বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ব ম নুরুল আলম

‌‌‌‘ধানখেত। খেতের মধ্যে পানি। সামনে পাক বাহিনী। পেছনে রাজাকার আসছে। আমি একা। সামনে নদী। নদীটা বেঁকে গেছে। ওরা চাইলেই আমাকে ঘিরে ধরতে পারে। সেখানে উপস্থিত সিদ্ধান্ত নিলাম ধানখেতে কভার করেই একা গুলি ছুড়ব। ধানখেত থেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের অবস্থান বারবার পরিবর্তন করে শত্রুদের দিকে গুলি ছুড়ি।’

‘কিছুক্ষণ থমকে থাকার পর বিপরীত দিক থেকে পাকবাহিনী হাজারো গুলি ছুড়তে থাকে। পাশ দিয়ে গুলি সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছিল। যেকোনো একটা শরীরে লাগতে পারত। এভাবে অনেকক্ষণ গুলি ছুড়লাম। পরে পেছনে আমবাগানে সরে এসে নিজ স্থানত্যাগ করলাম।’

এভাবে রণাঙ্গনের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ব ম নুরুল আলম। তিনি ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে কারও অনুপ্রেরণায় নয়, পাকিস্তানি শাসনামল থেকে এদেশের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

ট্রেনিং ও বিএলএফে অংশগ্রহণ

বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ব ম নুরুল আলম বলেন, একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে যাই। ১৯৬৭ সাল থেকে যে গণআন্দোলন দেশে এই গণআন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। খুলনাতে প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে এই প্রতিরোধযুদ্ধ এখানে শুরু হয়।

একপর্যায়ে বুঝতে পারি যে আমাদের অস্ত্র ও ট্রেনিং আবশ্যক। সেই তাগিদে একটা সিদ্ধান্ত হয় ভারতে চলে যাওয়ার। সেইভাবেই ভারতে চলে যায়। এখানে পরিবারের কাছ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক বিদায়ের প্রয়োজন হয়নি। পরিবার জানতো সাধারণভাবে আন্দোলন সংগ্রামে যেভাবে সম্পৃক্ততা ছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি একটি সশস্ত্রযুদ্ধ। ফলে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়াও ছিল না কারও মধ্যে, যোগ করেন তিনি।

১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, পরবর্তী পর্যায়ে অসহযোগ আন্দোলন—এইসবে যারা সম্পৃক্ত ছিল তারা প্রধানত ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়। এই রাজনৈতিক শক্তিটা যখন দেশে যুদ্ধ করতে করতে তাগিদ অনুভব করল যে ভারতে চলে যেতে হবে, তখন তারা ভারতে চলে যায়।

ভারতে তাদেরকে নিয়ে একটা স্পেশাল গেরিলা বাহিনী গঠিত হয়- বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)। এটা মুজিববাহিনী নামেও পরিচিত হয়। দেশে এটা চারটি বিভাগে ভাগ ছিল।

ভারতের হাফলং এবং গেরাগুন্ডু এই দুটি সেনাবাহিনী ক্যাম্পে ট্রেনিং হয়। প্রথম ব্যাচে দুটি ভাগ হয়ে যায়। কিছু লোককে গেরাগুন্ডুতে নেওয়া হয় আর কিছু লোককে হাফলং। কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে প্রধানত এই আয়োজনটা চলে।
  
ভারতে ট্রেনিং শেষ করে মুজিববাহিনীর প্রথম ব্যাচকে ভারতের চব্বিশপরগুনার ব্যারাকপুরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসা হয়। সেখানে কিছু দিন অবস্থানের পরে আমরা খুলনার যারা ছিলাম, তাদের সাতক্ষীরা বর্ডার দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট রাতে বৃষ্টি ও কাদাময় রাস্তা দিয়ে ঢুকে খুলনার দিকে একটা পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হই। যুদ্ধটা তখন চলছিল বর্ডার এলাকা দিয়ে। 

