একদিকে ধরলা নদী, আরেক দিকে ভারতের গিতালদাহ। অন্য পাশে মোগলহাটে পাকিস্তানি ক্যাম্প। নৌকায় করে ভারত হয়ে মোগলহাট আক্রমণের উদ্দেশে যাত্রা। পাকিস্তানি ক্যাম্পের কাছে না পৌঁছাতেই বেধে গেল গোলাগুলি। প্রায় ঘণ্টা দুই ধরে চলতে থাকে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ।

সেখান থেকে ফেরার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর ফাঁদে পড়ে ঘটেছিল এক বড় দুর্ঘটনা। বাঙ্কারের (ঢাকনা দিয়ে রাখা গর্ত) আশপাশে অনেক দূর পর্যন্ত মাইন ফরটিন পুঁতে রেখেছিল পাকিস্তানি সেনারা। কিন্তু তা বুঝতে না পারায় সহযোদ্ধা জাকির হোসেন চন্দনের সঙ্গে সঙ্গে ডান পা উড়ে যায়। ক্ষতবিক্ষত শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে। মাথার ওপর ঘুরছে হেলিকপ্টার, সে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি!

ছোটবেলা থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ শহিদুল ইসলামের মনে দাগ কাটে। সপ্তম শ্রেণিতে ছাত্র থাকা অবস্থায় যুদ্ধে যাওয়ার নেশায় মরিয়া হয়ে ওঠেন। চোখের সামনে নিরীহ মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ সহ্য করতে পারেননি। তাই অপ্রাপ্ত বয়সেই অস্ত্র হাতে তুলে নেন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম সাইদুল।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নীলফামারী সদর উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার শহিদুল ইসলাম। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে ঢাকা পোস্টের নিয়মিত আয়োজনে আজ থাকছে এই বীর সেনানীর জীবনকাহিনি।

ঢাকা পোস্টকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বলেন, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অগণিত ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম শুরু করেন। মিটিং, মিছিল ও সভা-সমাবেশ থেকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ থেকে শুরু হয় প্রতিরোধ। মহকুমা শহরে রক্ষিত অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে শুরু হয় ট্রেনিং। ৫ এপ্রিল ইপিআর, আনসার ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যসহ হাজার হাজার জনতা ছুরি, বল্লম, বন্দুক, লাঠিসোঁটা নিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের জন্য এগিয়ে যেতে থাকেন।

পাকিস্তানি সেনাদের প্রতিরোধ করার জন্য সৈয়দপুর থেকে নীলফামারী পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে বাঙ্কার করে ইপিআর, পুলিশ ও আনসার সদস্যরা অপেক্ষা করছিলেন। ৭ এপ্রিল সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা ট্যাংক, কামান ও ভারী অস্ত্র নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে নীলফামারী শহরের দিকে আসতে থাকে। আসার পথে শত শত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয় তারা। পাকিস্তানি সেনারা নীলফামারী শহরের দিকে আসার সময় প্রতিরোধ ভেঙে গেলে ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ সাধারণ ছাত্র-জনতা সীমান্তের দিকে সরে যান।

পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতে সশস্ত্র ট্রেনিং নেওয়ার পর ৬ নম্বর সেক্টরের অধীন পাকিস্তানি সেনাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা আক্রমণ শুরু করেন। এভাবেই লড়াকু বাঙালিদের কাছে পরাস্ত হন পাকিস্তানি সেনারা। স্বাধীনতার স্বাদে বাংলার আকাশে ওড়ে লাল-সবুজের পতাকা।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শহিদুল ইসলামের যুদ্ধে যাওয়ার সাহস জুগিয়েছে। তবে নীলফামারীতে বিহারি পুলিশকে পাকড়াও করে সোনালী ব্যাংকের সামনে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। সেদিন ওই দৃশ্য দেখে যুদ্ধে যেতে আরও বেশি উৎসাহ অনুপ্রেরণা পান।

