বান জানালে তিনিও গাইবান্ধা সরকারি কলেজ মাঠে রাইফেল দিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। বেশ কিছুদিন পর তুমুল আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়। তারপর বেরিয়ে পড়েন দেশমাতৃকাকে উদ্ধার করতে।

 

 

মাজু বলেন, ১৯৭১ সালে আমি ছাত্র অবস্থায় ছিলাম। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরই মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হতে থাকি। এদিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে থাকে। চারদিকে তুমুল আন্দোলন-সংগ্রাম শুরু হয়। আমার মা-বাবা যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দেন। এতে আরও উদ্বুদ্ধ হই। তারপর আমি ও আমার ছোট ভাই ১৭ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য গাইবান্ধা থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই।

কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী উপজেলায় গিয়ে উপস্থিত হই। পরবর্তীতে আমরা ভারতের মানকার চরে যাই। সেখানের একটি জায়গায় ইয়ুথ ক্যাম্প ছিল। সেই ক্যাম্পে আমরা প্রাথমিক ট্রেনিং করি। ট্রেনিংয়ে ২১৩ জন্য উত্তীর্ণ হই। পরে আমরা ভারতের তুরাতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধীনে ট্রেনিং করি। সেই ট্রেনিংয়ে আমাদের যুদ্ধের সব রকম কলাকৌশল শেখানো হয়। পরে সেনাবাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন কোম্পানির অধীনে ভাগ হয়ে যাই।

তিনি আরও বলেন, পরে নৌকাযোগে ভারত থেকে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে গাইবান্ধার বালাসীঘাটে আসি। ১১ নং সেক্টরের অধীনে মাহবুবে এলাহী রঞ্জুর (বীর প্রতীক) কোম্পানিতে আমরা ৩৩ জন যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিই। বালাসীঘাটের পূর্ব পাশে ফজলুপুর ইউনিয়ন। প্রথমেই ফজলুপুর ইউনিয়নের কালাসোনার চর থেকে রাতে বাদিয়াখালী ব্রীজ অপারেশনের উদ্দেশে রওনা দিই।

রাত তখন তিনটা বাজে। পাটখেতের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় সহযোদ্ধা ইমাম হোসেন নামের একজনকে একটি সাপ কামড় দেয়। আমরা সবাই ভীত হয়ে পড়ি। পরে নিশ্চিত হই সেটা বিষধর সাপ নয়। সেদিন আর বাদিয়াখালী ব্রীজ অপারেশন করা হলো না। সেখান থেকে দুই মাইল দূরে রতনপুরের তৎকালীন আতিকুল্লা নামের এক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয় নিই।

জয় বাংলা বলে তাদের অ্যাটাক করি
পরদিন ৯টার দিকে স্থানীয় লোকজন মুক্তিযোদ্ধা বুঝতে পেরে আমাদের বলে সামনের ঘাটে একদল রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লুটপাট করছে। বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দাবি করছে তারা। পরে আমরা সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। দেরি না করে সবাই মিলে নদীর ঘাটে যাই। ১০ জন করে তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হই। একটি গ্রুপ সরাসরি গিয়ে তাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধ শুরু করি। বাকি দুই গ্রুপ দুই পাশে অ্যাটাক করে। একসময় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। সেখানে আমরা ৫২ জনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করে নৌকাযোগে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিই।

