বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন

‘আকাশ থেকে পাকবাহিনীর বিমান থেকে আক্রমণ। তাদের কাছে প্রায় হার মানা অবস্থা। চারদিকে শুধু পানি আর পানি থইথই করছে। আমাদের অবস্থান ছিল পাটখেত, আখখেত ও পানির মধ্যে। তাদের প্রতিহত করতে চারদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ করি। তাদের অর্ধশতাধিক মানুষকে নিহত করতে সক্ষম হই।’

‘আমাদের ১০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং বহু যোদ্ধা আহত হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। একাত্তরের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে আমরা সহযোদ্ধা শহীদদের সমাহিত করি ছলিম উদ্দিন বিশ্বাস চেয়ারম্যানের জমিতে।’

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর কথা বলেছেন কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন।

১৯৭১ সালে মোশাররফ হোসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। তিনি ১৯৫৪ সালের পহেলা জানুয়ারি কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হাটশ হরিপুর ইউনিয়নেট শালদাহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৃত লয়েন বেপারী ও মায়ের নাম মৃত ফতিজান নেছা।  

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার নেপথ্যের গল্প

মোশাররফ হোসেন অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। নির্বাচনের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান কুষ্টিয়ায় জনসভা করতে এসেছিলেন। সেই জনসভায় উপস্থিত ছিলেন মোশাররফ। তারপর থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন তিনি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাঙালি জাতির মুক্তির আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে দারাজ কণ্ঠে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন কলেজপড়ুয়া মোশাররফ হোসেন।

কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ইন্টামিডিয়েট (বিজ্ঞান বিভাগ) দ্বিতীয় বর্ষে পড়াকালীন পরিবারের কাউকে কিছু না বলে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে যান মোশাররফ হোসেন। এরপর তার গ্রামের কয়েকজন বন্ধু মানুষকে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান। তারপর তাদেরকে সাথে নিয়ে সারাদিন ধরে হেঁটে বাংলাদেশের সীমানা পাড়ি দিয়ে ভারতে পৌঁছান।

তারা যে সময় ভারতে যান, সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের কোনো ব্যাবস্থা চালু হয়নি। ট্রেনিং শুরুর আগ পর্যন্ত তারা কলকাতাসহ বিভিন্ন স্থানে থেকেছেন। তারপর ডোমপুকুর নামক জায়গায় একটি ইয়ুথ ট্রেনিং ক্যাম্প তৈরি হয়। কিছুদিন ট্রেনিং করার পর উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট হয়ে সেখান থেকে চলে যান মোশাররফ। তখন তার বয়স ছিল ২২ বছর।

কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং

মুজিব বাহিনী বা বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ) রিক্রুট হয়ে মোশাররফসহ ১২০ জন একটি বিমানে করে ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহারানপুর জেলায় যান। সেখান থেকে ভারতের সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে চাক্রাতা জেলার মহকুমার তানদুয়ায় মিলিটারি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করেন। সেখানে ৫০ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর বিমানে করে দমদম বিমানবন্দরে যান তারা। সেখান থেকে সেনাবাহিনী ট্রাকে করে ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। সেখানে এক সপ্তাহ ট্রেনিংয়ের পর বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে মোশাররফদের প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধা মোশাররফ হোসেন বলেন, আমি যখন উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য রিক্রুট হই, তখন ছাত্রলীগের নেতারা মুজিব বাহিনী গঠন করেছিল। ছাত্রলীগের নেতা বারী ভাই আমাদের রিক্রুট করেছিলেন। তারপর আমরা দেরাদুনে যাই। সেখানে গিয়ে তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি, আ স ম আবদুর রব এই চার বড় নেতা মিলে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।

আমাদের প্রথম ব্যাচে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করা হাসানুল হক ইনু বাংলাদেশের ইন্সট্রাক্টর হয়ে আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। নামকরা জেনারেল ওবান মাঝেমধ্যে এসে প্রশিক্ষণ দিতেন, বক্তব্য শোনাতেন। মেজর মালহুতরা ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা ডোগরা আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সেখানে অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সব ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল।

সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, এসএমজি, এসএলআর, এক্সক্লুসিভ, এন্টি ট্যাংক মাইন, অ্যান্টি পারসোনাল মাইন, বোবিটাপসহ বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ আমাদের দেয়া হয়েছিল। কীভাবে ব্রিজ উড়িয়ে দিতে হয়, কীভাবে বাড়ি ধ্বংস করতে হয়, রেললাইন উড়িয়ে দিতে হয়। সবকিছু ট্রেনিংয়ে শেখানো হয়। টিমের প্রায় সবাই শিক্ষিত ছিল। সবচেয়ে কম ছিল এসএসসি পাস। দু-একজন ছিল অল্প শিক্ষিত।