১৯৭১ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে নীলফামারী শহরে প্রবেশ করে ইপিআর। বর্তমান ডিসির রেকর্ড রুম তখন ছিল সোনালী ব্যাংক ও ট্রেজারি অফিস। সোনালী ব্যাংকের তালা ভেঙে প্রাপ্তবয়স্করা রাইফেল হাতে নিল। নীলফামারী জেলার বিহারি পুলিশ ও থানার বিহারি পুলিশকে পাকড়াও করে নিয়ে আসে সোনালী ব্যাংকের সামনে। সেখানে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তখনই সাহস ও অনুপ্রেরণা পান শহিদুল ইসলাম।

শহিদুল বলেন, আমার ছোট চাচা মজিবুর রহমান মাস্টার। তার কাপড়ের দোকান ছিল। কাপড়ের ব্যবসার জন্য কুমারখালী পোড়াদহসহ বিভিন্ন এলাকায় যেতেন। চাচা আমাদের পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনা শোনাতেন। এসব শুনে আমার মনে বিহারি ও পাকিস্তানের ওপর প্রচণ্ড ঘৃণা জন্ম হয়।

সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে। দিন দিন পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকে। আমরা তখন রেডিওতে প্রতিদিন বিবিসির সংবাদ শুনতাম। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকার সংবাদে মনটা আরও ক্ষিপ্ত হয়। তখনই বুঝতে পারি বঙ্গবন্ধু কেন ৭ই মার্চের ভাষণে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন।

বাবার ট্রাংক থেকে টাকা চুরি করে যুদ্ধে যাওয়া
বাবার ট্রাংক থেকে চুরি করা টাকা নিয়ে মাকে মিথ্যা বলে বাড়ি ছেড়েছিল শহিদুল ইসলাম সাইদুল। প্রচণ্ড ক্ষুধা আর শরীরে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও যুদ্ধে যাওয়ার নেশা তাকে দমাতে পারেনি। বরং হাঁটতে হাঁটতেই একসময় সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের হিমকুম কুমারি নামক জায়গায় পৌঁছে যান ছোট্ট শহিদুল।

বীর শহিদুল বলেন, একাত্তরের ৭ ও ৮ এপ্রিল অনেক লোক লাঠিসোঁটা ও বল্লম নিয়ে ইপিআরের সঙ্গে সৈয়দপুরের দিকে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করার জন্য রওনা দিল। আমিসহ অনেকেই তাদের পেছন পেছন গেলাম। নীলফামারী দারোয়ানীতে পৌঁছার পর ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ আসতে থাকে। লোকজন ভয়ে দিগবিদিক ছুটতে থাকে। আমরাও বাড়িতে ফিরে এসে দেখি গ্রামের হিন্দুরা চাংগোই ভাড় বাংকুয়া দিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে ভারতে যাচ্ছে। তখন আমার খুব ইচ্ছা করছিল ভারত যাব, সেখানে গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসে যুদ্ধ করব।

তিনি আরও বলেন, আমি বয়সে খুব ছোট ছিলাম। নিজের টাকাপয়সা নেই। একা কীভাবে যুদ্ধে যাব? তখন আমার মামাতো ভাই কেবারত ও গ্রামের প্রিয়নাথসহ পরামর্শ করলাম। তারাও যুদ্ধে যেতে রাজি কিন্তু আমাদের কারও কাছে টাকা নেই। আমি তখন বাবার ট্রাংক থেকে ৫০ টাকা চুরি করি।

পরদিন ভোরে একটি ঝুড়ি নিয়ে তিনজন রওনা দেওয়ার আগে মা জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি? আমি বললাম, মাসির (খালার) বাড়ি জলঢাকায় যাব। বাড়ির কাউকে আর কিছু না জানিয়ে তিনজন মিলে বের হয়ে হাঁটতে লাগলাম। বর্ডার পার হয়ে ভারতের হিমকুম কুমারি নামক স্থানে পৌঁছে যাই। তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত, ঘন অন্ধকার নেমে আসে। সারা দিন কিছু খাইনি। রাস্তায় মুড়ি জলপান যা খেয়েছি, তা আর পেটে নেই। তখন পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা।