আবারও এসে চেয়ারম্যানের বাড়িতে অবস্থান করি। পরদিন বিকেল তিনটার দিকে শুনতে পারি আমরা যে গ্রামে অপারেশন করেছি, সেই গ্রামে দুই ট্রাক পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসে তাণ্ডব চালিয়েছে। রতনপুর গ্রামে লুটপাট, জ্বালাও-পোড়াওসহ ১৭০ জন নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। বহু নারীকে ধর্ষণ করেছে। এ খবর শোনার পর আমরা সবাই অস্ত্র নিয়ে নদীর ঘাটে যাই। সে সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী লুটপাট করা সোনাদানা, গরু-বাছুর নিয়ে ট্রাকযোগে গাইবান্ধা শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ছোট নৌকায় করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঘাটে রাখা ট্রাকের কাছে গিয়ে পেছন থেকে আমরা জয় বাংলা বলেই তাদের অ্যাটাক করি। তিনটা এলএমজি, হ্যান্ড গ্রেনেডসহ আমাদের কাছে যা ছিল, সব অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ শুরু করি। পাকিস্তানিরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আমাদে গুলি খেয়ে সবাই নদীতে পড়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর সারা গ্রাম থেকে শত শত লোক জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ঘাটে এসে উপস্থিত হয়। কিন্তু নদী খরস্রোতা হওয়ায় লাশগুলো না পাওয়ায় আমাদের খুবই মন খারাপ হয়। অনেক অস্ত্র, সোনাদানা উদ্ধার করি। পরে লুটপাট করা জিনিসপত্র স্থানীয় লোকজনের কাছে ফিরিয়ে দিই। সেদিন আবারও সেই চেয়ারম্যানের বাড়িতে ফিরে আসি।

পরদিন সকালে স্থানীয় লোকজন এসে আমাদের জানায়, আপনারা গতকাল যে অপারেশন চালিয়েছিলেন, আজকে নদীর মোহনায় তাদের লাশ ভেসে উঠেছে। আমরা নদীতে গিয়ে ঘটনার সত্যতা পাই। পরে তাদের ইউনিফর্ম খুলে নিয়ে আবার তাদের লাশ নদীতে ভাসিয়ে দিই। সেদিন আমরা ২৬ পাক শত্রুকে হত্যা করেছিলাম। মূলত ৩৩ জন মুক্তিযোদ্ধার সাহসী হামলায় পাকিস্তানি সেনারা সেদিন ঘায়েল হয়েছিল।

কতটি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন, এমন প্রশ্নে এই বীর সেনানী বলেন, অন্তত ৩০ থেকে ৩৫টি যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করেছি। মূলত মাহাবুবে এলাহীর কোম্পানির অধীনে গাইবান্ধা জেলায় বড় বড় যে কয়েকটি যুদ্ধ হয়েছিল, সবগুলোতে আমি অংশগ্রহণ করেছি।

বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে ভাবনা
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যখন এ দেশের দায়িত্বে ছিল না, সে সময় তো আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে পারতাম না। আজ কিছু না হোক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নিজের পরিচয় দিতে পারি। সম্মানের সহিত কথা বলতে পারি। সবকিছুই সম্ভব হয়েছে বর্তমান সরকারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার কারণে। তাকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। তিনি আজকে ভাতার ব্যবস্থা করছেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। এত সব উদ্যোগের জন্য আমরা সব মুক্তিযোদ্ধা গর্বিত। তবে দেশকে আরও এগিয়ে নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, জেলায় মোট ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন ২ হাজার ২০০ জন। এর মধ্যে কিছু মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেছেন। তা ছাড়া সব মুক্তিযোদ্ধাই সরকারি ভাতাপ্রাপ্ত। কোনো মুক্তিযোদ্ধাই ভাতার বাইরে নেই।

গাইবান্ধায় মুক্তিযোদ্ধা নামে ভুয়া কেউ আছে কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রতিটি জেলায় কমবেশি ভুয়া লোকজন মুক্তিযোদ্ধা বনে গেছে। গাইবান্ধায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা থেকে ভুয়া ব্যক্তিদের নাম বাতিল ও তাদের প্রতিরোধে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়েছে। জেলা প্রশাসকের কাছে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছে একাধিকবার। তবে জেলা থেকে ভুয়া লোকজনকে মুক্তিযোদ্ধা বানাতে সুপারিশ যায় না কখনো। মূলত মন্ত্রণালয়ের অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাধ্যমেই এসব ভুয়া লোকজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়।

১৯৯০ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক। এর মধ্যে দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে সবার ছোট। তার বাবা ছিলেন একজন চাকরিজীবী। পরিবারের ৫ ভাই ৫ বোনের মধ্যে মাজু ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা আব্দুর রশিদ মিয়া আর মা মরিয়ম খাতুনের আদরের ছেলে ছিলেন ওয়াসিকার মো. ইকবাল মাজু।

এনএ