মোশাররফের যুদ্ধক্ষেত্র ও সেক্টর

মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টর ছিল। কুষ্টিয়া ছিল ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে। সেখানে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন এমএ মুনজুর। কিন্তু মোশাররফ হোসেন ছিলেন মুজিব বাহিনীর (বিএলএফ) সদস্য। উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন সেক্টরে যোগ দেন তিনি। সেখানে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তার নেতৃত্বে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গন সেক্টরের যোদ্ধারা যুদ্ধ করতেন। কুষ্টিয়া জেলার কমান্ডার ছিলেন জিয়াউল বারী নোমান। মোশাররফ হোসেনের গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন এসএম আব্দুল মান্নান। তিনি আলামপুরে যুদ্ধ করেছেন মান্নানের নেতৃত্বে এবং বংশীতলায় যুদ্ধ করেছেন জিয়াউল বারীর নেতৃত্বে।

যুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতি

ভারতে প্রশিক্ষণ শেষ করে বাংলাদেশে আসার পথে সশরীরে অনেকগুলো যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হয়। ১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার আলমপুরে পুরাতন জমিদারবাড়িতে যখন আমরা অবস্থান করি, তখন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য ও তাদের দোসররা আমাদের অবস্থান আগে থেকেই জেনে ফেলে। তারা আক্রমণ করার আগেই আমরা সবাই সু-সংগঠিত হয়ে তাদের আক্রমণ করে প্রতিহত করি।

সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে নিহত ও আহত হয়। যুদ্ধ শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেখান থেকে পাশের গ্রামে গিয়ে থাকি। পরেরদিন আমাদের গন্তব্য ছিল দুর্বাচারা গ্রামের ছলিম উদ্দিন বিশ্বাস চেয়ারম্যানের বাড়ি।

সেখানে আগে থেকে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কুষ্টিয়ার অন্যতম নেতা জিয়াউল বারী নোমান, আবুল কাশেম, জাহিদ হোসেন জাফর। আমরা দুর্বাচারায় পৌঁছানোর পরেই আমাদের সমাবেশের খবরটা পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়।

৫ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় দিকে তারা আক্রমণ করার জন্য আমাদের দিকে অগ্রসর হয়। সেই খবর আমরা আগেই জানতে পারি। আমরা বংশীতলা তিন রাস্তার মোড়ে তাদের আক্রমণ করি। প্রায় চার ঘণ্টা যুদ্ধ করে তাদের প্রতিরোধ করি। তখন আমাদের গোলাবারুদ ফোরানোর অবস্থা। যুদ্ধ হতে হতে আমরা দেখতে পারি বিত্তিপাড়া এবং ভাদালিয়া টেক্সটাইল মিলস থেকে মর্টার সেল মেরে আক্রমণ করা শুরু করে।

আগে থেকে সেখানে তাদের ক্যাম্প তৈরি করা ছিল। আকাশ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিমান থেকে আক্রমণ করা হয়। তখন তাদের কাছে আমাদের প্রায় হার মানা অবস্থা হয়। তখন চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। আমরা তাদেরকে প্রতিহত করতে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি এবং তাদের আক্রমণ করি।

আমরা তাদের অর্ধশতাধিক মানুষকে নিহত করতে সক্ষম হই। আমাদের ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হয়ে পালিয়ে যায়। ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে আমরা সহযোদ্ধা শহীদদের সমাহিত করি ছলিম উদ্দিন বিশ্বাস চেয়ারম্যানের জমিতে। ওইদিন রাতে নদী পার হয়ে পাশের একটি জমিদার বাড়িতে অবস্থান করি।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীরা আমাদের এসব এলাকা চিনত না, ভাষাও বুঝত না। তাছাড়া তাদের এলাকার অল্প কিছু মানুষছাড়া কেউ সহযোগিতা করত না। অপরদিকে আমাদের সবকিছু পরিচিত এবং সবাই আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করত। এজন্য যুদ্ধে তাদের পরাজিত করা আমাদের জন্য অনেকটা সহজ হয়। মুক্তিসেনারা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ছোট-বড় ২২ যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়াকে মুক্ত করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক স্মৃতি

মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে বেশি রোমহর্ষক যুদ্ধ হয়েছিল বংশীতলাযুদ্ধে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন ট্রাকে করে তাদের লাশ তুলে নিয়ে যায়, তখন রক্তে লাল হয়ে যেত রাস্তা। আমাদের সহযোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গায় শহীদ হয়েছিলেন। কেউ পানির মধ্যে, কেউ ফসলের মাঠে,  কেউ রাস্তার পাশে। বংশীতলার মতো এত বড় যুদ্ধ আমি আমার জীবনে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ মাসজুড়েই কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর তুমুল লড়াই চলে। বংশীতলা, চৌড়হাস ও বিত্তিপাড়াসহ কুষ্টিয়ার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাক হানাদাররা ৬০ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আর ২ হাজার মা-বোনের ওপর চালায় নৃশংস নির্যাতন।

১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনীর সম্মুখযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর অনেক সদস্য নিহত হন। ধ্বংস হয় কয়েকটি ট্যাংক ও একটি বিমান। তবে মিত্রবাহিনীর পাল্টা হামলায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পরাজিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘কুষ্টিয়া চৌড়হাস যুদ্ধ’ একটি গুরত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। এই যুদ্ধে নিহত শতাধিক সৈন্যদের মধ্যে বাংলাদেশের সহায়তাকারী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতেরই আধিকাংশ সৈন্য নিহত হয়। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই কুষ্টিয়া প্রবেশ করে মিত্রবাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের সেই রোমহর্ষক স্মৃতিচারণ করে তিনি আরও বলেন, চৌড়হাসে মোড়ে যেখানে একটি ট্যাংক ও একটি বিমান স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। সেদিন সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিমিত্র বাহিনীর একদম হাতাহাতি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি বাহিনী চৌড়হাস ব্রিজের নিচে বোমা সেট করে তারা সেখান থেকে সরে যায়। কিন্তু আমাদের মুক্তি এবং মিত্র বাহিনী মনে করে যে পাকিস্তানি বাহিনী নেই। কিন্তু তারা বোমা ফিট করে গা ঢাকা দিয়ে পাশেই ছিল।

তখন মুক্তিমিত্র বাহিনী ক্যানেল পার হয়ে শহরের এপারে আসে, ঠিক সেই সময় তারা ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়। তখন সেখানে কী যুদ্ধ যে হয়, তা চোখে না দেখলে বোঝা যাবে না। যুদ্ধ শেষে আমরা দেখতে পাই। একটি ট্যাংক ও একটি বিমান পড়ে আছে এবং আমাদের মিত্রবাহিনীর ৫০-৬০ বা তারও বেশি শহীদ লাশ আমরা দেখতে পাই। মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়ার মতো এমন রোমহর্ষক যুদ্ধ দেশে হয়েছিল কি না সেটা আমার জানা নেই, এটাই সবচেয়ে বেশি রোমহষর্ক যুদ্ধ। আমার অভিজ্ঞতায় এমন রোমহর্ষক যুদ্ধের কথা শুনিনি।

কুষ্টিয়ায় একবার যুদ্ধ হয়েছে প্রতিরোধযুদ্ধ। সেই প্রতিরোধযুদ্ধে ৩০ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে কুষ্টিয়ায় আসে এবং কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন, ওয়ারলেস অফিস ও থানা দখল করে নেয়। কুষ্টিয়া জেলা হাইস্কুলে তারা ক্যাম্প তৈরি করে। তখন চুয়াডাঙ্গায় আমাদের পিপিআর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্‌স) অফিস ছিল। সেখানে দায়িত্বে ছিলেন ইপিআর-এর মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। তখন বৃহত্তর কুষ্টিয়ার অধীনে থাকা মেহেরপুরের এইচডিও ছিলেন তৌফিক এলাহী চৌধুরী।

তারা দুজন দৌলতপুর, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গাসহ বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ করে ইপিআর সদস্যদের সংগ্রহ করে এবং তাদের একজায়গায় করে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বারখাদা-ত্রিমোহনী এলাকায় ক্যাম্প তৈরি করেন। তাছাড়া পোড়াদহ এলাকায় আমবাগানে একটি ক্যাম্প তৈরি করে। তারপর ৩০ মার্চ ভোর চারটায় পুলিশ লাইন, ওয়ারলেস অফিস, থানা ও জেলা স্কুলে আমরা বাঙালিরা একযোগে আক্রমণ করি। এ যুদ্ধে নিহত হয় অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা। রাতের আঁধারে পাকিস্তানি বাহিনী ১ এপ্রিল কুষ্টিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়।

