শেরপুরের অন্যতম পর্যটন স্থান গজনী অবকাশ কেন্দ্র

বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি থামিয়ে দিয়েছিল সবকিছু। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জীবনযাত্রা। বাদ যায়নি শেরপুরের অন্যতম পর্যটন স্থান গজনী অবকাশ। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর অবশেষে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে ভারত সীমান্তঘেঁষা অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি গজনী অবকাশ কেন্দ্র। শহুরে কোলাহল ও নাগরিক ব্যস্ততা থেকে একটু বিনোদন মানবজীবনে সবার প্রয়োজন। সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঘুরে যেতে পারেন ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার গজনী অবকাশ থেকে।

ভারত সীমান্তঘেঁষা উঁচু-নিচু পাহাড়বেষ্টিত এই পর্যটনকেন্দ্রে নৈসর্গিক দৃশ্য দেখতে শীতকালে নতুন বছরের শুরুতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। গারো পাহাড় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব এক লীলাভূমি। আর তাই শেরপুর জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা ঝিনাইগাতীর ঐতিহ্যবাহী গারো পাহাড়ের গজনী অবকাশের পাদদেশে অবস্থিত সারি সারি শাল, গজারি, সেগুনগাছ; ছোট-বড় মাঝারি টিলা, লতা-পাতার বিন্যাস, যা প্রকৃতি ও পর্যটনপ্রেমীদের মনে নিশ্চিত দোলা দিয়ে যাবে।

শেরপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরত্বে ১৯৯৩ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে গজনী অবকাশ কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়। ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের প্রায় ৯০ একর পাহাড়ি এলাকাজুড়ে এর অবস্থান। গড়ে ওঠার পর থেকেই প্রতিবছর ক্লান্ত জীবনের ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে অবসরে হাজারো পর্যটক ভিড় করেন এই গজনী অবকাশ কেন্দ্রে।

এই জেলার বিশাল অংশজুড়ে গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি। লাল মাটির উঁচু-নিচু পাহাড়, গহিন জঙ্গল, টিলা, মাঝেমধ্যে সমতল। দুই পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে ছন্দ তুলে এগিয়ে চলা স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝরনা। পাহাড়, বনানী, ঝরনা, হ্রদ এসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেও কৃত্রিম সৌন্দর্যের অনেক সংযোজনই রয়েছে গজনীতে। বিভিন্ন সময় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বেশ কিছু স্থাপনা ও ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে। গজনীর প্রবেশমুখে মৎস্যকন্যা (জলপরী) আপনাকে স্বাগত জানাবে, তারপর রয়েছে ডাইনোসরের বিশাল প্রতিকৃতি, ড্রাগন ট্যানেল, দণ্ডায়মান জিরাফ, পদ্মসিঁড়ি, লেক ভিউ পেন্টাগন, হাতির প্রতিকৃতি, স্মৃতিসৌধ, গারো মা ভিলেজ, ওয়াচ টাওয়ার, নিকুঞ্জ বন ও আলোকের ঝরনাধারা।

আগে গজনীতে ছোট পরিসরে একটি চিড়িয়াখানা থাকলেও নতুন করে এতে সংযুক্ত করা হয়েছে মেছো বাঘ, অজগর সাপ, হরিণ, হনুমান, গন্ধগোকুল, সজারু, কচ্ছপ, বাজপাখি, খরগোশ, ভাল্লুকসহ প্রায় ৪০ প্রজাতির প্রাণী।

শেরপুর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নতুন করে পাহাড়ের বুকজুড়ে তৈরি হয়েছে সুদীর্ঘ ওয়াকওয়ে, যেখানে পায়ে হেঁটে পাহাড়ের স্পর্শ নিয়ে লেকের পাড় ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে। উঁচু পাহাড় কেঁটে তৈরি হয়েছে মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাত। এ ছাড়া রয়েছে আগত শিশু দর্শনার্থীদের জন্য চুকুলুপি চিলড্রেনস পার্ক, সেখানে ফ্লাইওভার গজনী এক্সপ্রেস ট্রেনের পাশাপাশি নতুন করে যুক্ত হয়েছে শিশু কর্নার, সুপার চেয়ার, নাগরদোলা ও মেরিগো।

