বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ রশিদ সিদ্দিকি

এম এ রশিদ সিদ্দিকি। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের টীকাপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মৃত সাহের উদ্দীন আহমেদ ও মাতা রাবেয়া বেগমের ৮ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান রশিদ সিদ্দিকি। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেশ চতুর ও বুদ্ধিমান।

শহরে পিটিআই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা ও ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হন ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজে। সরকারি কলেজের কলা অনুষদ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অংশগ্রহণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। আজ জানব ঢাকা পোস্টকে বলা এম এ রশিদ সিদ্দিকির মুখে মুক্তিযুদ্ধের গল্প।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ের আগে ও পরে একজন নেতা ছিলেন, যার অদ্বিতীয় কেউ ছিলেন না, রেসকোর্স ময়দানের তার ভাষণে উদ্ধুদ্ধ হয়ে আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এম এ রশিদ সিদ্দিকি জানান, ঠাকুরগাঁও পৌরসভার মধ্যে আমার জন্ম। আমি যেদিন দেশ ছাড়ি, সেই তারিখটা সম্ভবত ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল। আমি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতাম। এ কথা যখন খানসেনারা জানতে পারে, তখন আর বাড়িতে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। তখন আমি পরিবার থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য গড়েয়ার লাউথুতি গ্রামে যাই। সেখানে আমার মা-বাবা থাকতেন।

তিনি আরও জানান, বাসায় যাওয়ার পথে দেখলাম গড়েয়া বাজারে অনেক পাকিস্তানি পতাকা ওড়ানো। আমার সহ্য হলো না। আমি গালিগালাজ করি ও পতাকাগুলো উড়িয়ে দিতে চাই। বিদায় নেওয়ার জন্য বাসায় যায়। বাসার যাওয়ার সাথেই একজন গিয়ে বললেন, ‘খানসেনারা তোমাদের বাসায় আসতেছে।’ বাবা নামাজ পড়ছিলেন, তাই শেষ বিদায়টা বাবার কাছে নিতে পারিনি।

কোথায় ও কার অধীনে ট্রেনিং-যুদ্ধ

আমরা ৪০ জন প্রথমে ঠাকুরগাঁও কলেজের বড়মাঠে ৭ দিন ট্রেনিং নিয়েছিলাম। সেখানে প্রথমে ইউসুফ স্যার ট্রেনিং দিয়েছিলেন। পরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক বড় স্যার আমাদের রাইফেল ট্রেনিং দেন ৭ দিন। এই ট্রেনিং নেওয়ার পর আমরা পৌর এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।

ট্রেনিং শেষ করেই প্রথমে আমরা কোম্পানি কমান্ডার মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বে কুচবিহারের শীতলকুচি ক্যাম্পে যোগ দিই। সেখান পেলাম মেজর বার্লে রাজপুত। তিনি ইন্ডিয়ানও ছিলেন না, বাঙালিও ছিলেন না; তিনি ছিলেন রাজপুত। ওখানে আমরা এক মাস ছিলাম। এক মাস থাকার পর সেখানে আমাদের অনেক যোদ্ধা শহীদ হন।

পাশের এলাকাগুলোতেও খুব যুদ্ধ হতো। সেখানে আর্টিলারি বেশি ব্যবহার হতো। তারপর আমাদের সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় হলদিবাড়ি দেওয়ানগঞ্জ। সেখানকার মেজরের নাম আমি ঠিক বলতে পারব না, আমার জানা নেই। এরপর আমাদের পাঠানো হয় ডিমলায়। সেখানেই ক্যাপ্টেন ইকবাল রশিদের নেতৃত্বে আমি যুদ্ধ করি।

যুদ্ধের লোমহর্ষক স্মৃতিচারণা

মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার একটি কষ্টকর ঘটনা আছে, যেটি হৃদয়বিদারক। ভারত যেদিন আমাদের স্বীকৃতি দিল, সেদিন কিশোরগঞ্জের এক এলাকায় আমরা খানসেনার ক্যাম্প থেকে অনেকগুলো গোলা-বারুদ জব্দ ও দুজন খানসেনাকে জীবিত ধরতে পেরেছিলাম। সেদিন আমাদের অপর কমান্ডার স্বপন কুমার বকশি, যিনি হাইড আউট করে থাকতেন। সেখানে অ্যান্টিটেইন মাইন্ডগুলো তিনি খোলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেখানে সেগুলো ব্লাস্ট হয়ে যায় এবং ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা সেখানে টুকরো টুকরো হয়ে যান। কে কোথায় চলে যায়, সেটি আর আমরা খুঁজে পাইনি।

সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণা

আমরা ক্যাপ্টেন কমান্ডার মনিরুজ্জামান মনিরের নেতৃত্বে খান এলাকার একটি ক্যাম্প দখলের প্রস্তুতি নিলাম। প্রতিটি সেক্টরে আমাদের ১০ জন করে সদস্য ছিলেন। প্রতি সেক্টরে একজন করে এলএমজি থাকত। পাশে যে স্কুলে তারা থাকে, তাদের ১ মাইল দূরে ছিল হেডকোয়ার্টার। সেখান থেকে তারা গরু-ছাগল নিয়ে যেত, মা-বোনদের ওপর অত্যাচার করত। এখানে রাজাকাররা তাদের সহযোগিতা করত।

