পঞ্চগড়ের একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম

দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম (৬৭)। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বাবার অনুপ্রেরণা ও বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে লড়াই করতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ তাকে সবচেয়ে বেশি উজ্জীবিত করেছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিনিধির কাছে বীরত্বগাথা সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার তিরনইহাট ইউনিয়নের মুনিগছ গ্রামের মৃত আব্দুর রহিমের মেয়ে রোকেয়া বেগম। বর্তমানে তিনি জেলা শহরের মিলগেট এলাকায় বসবাস করেন। তার বাবা আব্দুর রহিম ছিলেন একজন দর্জি। আর মা ছমিরন নেছা ছিলেন গৃহিণী। পরিবারে ৫ সন্তানের মধ্যে রোকেয়া বেগম ছিলেন তৃতীয় আর বোনদের মধ্যে বড়।

রোকেয়া বেগমের মেজো ভাই নাসিদুল ইসলাম তরুণ বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হন। সবাই ভেবে নেন নাসিদুল শহিদ হয়েছেন। এ শোকে কাতর হয়ে পড়ে পুরো পরিবার। ভাইকে হারিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার স্বপ্ন জাগে রোকেয়ার মনে। তার আগে রেডিওতে শোনা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণও রোকেয়া বেগমকে উদ্বেলিত করে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে গ্রামের ছেলেরা মিটিং-মিছিল করে। তারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মেজো ভাই নাসিদুল ইসলামসহ গ্রামের অনেকেই যুদ্ধে চলে যায়। এরপর থেকে ভাইয়ের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ছেলে হারানোর শোকে আমার মা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। তখনও বাবার মনোবল ছিল দৃঢ়। বাবাই আমাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন। ১৯৭১ সালের ৭ এপ্রিল বড় ভাই আব্বাস আলীর সহযোগিতায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে বাড়ি থেকে বের হই।

তিনি জানান, সকল প্রস্তুতি শেষ করে যখন পরিবারের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার পালা, তখন আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের অনেক বাঁকা কথা আর বাধার মুখে পড়েন তিনি। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। অনেকেই নানাভাবে কটূক্তি করেন। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি পিছু পা হননি। বাড়ির আঙিনা ছেড়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চলে যান রণাঙ্গনে।

প্রথমে রোকেয়া বেগম ভারতের ভুষপিটা ক্যাম্পের শরণার্থী শিবিরে যান। সেখানে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া ছোট ছোট শিশুদের তিনি পাঠদান করেন। হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে ডায়রিয়া, খোসপাঁচড়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ সময় রোকেয়া বেগম চিকিৎসকদের কাছে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দেন। পরে তিনি ভুষপিটা থেকে কান্তায়ভিটা ক্যাম্পে অবস্থান করেন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় অস্থায়ী ১০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে সেবিকা নিয়োগের খবর পেয়ে ছুটে আসেন রোকেয়া বেগম। বয়স কম হওয়ার কারণে প্রথমে তিনি বাদ পড়েন। পরে অনেক অনুরোধে তিনি সেবিকা হিসেবে নিয়োগ পান।

রোকেয়া বেগম বলেন, ভ্রাম্যমাণ হাসপাতালের সেবিকা হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তেঁতুলিয়ার পর পঞ্চগড়ে যাই। এরপর ঠাকুরগাঁও টিবি হাসপাতাল ও ইপিআই হেডকোয়ার্টার হাসপাতালে আহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী বাঙালিদের সেবা দিয়েছি। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে কখনো ক্যাম্পে কখনো হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবাদানের সুযোগ হয়।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ৬ নং সেক্টরের কমান্ডার এম কে বাশার, ৬ নং সেক্টরের বেসামরিক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও ডা. আতিয়ার রহমানের অধীনে থেকে তেঁতুলিয়ায় সেবিকা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন রোকেয়া বেগম। যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তুলতেন তিনি। 

