‘আমার বাবা-মা পেশায় শিক্ষক ছিলেন। তারা আওয়ামী লীগ করতেন। তারাও চাইতেন আমি দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ করি। সুদূর ঢাকা থেকে আট দিন পায়ে হেঁটে কুড়িগ্রামে আসি। এদিকে সারা দেশের পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে উদ্বুদ্ধ হই। মা-বাবার কাছ থেকে দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য।’

১৯৭১ সালে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যারা দেশ বাঁচাতে স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাদের মধ্যে ছিলেন কুড়িগ্রাম জেলার ১৬ বছর বয়সী এক সাহসী কিশোর আব্দুল হাই সরকার। অভাবের তাড়নায় ঘর ছেড়ে কর্মের সন্ধানে ঢাকা গেলেও দেশকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে ফিরে আসেন এলাকায়। অতঃপর যোগ দেন যুদ্ধের ময়দানে।

ঢাকা পোস্টকে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতিমাখা কথাগুলো জানিয়েছেন আব্দুল হাই। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে ঢাকা পোস্টের নিয়মিত আয়োজনে আজ থাকছে এই গেরিলা যোদ্ধার জীবনকাহিনি।

বীর প্রতীক আব্দুল হাই সরকার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে অনুপ্রাণিত হতে থাকি। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল দেশে যখন কারফিউ জারি হয়, তখন আমি ঢাকা থেকে বিভিন্ন রেললাইনের পথ ধরে হেঁটে এসেছি কুড়িগ্রামে। এরপর ভূরুঙ্গামারীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। জেলার সোনাহাট ব্রিজ, ফুলবাড়ী, নাগেশ্বরী এসব এলাকায় সেকশন কমান্ডার ও প্লাটুন কমান্ডার হিসেবে বিভিন্ন অপারেশনে যুদ্ধ করেছি।

ভূরুঙ্গামারী কলেজে মাঠে আমি প্রথম প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সে সময় ক্যাপ্টেন নেওয়াজেস, পরবর্তীতে মেজর, তার নেতৃত্বে ইপিআরদের সঙ্গে এসএমজি, এলএমজি ও রাইফেল চালনা শিখি। সেখান থেকে বাছাই করে পরবর্তীতে উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের মুজিব ক্যাম্পে পাঠানো হয় আমাদের। সেই ক্যাম্পে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামাল। তার সঙ্গে ১৫ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দ্বিতীয় ব্যাচে ছিলাম। আমাদের এফএম নম্বর ছিল ৫০৩৪। সেখান থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে আবারও যুদ্ধের জন্য কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করি।

মুক্তিযুদ্ধে অবস্থান ও সেক্টর
আমার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে ঢাকা থেকে। আমি যখন ১৯৬৯ সালে ঢাকায় চাকরির সুবাদে কর্মরত ছিলাম, তখন সুযোগ হয়েছিল শ্রমিক লিগে যুক্ত হওয়ার। সেই সুবাদে শ্রমিক লিগের নেতা রুহুল আমিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে মিছিলে যাওয়ার সুযোগ হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ৬ নং সেক্টরে প্রথমের দিকে সেকশন কমান্ডার হই। পরবর্তীতে প্লাটুন কমান্ডার সর্বশেষ কোম্পানি কমান্ডার হিসাবে কুড়িগ্রামের টোগরাইহাট, ফুলবাড়ি ও নাগেশ্বরীতে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই।

রণক্ষেত্রে গেরিলা যুদ্ধ
জেলার নাগেশ্বরী থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর ছোড়া গুলিতে আহত হয়েছিলাম। এরপর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হই। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে আমি কুড়িগ্রাম শহরে প্রবেশ করি।

৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর সঙ্গে আমরা নানাভাবে যুদ্ধ করেছি। সেদিন আমাদের বিমানবাহিনীর দুটি বিমান এসে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙ্কার ধ্বংস করে দেওয়ার পর কুড়িগ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় তারা। ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার কোম্পানি কমান্ডের দায়িত্বে ছিলাম আমি সেই সময়। এরপর আমরা কুড়িগ্রাম জেলায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করি।

যুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলো
যুদ্ধ মানেই তো রোমহর্ষক ঘটনা। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনা ঘটে ৩ ডিসেম্বর। আমরা মাত্র ৩৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। হানাদারদের সেন্য ছিল প্রায় সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজারের মতো। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীরা আমাদের ১৭ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল। আমার সহযোদ্ধা ২ জনকে হানাদাররা ধরে নিয়ে যায়। সেদিন গোলাগুলি শেষেও সামনাসামনি বেয়নেট চার্জ করা হয়েছিল। এক অপরের সামনাসামনি মারতে ও মরতে হয়েছিল। ধস্তাধস্তি হয়েছিল।

সহযোদ্ধা ও সম্প্রীতি
সহযোদ্ধারা সবাই আমার আপন ছিলেন। কাকে বেশি ভালোবাসি বা কার সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব, সেটা মুক্তিযুদ্ধে মুখ্য বিষয় ছিল না। কেননা দেশের জন্য, স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে সব সহযোদ্ধা ছিলেন একে অন্যের আপন। কে কখন মারা যাব, এটা কখনো চিন্তা করিনি। সবাই এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।

আব্দুল হাই সরকার বলেন, স্বাধীনতার মিটিংয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক কথায় শেষ করে দিয়েছিলেন— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’। মুক্তির কথাটা তিনি আগেই বলেছিলেন। তারপর স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। এখন আমরা  মুক্তি পেয়েছি। এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বঙ্গবন্ধু যে শোষণ, বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো। তার নেতৃত্বে যেমন সব জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে যুদ্ধ করেছি, এর সুফল যেন সবাই পায়, এটাই স্বাধীনতার চাওয়া।

মুক্তিযুদ্ধের প্রাপ্তি
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে আমি আজ একটি স্বাধীন দেশে পেয়েছি। আর প্রাপ্তি হলো মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ছাড়া তো কোনো সরকার উদ্যোগ নেয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের এই মূল্যায়নের জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। জাতি যাতে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে, সে জন্য দেশকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের সবার উচিত তার হাতকে শক্তিশালী করা। দেশে কোনো প্রকার বিভাজন না করে স্বাধীনতার সুফল সবাই যেন ভোগ করতে পারে, এটাই চাওয়া।

বীর প্রতীক আব্দুল হাই কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের মুক্তারাম গ্রামের মৃত আব্দুল রহিমের ছেলে। বৈবাহিক জীবনে তার চার স্ত্রী ছিলেন। তিনি ১০ ছেলে-মেয়ের জনক।

কুড়িগ্রাম জেলার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মো. সিরাজুল ইসলাম টুকু বলেন, আমাদের জেলায় আনুমানিক ৪ হাজারের অধিক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এর মধ্যে কিছুসংখ্যক মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের মধ্যে তিনজন বীর প্রতীক ছিলেন। দুজন মৃত্যুবরণ করেছেন। এর মধ্যে আব্দুল হাই সরকার জীবিত আছেন। আর বীর বিক্রম দুজন ছিলেন। মৃত্যুবরণ করেছেন একজন, জীবিত আছেন আরও একজন।

তিনি আরও জানান, আব্দুল হাই সরকার আমাদের কুড়িগ্রামের গর্ব। ৬ নং সেক্টরে তিনি যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত দিবসে তিনি প্রথম পতাকা উত্তোলন করেছেন। সরকারের কাছে আমরা যা পেয়েছি, তাতে সন্তুষ্ট।

এনএ