বাংলাদেশ সরকারের অধীনে একটা সেনাবাহিনী ছিল, তাদের ১১টা সেক্টর ছিল। এই বাহিনীর বাইরে স্পেশাল একটা গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্বে ছিল সিরাজুল আলম খান, ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ।

তাদের কাছে শেখ মুজিবুর রহমানের একটা মেসেজ ছিল; যার মাধ্যমে ভারতীয় সরকার স্পেশাল বাহিনীকে গঠন করে। উদ্দেশ্যটা ছিল দেশের সকল সেনাক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থান করে আশেপাশের লোকজনকে নিয়ে ট্রেনিং দিয়ে বাহিনী গঠন করে শত্রুর চলাচলের ওপরে আক্রমণ ও শক্তি সঞ্চয়ের মধ্যদিয়ে ঘাঁটি আক্রমণ করা।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ব ম নুরুল আলম

এইটা আমরা শুরু করি। আমাদের গ্রুপ সাতক্ষীরার মধ্যদিয়ে ঢুকে তালা থানার মাগুরাসহ কয়েকটি এলাকায় অবস্থান নেয়। সেখানে দুটো ক্যাম্প ছিল- একটা হচ্ছে পাটকেলঘাটা সেনাক্যাম্প অন্যটি কোপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প। এর মধ্যবর্তী স্থানে আমরা অবস্থান করি। সেখানে গোপনে রাতে ট্রেনিংয়ের আয়োজন করি। ট্রেনিংয়ের পর ওখানে বাহিনী গঠন করি। বাহিনী গঠনের পরে বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ শুরু করি। তখন খুলনা বিভাগের দায়িত্বে ছিল তোফায়েল আহমেদ। চারজন চারটি বিভাগের (সেক্টর) দায়িত্বে ছিলেন।  

মুক্তিযুদ্ধে অবদান

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শুরুতে বাংলাদেশ ব্যাংক, নগর ভবন, পিকচার প্যালেস মোড় এলাকায় ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ স্লোগান লিখে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অংশ নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ব ম নুরুল আলম। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত স্থানীয় পিটিআই মাঠে জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণদানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। ২৩ মার্চ পিটিআই মাঠে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন তিনি।

২৫ মার্চ খুলনা জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে প্রাথমিক প্রতিরোধযুদ্ধে অংশ নেন, ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের উদ্দেশ্যে খুলনাত্যাগ করেন। বিএলএফ-এর সদস্য হিসেবে আসামের হাফলং ট্রেনিং সেন্টারে বিশেষ গেরিলো ট্রেনিং গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট শেখ কামরুজ্জামান টুকু ও ইঞ্জিনিয়ার শেখ মুজিবুর রহমানের (পরবর্তীতে সংসদ সদস্য) নেতৃত্বে সাতক্ষীরা সীমান্ত পার হয়ে বিএলএফ লিডার বাহিনীর প্রথম ব্যাচে দেশে প্রবেশ করে তালা থানার বিভিন্ন গ্রামে গোপনে অবস্থান নেন।

মুজিববাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার মরহুম ইউনুস আলী ইনু ও আব্দুস সালাম মোড়লের নেতৃত্বে তালা থানার মাগুরা ক্যাম্পে অবস্থান করে স্থানীয় যুবকদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গড়ে তোলা এবং প্রশিক্ষণে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন নুরুল আলম।

তালা থানার মাগুরা, জেঠুয়া, পাইকগাছা থানার কপিলমুনি, বুধহাটা ও পাটাকেলঘাটায় ক্যাম্প স্থাপনসহ যুদ্ধে অংশ নেন। পাকিস্তান বাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমর যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর বটিয়াঘাটা থানার বারোআড়িয়ার যুদ্ধে আত্মঘাতী বাহিনীর দায়িত্ব পালন করেন। ৯নং সেক্টরে বৃহত্তর খুলনার মুজিববাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকুর নেতৃত্বে ১৭ ডিসেম্বর খুলনা শহর বিজয়ে অংশ নেন আ ব ম নুরুল আলম। 

মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক স্মৃতিচারণ

আ ব ম নুরুল আলম বলেন, আমাদের প্রথম কাজ ছিল ট্রেনিং দেওয়া। তালা থানার মাগুরা গ্রামে অবস্থান করছিলাম। সেখানে ইউনুস আলী, আব্দুল সালাম মোড়ল ছিলেন। সবাই মুজিববাহিনীর অন্তর্ভুক্ত। সেখানে স্থানীয় লোকজনের সাথে যোগাযোগের পর তারা ট্রেনিংয়ের আয়োজন করত। মাগুরা গ্রাম থেকে বাউখোলা একটি গ্রাম। ওখানে একটা ট্রেনিংয়ের আয়োজন করা হয়। লোকজন এসে আমাকে সেখানে নিয়ে যায়।

প্রথম পর্যায়ের ট্রেনিং দেওয়ার জন্য আমাকেই পাঠানো হয়। বাউখোলা-ইসলামকাঠী এলাকাজুড়ে অস্থায়ী ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল। ট্রেনিংয়ের শেষে একদিন ভোরে প্রচণ্ড গোলাগুলির আওয়াজ পেলাম। লোক পাঠিয়ে জানতে পারলাম বেলেডাঙ্গা আমাদের আরও একটি ক্যাম্প ছিল। পাটকেলঘাটার পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বেলেডাঙ্গার ক্যাম্পে আক্রমণ করে। ওটা শুনেই আমি বেরিয়ে পড়লাম। লোকজন জানতো বাউখোলার সামাদ মাস্টার নামে স্থানীয় একজন ছিল তার শ্যালক হিসেবেই আমি ওইখানে অবস্থান করছিলাম।

একটি নদীর এপারে বাউখোলার জায়গা এবং ওপারে মাগুরা। পরে অস্ত্রসহ সরঞ্জাম নিয়ে নদীর পাড়ে আসলে সেখানে একজন মাঝি বলল, ‘আপনি সরে যান, সামনে আক্রমণ হয়েছে।’ পাটকেলঘাটায় ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে আসা গ্রুপের ওপর আক্রমণ হয়েছে। আর পেছনে কোপিলমুনি থেকে দুই তিনশ’র মতো রাজাকার আসতেছে। এখন আমি একা। আমার কাছে একটি মার্টফোর (থ্রি নট থ্রি) রাইফেল, একটা গ্রেনেড, একটি বেয়োনেট। এই হচ্ছে আমার অস্ত্র।

সেখানে নদীর পাড় কিন্তু কোনো কভার নেই (উঁচু জায়গা)। আছে ধানখেত। ধানখেত কভার করেই আমি ওখানে তাদের আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম। নদীটা কার্ভ হয়ে গেছে, বেঁকে গেছে। ওরা ইচ্ছা করলে দুই সাইড দিয়ে এসে আমাকে ধরতে পারে। আমার চিন্তা ছিল যদি তাদের এগোতে দেওয়া হয়, তাহলে মাঝখানে মাগুরা টিমটা বেলেডাঙ্গার টিমকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে গেছে। ওরা তাহলে দুইদিকে আক্রমণের মধ্যে পড়ে যাবে। আমি তখন সেখানে থেকে কোনো কভার ছাড়াই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গুলি ছুড়লাম।

পানির মধ্যে ধানগাছ, এটাই কভার। প্রথম গুলি করার পড়ে তারা হকচুকিয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে হাজারো গুলি আমার ওপর দিয়ে আসতে থাকল। আমি সেখানে একটি টেকনিক অবলম্বন করে পানির মধ্যে স্থান পরিবর্তন করে এক একটা জায়গা থেকে গুলি করতে থাকলাম। কিছু সময় একটার পর একটা গুলি চালাতে থাকলাম। ওদের হাজার হাজার গুলি চারপাশ দিয়ে চলছে, যেকোনো একটা লেগেও যেতে পারে।