গজনী অবকাশে থাকছে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিং কর্নার। ‘পর্যটনের আনন্দে তুলসীমালার সুগন্ধে শেরপুর’ স্লোগানে শেরপুর জেলা ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য নির্মিত ব্র্যান্ডিং কর্নারে জেলার বিভিন্ন ইতিহাস-ঐতিহ্যসংবলিত ছবি, পুস্তক, ভিডিও চিত্র থাকবে। জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য তুলসীমালা চালের জন্যও থাকবে আরেকটি আলাদা নির্দিষ্ট স্থান।

এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাওয়ার জন্য এবার নতুন তৈরি করা হচ্ছে ক্যাবল কার, যা গজনী অবকাশে আসা ভ্রমণপিপাসুদের বিনোদনের জন্য আলাদা মাত্রা যোগ করবে। এ ছাড়া গজনী অবকাশ কেন্দ্রে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেক, লেকের ওপর রংধনু ব্রিজ, কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিফলক, মাটির নিচে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াতের জন্য ড্রাগন ট্যানেল।

অবকাশকেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ সাইট ভিউ টাওয়ার। ৮০ বর্গফুট উচ্চ এ টাওয়ারে উঠলে দেখা যাবে পুরো গজনী অবকাশের পাহাড়ি টিলার অপরূপ সৌন্দর্যময় সবুজ দৃশ্য।

পাহাড়ি পরিবেশ গজনীতে শুধু ঘুরবেন কিছু কিনবেন না, তা কী করে হয়। অবকাশ কেন্দ্রের ভেতরে রয়েছে ছোট-বড় অর্ধশতাধিক দোকান। যেখানে রয়েছে ছোট্ট সোনামণিদের জন্য প্রায় সব ধরনের খেলনা, নারীদের জন্য সব ধরনের নতুন প্রসাধনী, চাদর, শাল, থ্রি-পিস; পুরুষদের জন্য বিভিন্ন রঙের পাঞ্জাবি, টুপি, সানগ্লাস, হর্সম্যান ক্যাপসহ রান্না-বান্নার কাজে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র।

গজনীতে খাবারের হোটেলগুলোও বেশ উন্নত মানের ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এখানে রয়েছে সাদা ভাত, দেশি মুরগির মাংস, গরুর মাংস, ছোট মাছসহ দেশীয় প্রায় সব ধরনের ভর্তা।

গজনী অবকাশ কেন্দ্রের ভেতরে কথা হয় নোয়াখালী থেকে আসা এনজিও কর্মী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, গজনী অবকাশের সুনাম পুরো বাংলাদেশে। এ নয়নাভিরাম ও মনোমুগ্ধকর পাহাড়ি পরিবেশে ঘুরতে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো এলাম। ইচ্ছে হয় প্রতিবছরই এখানে পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে আসতে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বেসরকারি চাকরি করতে হয় বলে সে সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবুও শত ব্যস্ততার মাঝে সময় পেলে ঠিকই শেরপুরের এ অন্যতম পিকনিক স্পট গজনী অবকাশে ছুটে আসি।

চুকুলুপি চিলড্রেন পার্কে কথা হয় টাঙ্গাইল জেলার শহিদুল মিয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, তাদের উচ্চবিদ্যালয়ের মোট ৫৭ জন শিক্ষার্থী ঘুরতে গজনী অবকাশে এসেছে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আকাশী জানায়, শেরপুরের গজনী অবকাশের অনেক কথা সে তার মা-বাবার কাছে শুনেছে। তখন থেকেই আকাশী গজনীতে আসার কথা ভাবত। আজ তার সে আশা পূর্ণ হয়েছে। আকাশী আরও জানায়, এখানে এসে সে বড় বড় পাহাড় দেখেছে। মস্ত বড় অজগর সাপ, হরিণ, সজারু, কচ্ছপসহ পাহাড়ি ঝরনাও দেখেছে।

গজনী অবকাশ নতুন রূপে সজ্জিত হওয়া ও প্রশাসনের সহযোগিতার ব্যাপারে স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক (উপসচিব) এ টি এম জিয়াউল ইসলাম বলেন, ভারত সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় ঘেরা গজনী অবকাশ ভ্রমণপিপাসুদের পছন্দের একটি অন্যতম জায়গা। তাদের কথা ভেবে করোনাকালীন স্বাস্থ্যবিধি মেনে গজনী অবকাশ সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।

এনএ