‘চাষিদের একের পর এক দুর্ভোগ লেগেই আছে। সব শেষ এবার! সরিষা, ধান, বিচলি সবই শেষ হয়ে গেল। সব মিলে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ক্ষতি। বৃষ্টির কারণে সব ধান বাড়ি আনা সম্ভব হয়নি। শুকনা ধান তলিয়ে পচে যাচ্ছে। দুই চোখে এখন খালি অন্ধকার দেখি।’

বুধবার (৮ ডিসেম্বর) দুপুরে যশোরের বাঘারপাড়ার বিল জলেশ্বর মাঠে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে তলিয়ে যাওয়া জমি থেকে মুঠোবাঁধা ধান ডাঙায় আনার সময় কৃষক পলান দেবনাথ আক্ষেপ করে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। ক্ষতিগ্রস্ত এই কৃষকের বাড়ি উপজেলার রায়পুর ইউনিয়নের শালবরাট গ্রামে।

কৃষক পলান দেবনাথ জানান, দিনমজুরের কাজ করেই চলে তার ৫ সদস্যের সংসার। ২৭ কাঠা জমিতে তিনি এবার আমনের চাষ করেছিলেন। ১১ কাঠার ধান ঘরে তুলেছেন। ৮ কাঠার পাকা ধান কেটে ক্ষেতেই রোদে শুকাতে দিয়েছিলেন। টানা কয়েক দিনের বৃষ্টিতে ক্ষেতে হাঁটুপানি জমেছে। ভাসছে কাটা ধান। এখন বিচলি বাদ দিয়ে ধানের আগা কেটে বাড়িতে আনতে হবে।

এ ছাড়াও ৮ কাঠা জমিতে সরিষা লাগিয়েছিলেন। পানি জমে সেগুলোও মরে যাওয়ার পথে। সব মিলিয়ে এ বর্ষণে তার ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে অসময়ের ভারী বর্ষণে যশোর অঞ্চলের কৃষকদের স্বপ্ন ফিকে হয়েছে। টানা তিন দিনের বৃষ্টিপাতে জেলায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতি হয়েছে। রোপা আমন, বোরো বীজতলা, শীতকালীন সবজি, সরিষা, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন আবাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় দিশেহারা কৃষকরা। কৃষকের স্বপ্ন চোখের জলে ভাসছে।

বাঘারপাড়া উপজেলার শালবরাট গ্রামের কৃষক বাচ্চু মোল্লা বলেন, তিন দিনের বৃষ্টিতে মাঠে মারা গেছি। ১৯ শতক জমির টমেটো, ১৮ শতক সরিষা ও দুই বিঘা জমির ধান পানিতে ভাসছে। অনেক কষ্টে আজ ধান কেটে ডাঙায় তুলেছি। ক্ষেতের টমেটো গাছ থেকে ঝরে পড়ছে। অন্তত ৫০ মণ টমেটোর ফলন পেতাম। বর্তমানে পাইকারি প্রতি কেজি টমেটো ৮০ টাকা। ব্যাপক ক্ষতি হয়ে গেল আমার।

একই এলাকার চাষি গোলাম মোস্তফা বলেন, আড়াই বিঘা জমির ধান কেটে ক্ষেতেই রেখেছিলাম। তিন দিনের বৃষ্টিতে সেই ধান পানিতে ভাসছে। ঘরে তুলতে পারিনি। একই সঙ্গে এক বিঘা জমির সরিষা নষ্ট হয়েছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে অতিবৃষ্টিতে জেলায় ২৪ হাজার ৮৪১ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে রোপা আমন ধান ৪ হাজার ১৪৮ হেক্টর, বোরো বীজতলা ২৫২ হেক্টর,  আলু ২৫৬ হেক্টর, গম ২০৬ হেক্টর, পেঁয়াজ ২১৬ হেক্টর, মসুর ৪ হাজার ১৬৩ হেক্টর, সরিষা ৯ হাজার ৯১০ হেক্টর, সবজি ৪ হাজার ৬৫০ হেক্টর, ভুট্টা ১৫০ হেক্টর, মিষ্টি আলু ১৫ হেক্টর, চিনাবাদা ২৫ হেক্টর, সূর্যমুখী ১০ হেক্টর, মটরশুটি ২০০ হেক্টর, খেসারি ১৫০ হেক্টর, রসুন ৭৫ হেক্টর, ধনিয়া ১০ হেক্টর, আখ ৭৫ হেক্টর, মরিচ ৩০০ হেক্টর ও পান ১০ হেক্টর রয়েছে। তবে ক্ষতির পরিমাণ এখনো নিরূপণ করতে পারেনি কৃষি বিভাগ।

বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতির যশোর জেলা শাখার সভাপতি আব্দুল খালেক ও সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় জওয়াদের প্রভাবে বৃষ্টিপাতে সারা দেশের মতো যশোর জেলার কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা, ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ ও পুনরায় উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর যশোরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ঘূর্ণিঝড় জাওয়াদের প্রভাবে জেলায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে জেলায় ৫ শতাংশ রোপা আমন ধান ঘরে তুলতে বাকি ছিল। অতিবৃষ্টিতে ৩ শতাংশ ক্ষেতের কাটা ধান নষ্ট হয়েছে। বাকি ২ শতাংশ দাঁড়ানো ধান কৃষক ঘরে তুলতে পারবেন। হেক্টরপ্রতি কৃষকের ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ক্ষতি হতে পারে। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ সম্ভব হয়নি।

জাহিদ হাসান/এনএ