গাইডম্যান আমাদের বলতেন, এই ক্যাম্পটি যদি দখলে আনতে পারি, তাহলে অনেক উপকার হবে এবং মানুষ অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ৯০ জন যোদ্ধা সেখানে অবস্থান করলাম।

পরের দিন যখন ১৫-২০ জন খানসেনা ও ১৫-২০ জন রাজাকার লরি করে স্কুল থেকে বের হচ্ছিল, তখনই আমাদের সেনারা তাদের ওপর ফায়ারিং শুরু করল। তারা অনেকজনেই সেখানেই নিহত হলো এবং অনেকে চলে গেল। তাদের মধ্যে যে ওয়্যারলেসম্যান ছিল, সে মারা যায়নি, সে সাথে সাথে হেডকোয়ার্টারে বিষয়টি জানিয়ে দিল।

সাথে সাথে তারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের চারপাশ দিয়ে ঘিরে ফেলল। এমনকি আমরা কভারিংয়ে যাওয়ার পর তাদের আয়ত্তে চলে যায়। এমন কুয়াশা ছিল যে একটু দূরেই দেখা যেত না লোকটি খানসেনা নাকি বীর মুক্তিযোদ্ধা। পরবর্তীতে দেখি আমাদের কয়েকজন যোদ্ধাকে খানসেনারা তাদের লরির সাথে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। যেটি সহযোদ্ধা হিসেবে অনেক কষ্টের ছিল।

সাধারণ মানুষের ভূমিকা

সহযোগিতা আমরা পেয়েছি। একজন আমাদের গাইডার ছিলেন। তিনি সবকিছু চিনতেন। তিনি আমাদের গাইড দিতেন আর রাতের বেলা দেখিয়ে দিতেন কোনটা খানসেনাদের ক্যাম্প, কোনটা রাজাকার, কোনটা আলবদর আর কোনটা জামায়াতদের বাড়ি। তিনি দেখানোর পর আমরা রাতে সেখানে রেইড (আক্রমণ) করতাম। তার বাড়ি ছিল ডিমলার ঠাকুরগঞ্জ এলাকায়। কিন্তু তার নাম আমার স্মরণ নেই। তবে তার স্মৃতি আমার স্মরণ আছে।

যখন আমরা হাইড আউট করতাম, তখন বাসায় থাকতাম। রাতে সেখানে যেতাম কখনো কখনো দিনে গিয়েও ঘুমাতাম। ওই বাসার যিনি মালিক ছিলেন, তিনি আমাদের বাসাটা ছেড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন, তবে মাঝে মাঝে আসতেন। খোঁজখবর নিতেন। আমরা বাজার করতে পারতাম না। একদিন তিনি এসে তার চৌকাগুলোতে (ছোট পুকুর) মাছ ধরতে বলেন, পরে আমরা সেখান থেকে মাছ ধরি। আরও অনেক সাধারণ বাঙালি বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন।

কেমন আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা

বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেশ ভালো আছেন, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একসময় মুক্তিযোদ্ধারা রিকশা-ভ্যানগাড়ি চালাতেন। হোটেলে কাজ করতেন। সেখান থেকে তুলে নিয়ে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের অনেক মর্যাদা দিয়েছেন, যা কল্পনা করার বাইরে। এর আগে অনেক সরকার এসেছে, তারা কিছু করেনি। কয়েক মাস আগের কথা, আমাদের মাসিক ভাতা ছিল ১২ হাজার টাকা। শুনলাম যে সেটা বাড়ানো হবে।

আমি ভেবেছিলাম হয়তো ৩ হাজার বাড়িয়ে ১৫ হাজার করা হবে। কিন্তু সরকার ২০ হাজার টাকা করে দিয়েছে। যেটা ছিল আমাদের জন্য অকল্পনীয়। এটাতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোথাও শ্রম দিতে হয় না, কাজ করতে হয় না। শুধু তা-ই না, আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমরা যেন ভালোভাবে পালন করতে পারি, এ জন্য তিনি আমাদের প্রতিবছরে ৫ হাজার করে উৎসব ভাতা দেন।

এ ছাড়া প্রতি পহেলা বৈশাখে ইলিশ-পান্তা খাওয়ার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ২ হাজার টাকা করে ভাতা দেন। যাদের ঘর নাই তাদের ঘর করে দিচ্ছেন। যাদের জমি নেই তাদের জমি দিচ্ছেন। সর্বসাকল্যে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে জমি ও বাড়ি করে দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। চাকরি দিচ্ছেন, সন্তান-নাতিদের মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি দিচ্ছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এত প্রাপ্তির জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই, তিনি দীর্ঘজীবী হোন।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। এর আগে ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস বিভিন্ন সময়ে পালন করা হতো। বিষয়টি ভালো মনে হয়নি। তাই আগামী বছর থেকে আমরা এটার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে ঠাকুরগাঁও মুক্ত দিবস পালন করা হবে বলে জানান তিনি।

এমএসআর/এনএ