ঢোল-ডাগর, ঢাল, বল্লম, সড়কি, বন্দুকসহ বাঙালীদের যার যা ছিল তাই নিয়ে জনগণ একত্র হয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে প্রতিহত করি। কুষ্টিয়া থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ডেলটা টু নামে একটি কোম্পানি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। তারা কেউ কুষ্টিয়া থেকে প্রাণে বেঁচে যেতে পারেনি। যে কয়জন পালিয়ে যেতে চেয়েছিল তারা গ্রাম-গঞ্জের রাস্তাঘাট  ও পাড়া-মহল্লায় বাঙালিদের ঢাল, বল্লম, সরকি, লাঠির আক্রমণে নিহত হয়েছিল।

একজনও জীবন নিয়ে যশোর ক্যান্টনমেন্টে যেতে পারিনি। এরপর ১১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া হানাদারমুক্ত হয়ে যায়। কুষ্টিয়ার মাটিতে পতপত করে বাংলাদেশের লাল-সবুজ রঙের পতাকা উড়তে থাকে। আমরা ১৬ তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করি। ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স উদ্যানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। 

সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ

আমরা যখন যুদ্ধে যাই, ডোমপুকুর ট্রেনিং ক্যাম্পে ট্রেনিং করি তখন সেখানে বেশিরভাগ ছিলাম কুষ্টিয়ার। সেখানে ছিল আমার পরিচিত অনেক বন্ধু। আমি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে পড়তাম, সেই কারণে বেশিরভাগই আমার পরিচিত ছিল। যারা অপরিচিত ছিল, একসাথে থাকতে থাকতে তাদের সাথেও ভালো পরিচয় হয়ে যায়। আমরা সবাই মিলে খুব আনন্দে থাকতাম। যখন আমরা ইয়ুথ ক্যাম্প ও উচ্চতর প্রশিক্ষণে ছিলাম। তখন আমরা সবাই খুব হাসি-তামাশার মধ্যে সময় পার করেছিলাম। তখন আমাদের দুঃখ কষ্ট বলতে কোন কিছু ছিল না।

এদেশ স্বাধীন হবে কি না, এ ধরনের চিন্তা-ভাবনাও আমাদের মধ্যে ছিল না। যদি দেশ স্বাধীন না হয়, তাহলে আমাদের কী হবে? এ ধরনের চিন্তাও আমাদের মধ্যে ছিল না।

আমরা সবসময়ই গান-বাজনা আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে থাকতাম। কেউ কেউ থালা, ঘটি, বাটি বাজিয়ে গান গাইতো। সেই সময়ে পেছনের কোনো চিন্তাও আমাদের মাঝে ছিল না। আমাদের একটাই টার্গেট ছিল যে, আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধ করতে এসেছি, দেশকে স্বাধীন করেই ছাড়ব। হয় মরব, না হলে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করব।

কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সাবেক কমান্ডার মোশাররফ হোসেন। তিনি কলেজ ছাত্র থাকা অবস্থায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার মতো কুষ্টিয়ার দামাল ছেলেরা লড়েছিল চিরশক্র পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে। মা, মাটি ও দেশের মানুষকে মুক্ত করতে জীবনের মায়াত্যাগ করে যুদ্ধ করেছিল।

তিনি বলেন, বংশীতলায় যখন যুদ্ধ চলতে থাকে তখন আমিসহ আমাদের বহু মুক্তিযোদ্ধা আহত হয়। বেশি আহত হয়েছিল আমার সহযোদ্ধা ও আমার প্রতিবেশী আব্দুল খালেক। তার পায়ে চায়না রাইফেলের গুলি লাগে এবং একপাশে লেগে অন্যপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। আর আমার শরীরের ভেতর মর্টার সেলের টুকরো লেগে আহত হই। আমাদের ভেতরে অনেকে আহত অবস্থায় শরীরের যন্ত্রণা নিয়ে যুদ্ধ করেছিল। আমাদের সবারই খুব জ্বালা যন্ত্রণা এবং কষ্ট ছিল। তবুও যুদ্ধ করা থামায়নি। সে সময় যারা গ্রামের ডাক্তার ছিল তারা আমাদের নানাভাবে চিকিৎসা দিয়েছে। খুব বেশি আহতদেরকে ভারতের ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হতো। 

বংশীতলা যুদ্ধের পরে আমাদের জেলার কমান্ডার সিদ্ধান্ত নেন যে, এত অল্প অস্ত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তাই উনি আমাদেরকে নির্দেশ দেন, তোমরা সবাই আমাদের কাছে অস্ত্র জমা দাও এবং তোমরা সবাই আবারও ভারতে ফিরে যাও। সেখানে গিয়ে তাদের কাছে দাবি করো যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে শক্তিশালী ও বেশি বেশি অস্ত্র প্রয়োজন।