টাকা চুরি করেও লাভ হয়নি জানিয়ে বলেন, পাকিস্তানি ৫০ টাকার নোট ভাঙাব কীভাবে, তা ভাবতেই নীলফামারীর একজন পরিচিতজনকে চোখে পড়ে। তাকে টাকা ভাঙিয়ে দিতে অনুরোধ করলে লোকটি ৫০ টাকার নোটটি নিয়ে চলে যায় আর ফিরে আসেননি। অনেক অপেক্ষার পর লোকটি না আসায় রাতে ক্ষুধা নিয়ে স্কুলের বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়ি।

ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেঁদেছেন বারবার
মনে যুদ্ধের নেশা আর পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা। হাতে নেই টাকা। প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে যেতে তখনো কোনো উপায় পাইনি। মাঝেমধ্যে ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে চাপা কান্নায় নীরব থাকি। কখনো এক বেলা ক্ষুধার কষ্টে ভাতের মাড় খেয়ে, আবার কখনো খাওয়া ছাড়াই কেটেছে দিন।

শহিদুল ইসলাম বলেন, অনেক কষ্টে ভারতের নেতা বীর বাবুর একটি গোডাউনের বারান্দায় থাকার ব্যবস্থা হয়। কোনো দিন এক বেলা খাবার দেয়, আবার কোনো দিন দেয় না। ক্ষুধার কষ্টে কেঁদেছি বারবার। সইতে না পেরে কেবারত ভাইসহ বুদ্ধি করে বর্ডার পার হয়ে মুসলমানদের বাড়িতে যাই। তাদের অনুরোধ করে বলি, তোমাদের ভাতের মাড়টুকু দাও। তারা মাড় দিলে তাতে লবণ দিয়ে খেয়ে দুই রাত পার করি।

পরে আবার দেওয়ানগঞ্জে আসি। দেওয়ানগঞ্জে এসে দেখি অ্যাডভোকেট আলম চৌধুরী, আহাদ হোসেন, তারাগঞ্জের এলাহী বকস এমপি। তারা সবাই দেওয়ানগঞ্জের পাশে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে রান্না করে খাওয়াদাওয়া করেন। তাদের আমি বাজার করে দেওয়াসহ রান্নাবান্না করে দিতে চাইলাম, বিনিময়ে আমাকে শুধু খাওয়াতে হবে। তারা আমার প্রস্তাবে রাজি হলেন। এভাবে সেই কেটে যায় সপ্তাহ।

প্রশিক্ষণ গ্রহণ
মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে বয়স ও ছোট হওয়ায় শুরুতে বাছাইয়ে বাদ পড়েছিলেন শহিদুল ইসলাম। অনেক কান্নাকাটি করে পরে দলভুক্ত হন। ভারতের মুক্তি ক্যাম্পে (মুজিব ক্যাম্প) আলফা ব্যারাকে ট্রেনিং নেন। সেখানে টানা এক মাসে রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, চু-ইঞ্চ মর্টার, ৩৬ হ্যান্ডগ্রেনেড, মাইন ফোরটিন, মাইন সিক্সটিন, অ্যান্টি ট্যাংক এবং বিল্ডিং কাটিং চার্জের জন্য এক্সক্লুসিভ ডেটোনেটর সেফটি ম্যাচসহ আরও অনেক বিষয়ে প্রশিক্ষিত হন তিনি। যোগ দেন ৬ নম্বর সেক্টরে। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন খাদেমুল বাশার।