ফেলে আসা সেই লোমহর্ষক দিনের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেননি রোকেয়া। কত কষ্ট, কত বেদনা, কত নির্মমতা দেখেছেন তিনি। স্বাধীনতা পাগল মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে কোনো কুণ্ঠাবোধ ছিল না তার। 

রোকেয়া বলেন, শুধু চিকিৎসাসেবা দেইনি। কোনো কোনো দিন মুক্তিবাহিনীকে রান্না করে খাইয়েছি। অস্ত্র হাতে সম্মুখযুদ্ধে যেতে পারিনি। কিন্তু জীবন বাজি রেখে সবসময় মুক্তিবাহিনীর পাশে ছিলাম। ২৯ নভেম্বর পঞ্চগড় হানাদারমুক্ত হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে আসি। 

যে ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়ার খবর কাঁদিয়েছিল ছিল রোকেয়ার পরিবারকে, সেই মেজো ভাই নাসিদুল ইসলাম দেশ স্বাধীনের পর বাড়িতে ফিরে আসেন। সেদিন পরিবারের সবাই হতবাক হয়েছিল নাসিদুলের ফিরে আসায়। পঞ্চগড় সুগার মিলে কিছু দিন চাকরির পর ক্যানসার আক্রান্ত হয়ে মারা যান নাসিদুল ইসলাম।

বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম বলেন, আমি এখন কোন কাজ করতে পারি না। আমি বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ভাতা দিচ্ছেন। আমি যে ভাতা পাচ্ছি, তা দিয়ে আমার চিকিৎসা, সংসারের খরচসহ যাবতীয় কাজ চলছে। সরকার যদি আমাকে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিতেন তাহলে শেষ বয়সে আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।

রোকেয়া বেগম দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন সুগার মিলে। বর্তমানে চাকরি থেকে অবসরে গেলেও এখনো অবসর ভাতার টাকা পাননি। তবে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়েই চলছে ৬৭ বছর বয়সী রোকেয়ার জীবন। 

রোকেয়া বলেন, পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকার থেকে যে ভাতা পাচ্ছি, এটাই এখন ভালো থাকার মাধ্যম। হাতে এখন অবসর সময়। এ কারণে সময় পেলেই বা বিশেষ কোনো জাতীয় দিবসের মাসে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে যাই। সেখানে নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে ভালো লাগে।

রোকেয়া সময় পেলেই নিজ খরচে জাতীয় পতাকা ও ব্যাজ তৈরি করেন। সেগুলো তিনি শিক্ষার্থীদের উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন। এবারও বিজয়ের মাস ঘিরে তিনি সংগ্রহ করেছেন জাতীয় পতাকা। ১ ডিসেম্বর থেকে তিনি জেলার স্কুলগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে শোনাচ্ছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় দিনগুলোর কথা।

পঞ্চগড় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন প্রধান বলেন, ১৯৭১ সালে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। যুদ্ধ করে নিজ জন্মভূমিকে স্বাধীন করেছি। আমাদের পঞ্চগড় মুক্ত হয় ২৯ নভেম্বর। সেই দিনটি আমাদের কাছে যেমন আনন্দের আবার কষ্টের। অনেক সহযোদ্ধা হারিয়েছি আমরা। আমাদের জেলার একমাত্র নারী বীর মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া বেগম। তিনি মুক্তিযুদ্ধকালে একজন সেবিকা হয়ে যুদ্ধাহত, আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিতেন। চিকিৎসাসেবা  দিয়ে কষ্টের দিনে তিনি পাশে ছিলেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলাউদ্দিন প্রধান আরও বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্থাপনা, বধ্যভূমি ও গণকবরসমূহ সংরক্ষণ করা জরুরি। এখনও যুদ্ধের সময় ব্যবহৃত জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। সেসব সংরক্ষণ করতে পারলে আমাদের নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু, জানতে, দেখতে ও শিখতে পারবে।
 
আরএআর