কিন্তু এই ঝুঁকিটা নিতে হয়েছে, অন্যদের বাঁচানোর একটা তাগিদ থেকে। ওইভাবে গুলি করতে করতে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ গজ পেছনে আমবাগান শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে আমবাগানে আসলাম। সেখানে বসে আরও কিছুক্ষণ গুলি চালালাম। ওরা আর আসেনি। মাগুরা পর্যন্ত এসে ওখানে আমাদের স্থানীয় একজন ট্রেন্ড আবুলকে ধরে ফেলে।

তার কাছে বুলেটের পেছনের অংশটা পেয়ে সাথে সাথে মেরে ফেলে। সন্ধ্যার পরে পার হয়ে দেখি যে সাংঘাতিক অবস্থা এবং গ্রামে প্রচার হয়েছে যে আমি গুলি করেছিলাম। ওদের জানা ছিল, আমরা মাগুরা ক্যাম্পে আছি, পরিকল্পনা ছিল সেখানে যাবে আগুন দিয়ে ক্যাম্প জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু সেটা করতে পারেনি। সামনা-সামনি যুদ্ধের এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা

বীর মুক্তিযোদ্ধা আ ব ম নুরুল আলম বলেন, আমাকে কুলপোতা ক্যাম্পের দায়িত্ব দিয়ে বসানো হয়। আমরা ওখানে যারা ছিলাম, একটা পরিকল্পনা করা হয় যে বুধহাটা ক্যাম্প আক্রমণ করব। আমি একজনকে সাথে নিয়ে ক্যাম্পটা ফাইনাল রেকি করতে যায়। গ্রামে নদী থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলের মতো। আমি খেয়াঘাটের দিকে যাচ্ছি। এরমধ্যে দেখা গেল যে, ১০/১২ জন রাজাকার ওপার থেকে উঠে আসছে। ওখান থেকে দু স্টেপ পেছনে এসে দৌড়ে ধানখেতে পড়লাম।

ধানখেতে পানির মধ্যদিয়ে চলতে থাকলাম। ওরা দৌড়ে এসে পেছন থেকে গুলি করতে থাকল। অনেক্ষণ চলার পরে অপরপ্রান্তে এসে উঠলাম। তখন কিছু বাড়ির লোকজনকে পরিচয় দিলাম। তারা একেবারে ঘরের মধ্যে নিয়ে চলে গেল ও খাওয়ালো। পরে ওরা (রাজাকার) আর এগোতে পারেনি। আমার ক্যাম্পের সবাই প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছে কিছু করা যায় কি না, কিন্তু সেটার আর দরকার হয়নি।

ওখানকার লোকজন আশ্রয় দিল, ওরা জানে যে এটা যদি প্রকাশ হয় তাহলে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর পরই কোপিলমুনি যুদ্ধের ডাক আসল, আমরা সেখানে চলে যাই। কোপিলমুনি যুদ্ধের মধ্যদিয়ে পাকবাহিনীর পতনের সময় চলে আসে। তখন সব এলাকা মুক্ত হওয়া শুরু হয়ে গেছে। ফলে আশ্রয় দেওয়া গ্রামবাসীর ওপর আক্রমণের সুযোগ পায়নি রাজাকাররা। এটা ছিল গণযুদ্ধ। রাজাকার আলবদর-ছাড়া মূলত এটা ছিল জনগণের যুদ্ধ।

অনুভূতি ও আক্ষেপ

১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় মাল্যগ্রহণ করেছিলাম, সেটি আমাদের কাছে এসে পরবর্তীতে বিলীন হয়ে যায়। যুদ্ধের যে ফলাফল সেটি মানুষ পায়নি। যুদ্ধের পরিণতি কিছু মানুষ পেয়েছে। কিন্তু মানুষের যে প্রাপ্তি সেটি হয়নি। বীর মুক্তিযোদ্ধারা একটা মানসিক বেদনা নিয়েই আছে। সম্প্রতি কিছু সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এই লোভে টাকাপয়সার বিনিময়ে কিছু মুক্তিযোদ্ধাও তৈরি হচ্ছে। এটা খুবই অমর্যাদারও ব্যাপার।

মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞাটা পার্লামেন্টে পাস হওয়া কোনো আইনে নেই। একটা আইন ছিল ২০০২ সালের মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলর সেখানেও মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সংজ্ঞা। শেখ মুজিবুর রহমান থাকা অবস্থায় ১৯৭৩ সালে একটা আইন আছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের। এটাও মুক্তিযোদ্ধার সাধারণ সংজ্ঞা নয়। এই দুটি আইনই কেবল আছে। কিন্তু পার্লামেন্টে পাস হওয়া মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ কোনো সংজ্ঞা এই ৫০ বছরে আমাদের শাসকরা করেননি।

ছাত্রজীবন ও বর্তমান অবস্থা

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত আ ব ম নুরুল আলম। খুলনা মহানগরীর ৫নং মিয়াপাড়ায় স্থায়ীভাবে বসবাস করেন তিনি। তার স্ত্রী সাবেক শিক্ষিকা নাসিমা আক্তার এবং একমাত্র মেয়ে নূসরাত জাহান। তিনি খুলনার নজরুল নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেন। মৃত তারিফ উল্লাহ তার পিতা এবং মৃত শামছুন নেসা খাতুন তার মা।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খুলনা জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার সরদার মাহাবুবার রহমান

তার পারিবারিক নাম খোকন। সাতক্ষীরা মহকুমার শ্যামনগর থানার নকিপুর হরিচরণ বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করেন তিনি। ১৯৬৯ সালে বিজ্ঞান বিভাগে খুলনাস্থ সেন্ট যোসেফ হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭২ সালে বিএল কলেজ থেকে আইএসসি, ১৯৭৬ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে বিএ ও ১৯৮১ সালে খুলনা সিটি ল’কলেজ থেকে এলএলবি পাস করেন তিনি।

১৯৬৭ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে তার হাতে খড়ি। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অধীনে ছাত্রলীগের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন। ১৯৭০ সালে দৌলতপুর সরকারি বিএল কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের মনোনয়নে সর্বাধিক ভোটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন তিনি।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩-৭৪ সালে জাসদ সমর্থিত ছাত্রলীগের খুলনা জেলা শাখার সম্পাদক, ’৭৪-৭৫ সালে জেলা শাখার সভাপতি, ১৯৭৮ সালে জাসদের নগর শাখার সভাপতি একইসাথে জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮০ সালে জাসদ দ্বিধাবিভক্তির পর তিনি সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাথে সম্পৃক্ত হন। রাজনৈতিক কারণে ১৯৭৪ সালে গ্রেফতার হন। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পান। তিনি আইন পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। 

সরকারের প্রাপ্তি স্বীকার

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের খুলনা জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার সরদার মাহাবুবার রহমান বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। অনেকে চাকরি রত ছিল, কেউ ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। তারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা অনুযায়ী সাধারণ জনগণ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ বাহিনীসহ যারা প্রশিক্ষণরত ছিল তারাও একত্র হয়ে এই জনযুদ্ধে অংশ নেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার আমাদের কিছু দেবে’ সেই আশা করে আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাইনি। তবে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা, বাসস্থানসহ ভালো-মন্দ বিষয় গভীরভাবে খোঁজ-খবর রাখেন। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভাতা বাড়িয়ে বর্তমানে আমরা পাচ্ছি ২০ হাজার টাকা।

তার দেওয়া তথ্যমতে, বটিয়াঘাটায় ১৭৬ জন, দাকোপে ৭০, দৌলতপুরে ৮০, দিঘলিয়ায় ৭৭, ডুমুরিয়ায় ১০২, খালিশপুরে ৫৬, খানাজাহান আলী থানার ৬৯, সদরের ১৬৩, কয়রার ১১৮, পাইকগাছার ২৫৪, ফুলতলার ৭৩, রূপসার ১২৮, সোনাডাঙ্গার ১২৪ ও তেরখাদার ৪৬৭ জন ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।

এমএসআর