ট্রেনিংয়ে পাওয়া কষ্ট ভুলতে না পারা শহিদুল ইসলাম বলেন, দেওয়ানগঞ্জ জিগাতলায় হঠাৎ একদিন ইন্ডিয়ান সেনাবাহিনীর চারটি বড় গাড়ি ত্রিপল, খাবার, রেশন ও খড়ি নিয়ে আসে। আমরা তখন তাঁবু খাটাই, থাকার জন্য বিছানা তৈরি করি এবং রেশনের ব্যবস্থা হয়। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর চারটি বড় গাড়ি ক্যাম্পে আসে। তখন ক্যাম্পে ২০০ জনের বেশি ছেলে ছিল। সেখানে ডোমারের নূরনবী, মানিক ভাই, সমসের, জব্বার ভাইসহ সবাইকে নিয়ে চারটি গাড়িতে করে ৫০ জন করে সন্ধ্যার পর ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হই।

টাপুরহাট হয়ে গাড়ি যায়, বিভিন্ন জঙ্গল ও মেটিলি পাহাড়ের ওপর দিয়ে। পরদিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তি ক্যাম্পে (মুজিব ক্যাম্প) পৌঁছালাম। রাতের বেলা আলফা, ব্রাভো, চার্লি ডেল্টা নামে চারটি ব্যারাকে আমাদের ভাগ করে দেওয়া হয়। আমি ছিলাম আলফা ব্যারাকে। মেঝেতে ঘুমানোর জন্য আমাকে দুটি কম্বল, একটা ইট, একটা সিলভারের থালা ও একটি মগ দেওয়া হয়।

তিনি আরও বলেন, বাছাইয়ের দিনে আমার সঙ্গে ডোমারের টুটুলকে বাদ দেওয়া হয়। আমরা ছোট ছেলে হিসেবে অনেক কান্নাকাটি করে অন্তর্ভুক্ত হই। তখন হুকুম করা হলো, এক কিলোমিটার দূরে অস্ত্রাগার থেকে রাইফেল নিয়ে আনতে হবে। আমরা তাই করি। এরপর ট্রেনিং শুরু হয়। সেখানে ৩০ দিন ধরে রাইফেল, স্টেনগান, এসএলআর, এলএমজি, চু-ইঞ্চ মর্টার, ৩৬ হ্যান্ডগ্রেনেড, মাইন ফোরটিন, মাইন সিক্সটিন, অ্যান্টি ট্যাংক এবং বিল্ডিং কাটিং চার্জের জন্য এক্সক্লুসিভ ডেটোনেটর সেফটি ম্যাচসহ আরও অনেক বিষয়ে ট্রেনিং করানো হয়।

শহিদুল ইসলাম বলেন, দুই প্লাটুন (৮০ জন) মিলে একটা কোম্পানি তৈরি করে আমার বুকে শ্লেট চক দিয়ে ৭/৩৭ নম্বর লিখে দেন। আমি ছিলাম ৭ নম্বর প্লাটুনের ৩৭ নম্বর সদস্য। এভাবে মোট আটটি প্লাটুন করে চারটি কোম্পানি তৈরি হয়েছিল। আমাদের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন মেজর উইলিয়াম। তার নির্দেশে ২০ জন করে চারটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সেকশন কমান্ডার/প্লাটুন কমান্ডার তৈরি করা হয়। পরে তাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন জায়গায় আমরা অপারেশনে অংশ নিয়েছি।

রণাঙ্গনের রোমহর্ষক স্মৃতি
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদুল ইসলাম যুদ্ধ করেন লালমনিরহাটের হাতিবান্ধা, দইখাওয়া, মহিষখোঁচা, কালমাটি, আদিতমারি, বড়বাড়ি এবং কুড়িগ্রামের কাঁঠালবাড়িসহ আশপাশের এলাকা। যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ক্যাম্পের একদিকে ধরলা নদী, আরেক দিকে ভারতের গিতালদাহ। অন্য পাশে লালমনিরহাটের মোগলহাটে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প। সেখানে অপারেশন করার নির্দেশ প্রদান করা হয়। আমরা পরদিন সকালবেলা নৌকাযোগে ভারতের মধ্য দিয়ে মোগলহাটে পাকিস্তানি ক্যাম্পের কিছু দূরে অবস্থান করি। একপর্যায়ে সেখানে উভয় পক্ষের মধ্যে দুই ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলি হয়।