তখন আমি অস্ত্র জমা দিয়ে ঝাউদিয়া যায়। সেখানে বন্ধু তাহের উদ্দিনের সাথে দেখা হয়। কুষ্টিয়া হাইস্কুলে আমরা একসাথে লেখাপড়া করতাম। দুপুরে তার বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করি। তখন আমার সাথে ছিল কয়া ইউনিয়নের আতিয়ার।

আমি আতিয়ার ও তাহেরকে বললাম যে, প্রায় ৭-৮ মাস আগে বাড়ি থেকে যুদ্ধে এসেছি। আসার সময় মা-বাবাসহ কাউকে কিছু বলা হয়নি। বাড়িতে গিয়ে সবার সাথে দেখা করে ভারতে গেলে কেমন হয়? তারা বলল যাও।

তখন আমি আইলচারা এলাকার একজনের নৌকায় চড়ে ঝাউদিয়া থেকে আইলচারায় যায় এবং রাতে নৌকার মালিকের বাড়ি থাকি। তখন চারপাশে শুধু পানি আর পানি। সকালে যাই নাজিরপুর। সেখানে একটি বটগাছ তলায় সারাদিন বসে থাকি। আমাদের উদ্দেশ্য আত্মীয় সিরাজের সাথে দেখা করা। কিন্তু যে বাড়িতে সিরাজ থাকে সে বাড়িতে গেলে তারা বলে সিরাজ নেই, তাকে আমরা চিনি না। তারা ভয় পাচ্ছিল, তারা মনে করছিল আমরা সিরাজকে ধরতে গিয়েছি।

তারপর সারাদিন ওই বটগাছের নিচে না খেয়ে আমরা দুজন বসে।  আমরা দুজনই চরম ক্ষুধার্ত। বিকেলবেলার দিকে এক বৃদ্ধা মহিলা আমাদের কাছে এসে বলেন, বাবা তোমরা সারাদিন এই গাছের নিচে বসে আছ। তোমরা কি কিছু খেয়েছ? সারাদিন না খাওয়ার কথা শুনে আমাদেরকে তিনি তার বাড়িতে নিয়ে যান এবং পান্তা ভাত খেতে দেন। যুদ্ধের সময় পদে পদে মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি।মানুষের সহযোগিতা ছাড়া এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব হতো না। মানুষ খেতে দিয়েছে, বাড়িতে থাকতে দিয়েছে, নৌকা দিয়েছে।

তাদের সহযোগিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। পরের দিন রাতের অন্ধকারে হরিপুরে আমার বাড়িতে গেলাম। তখন বাড়ির সবাই রাতের খাবার খাচ্ছিল। আমাকে দেখে সবার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মা-বাবার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে লাগল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করল তারা। চুপচাপ সেদিন রাতে বাড়িতে ছিলাম। পরেরদিন এক আত্মীয়র বাড়িতে এবং তার পরের দিনে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলাম।

প্রাপ্তি স্বীকার ও মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যথেষ্ট করেছেন। তিনি গৃহহীন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য গৃহ নির্মাণের ব্যবস্থা করছেন। ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পরে উনিই প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া শুরু করেন। পরে বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে ২০০ টাকা বাড়িয়ে ৫০০ টাকা করেন। আমাদের জন্য যা করেছেন, শেখ হাসিনাই করেছেন। তিনি এখন প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধাকে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে সম্মানীভাতা দিচ্ছেন।

বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধারা সরকারের কাছ থেকে যে ভাতা পাচ্ছে, তা দিয়ে ভালোভাবেই বেঁচে আছেন। কুষ্টিয়া জেলায় প্রায় ৩ হাজার ২০০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা। এরমধ্যে ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। মুক্তিযোদ্ধারা বেশিরভাগই বৃদ্ধ ও অসুস্থ। চিকিৎসার পেছনে অনেক টাকা খরচ হয়। তবে ভাতার টাকা দিয়ে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধারা ভালোই আছেন, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সবাই ভালো আছে। 

মোশাররফ হোসেন ৭ ভাই-বোনের মধ্যে তৃতীয়। বর্তমানে তিনি স্ত্রী ও চার ছেলে-মেয়েসহ কুষ্টিয়া শহরের চৌড়হাস এলাকার উপজেলা সড়কে বসবাস করেন। মোশাররফ হোসেন কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে বিএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।

পড়ালেখা শেষে তিনি ব্যবসায়ী পেশায় যুক্ত ছিলেন। ২০১১ সালে ব্যবসা ছেড়ে দেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম ইউপি নির্বাচনে মেম্বার হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত রয়েছেন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার সাবেক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন মোশাররফ হোসেন।

এমএসআর