তিনি আরও বলেন, ফেরার পথে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা বাংকারের আশপাশে অনেক দূর পর্যন্ত যে মাইন ফোরটিন পুঁতে রেখেছিল, তা আমাদের জানা ছিল না। আমার সহযোদ্ধা কুড়িগ্রামের জাকির হোসেন চন্দনের পায়ের ওপর পড়লে সঙ্গে সঙ্গে তার ডান পা উড়ে যায়। আমরা সঙ্গে সঙ্গে গামছা দিয়ে তার ওপরের অংশটি বেঁধে দিয়ে বেয়নট দিয়ে রাস্তা খুঁড়ে খুঁড়ে তাড়াতাড়ি পার হয়ে আসি। কষ্ট করে চন্দনকে নিয়ে নৌকাযোগে গীতালয় পৌঁছাই। পরে তার উন্নত চিকিৎসার জন্য সেখানে হেলিকপ্টার আসে। সেদিন কি ভয়াবহ অবস্থান দেখেছি। সেই চন্দন আজও বেঁচে আছে। এটা মুক্তিযুদ্ধে প্রথম দিনের রোমহর্ষক ঘটনা।

অতর্কিত হামলার শিকার
একটা অপারেশন চালাতে গোলাবারুদসহ কাকিনার উদ্দেশে রওনা দেন ২০ থেকে ২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা। সেই দলে শহিদুল ইসলামও ছিলেন। কাকিনা থেকে একটু দূরে চাপারহাটে দেখা হয় বেশ কিছু সহযোদ্ধার সঙ্গে। তারা সবাই একটি ফাঁকা ঘরের মধ্যে বসে গল্প করতে করতে চালভাজা খেতে থাকেন। তখনই অতর্কিত হামলা চালাতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনারা।

শহিদুল ইসলাম বলেন, কাকিনার চাপারহাটে একটি ঘরে বসে সবাই চালভাজা খাচ্ছিলাম। মিনিট পাঁচেক যেতে না যেতেই হাটের নিচু জমি থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের উদ্দেশ করে গুলিবর্ষণ শুরু করল। তখন মনে হয়েছিল আজ আর বাঁচতে পারব না। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে শুয়ে পড়ি। আমরাও পাল্টা গুলি চালাতে চালাতে সেখানে থেকে পালিয়ে নিরাপদ স্থানের দিকে যাই। কিন্তু আমার এক সহযোদ্ধা নীলফামারী কিশোরগঞ্জের রাজিব গ্রামের শাহাবুদ্দিন পালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়। পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধে এ রকম বহু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধে নীলফামারী জেলার প্রায় ২ হাজার জন অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ৭১ জন শহীদ হয়েছেন। বর্তমানে জেলায় ৮১০ জন মুক্তিযোদ্ধা সরকারি ভাতা-সুবিধা পাচ্ছেন। আরও ৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতার জন্য আবেদন করা হয়েছে। অসুস্থ্ ও অসহায় অবস্থায় রয়েছে প্রায় ১১৬ জন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী ১৩০ জন মৃত্যুবরণ করেন। জেলার বিভিন্ন স্থানে ২৫টি গণকবর (বধ্যভূমি) রয়েছে।

উল্লেখ্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদুল ইসলাম সাইদুল নীলফামারী সদরের মহববত বাজিতপাড়ার বাসিন্দা। তার বাবা মৃত ইলিয়াস প্রামাণিক। পরিবারের ১৩ ভাই-বোনের মধ্যে শহিদুল ইসলাম তৃতীয় সন্তান। শহিদুলের পরিবারে স্ত্রী ও তিন ছেলে সন্তান রয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি পরিবহন খাতের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।

এনএ