বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. আলতাফ হোসেন

‘বাগেরহাট সদর উপজেলার সাহসপুর গ্রাম। সেখানে হানাদারদের সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। একপর্যায়ে আমাদের গুলি ফুরিয়ে যায়। চারদিক থেকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনারা আমাদের ঘিরে ফেলে। এরইমধ্যে সঙ্গীরা মিলে সিদ্ধান্ত নিই, দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে হবে। সে অনুযায়ী যে যার মতো সরে যেতে থাকি। কিন্তু আমি আটকা পড়ে যাই নৃপ্রেনের বাগানে। বাগানে তখন পানি থৈ থৈ করছে।’

‘সেখানে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকি। যেকোনো মূহূর্তে ধরা পড়ে যাব। জীবনের মায়া প্রায় ছেড়ে দেই। শেষচেষ্টা হিসেবে নারকেলগাছের একেবারে ওপরে উঠে বসে থাকি। আর মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে থাকি, কেউ যেন ওপরে না তাকায়। আল্লাহর অশেষ রহমতে চারদিকে খুঁজে কাউকে না পেয়ে হানাদাররা সদলবলে ফিরে যায়। আর আমি ফিরে আসি আমাদের ক্যাম্পে।’

এভাবে রণাঙ্গনের রোমহর্ষক স্মৃতির বর্ণনা ঢাকা পোস্টের এই প্রতিনিধিকে জানালেন বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. আলতাফ হোসেন। মুক্তিযুদ্ধে বাগেরহাটের রফিক বাহিনীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি।

বাগেরহাটের মুনিগঞ্জ খেয়াঘাট থেকে চিতলমারী পর্যন্ত ছিল এই বাহিনীর দখলে। মুক্তিযুদ্ধকালে কোনো অঞ্চলের অধিকার হারায়নি এই বাহিনী। উপরন্তু অধিকৃত অঞ্চলের পরিধি বাড়িয়েছে। এরমধ্যে ছিল গোটাপাড়া, বিষ্ণুপুর, চিতলমারী, ধোপাকালী, সন্তোষপুর, চরবানিয়া প্রভৃতি অঞ্চল।

যুদ্ধের প্রস্তুতি ও অংশগ্রহণ

আলতাফ হোসেন বলেন, যুদ্ধ শুরুর আগে আমি খুলনা বিএল কলেজে ডে-নাইট শিফটে শিক্ষকতা করতাম। যুদ্ধের শুরুতেই হানাদার বাহিনী হামলা চালায় খুলনায়। দৌলতপুর মীনাক্ষি সিনেমা হলের সামনে চোখের সামনে গুলি করে মেরে ফেলে অসংখ্য মানুষকে। আমি বাম রাজনীতি করতাম। এমন হত্যাকাণ্ড দেখে রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে।

রাতেই স্ত্রীকে নিয়ে বাগেরহাটের উদ্দেশে হেঁটে রওনা হই। পাকবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তিন দিন হেঁটে পৌঁছায় বাগেরহাট সদর উপজেলার বিষ্ণুপুরে নিজ বাড়িতে। এসে দেখি কেউ নেই। বাড়িশূন্য। খবর পাই বীর মুক্তিযোদ্ধারা চিরুলিয়া স্কুল মাঠে সংগঠিত হচ্ছে।

স্ত্রীকে বাড়িতে রেখেই চলে যাই সেখানে। আমাদের প্রধান কমান্ডার ছিলেন রফিকুল ইসলাম। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন শেখ আনিছুর রহমান। আর আমি ছিলাম চিরুলিয়া ক্যাম্পের থার্ড–ইন কমান্ড। প্রথমদিকে আমাদের সদস্য ছিলেন মূলত বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছাত্র ও যুবকর্মীরা। পরে দল-মত-নির্বিশেষে তরুণরা আমাদের সঙ্গে যোগ দেন।

যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহ

বিমানবাহিনীর সাবেক সদস্য ও আগরতলা যড়যন্ত্র মামলার আসামি ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম ছিলেন আমাদের প্রশিক্ষক। তিনি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে আসেন এবং আমাদের ৯ নম্বর সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমাদের বাহিনী গঠনের শুরুতে ছাত্র ইউনিয়নকর্মী আসাদের থেকে সংগ্রহ করা একটি মাত্র রিভলবার ছিল।

পরবর্তীতে পিরোজপুরের ফজলুল হক খোকনের নেতৃত্বে বামপন্থি ছাত্র-যুবকরা ২৬ মার্চ সেখানকার অস্ত্রাগার লুট করে কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে। তারমধ্য থেকে ১৯টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল পাই আমরা। আর এইসব অস্ত্র দিয়েই চলতে থাকতে আমাদের যুদ্ধ জীবন।

সহযোদ্ধাদের যে স্মৃতি আজও কাঁদায়

সদর উপজেলার গোটাপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ খালের এপার-ওপারে তখন যুদ্ধ চলে। আমাদের সহযোদ্ধারাও গুলি ছুড়ছে, হানাদাররাও প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ করছে। চারদিকে বারুদের গন্ধ আর গুলির শব্দ। আমার পাশে মাত্র ২০ বছর বয়সের বিজয় পাল। দারুণ সাহসী বিজয় রেকি করে এগিয়ে যাচ্ছে আর গুলি ছুড়ছে।

হঠাৎ একটি গুলি ছুটে এসে সরাসরি লাগে বিজয়ের কপালে। ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় বিজয়ের মাথা। বিজয়ের মৃতদেহ নিয়ে আমি পিছিয়ে আসি। একটু পেছনে রেখে আবার এগিয়ে যাই সামনের দিকে। অসংখ্যা মৃত্যু দেখেছি চোখের সামনে। কিন্তু বিজয়ের মৃত্যু, আহা কি দুঃসহ স্মৃতি! সেই স্মৃতি আজও আমাকে কাঁদায়। অমিত সম্ভাবনার টগবগে এক যুবক। সেকেন্ডের ব্যবধানে মারা গেল। ওর কথা মনে পড়লেই চোখে পানি চলে আসে।

যুদ্ধ থেকে ফেরা ও চাকরিতে যোগদান

তিনি বলেন, ১৭ ডিসেম্বর বাগেরহাটমুক্ত হয়। আমরা পিএনজি মাঠে (বর্তমানে স্বাধীনতা উদ্যান) বাগেরহাট মহকুমা প্রশাসকের অস্ত্র জমা দিয়েছিলাম। অস্ত্র জমা দেওয়ার সার্টিফিকেটও পাই। কিছু দিন বাইরে ঘুরে ঘুরে শূন্য হাত আর মনের মধ্যে অসংখ্য স্মৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। বাবা-মা, ৬ ভাই ও এক বোনও ফিরে আসে বিভিন্ন জায়গা থেকে। পরে আমি ঢাকায় চলে যাই এবং আইডিয়াল ল কলেজে অধ্যাপনা শুরু করি।

কেমন আছেন আলতাফ স্যার

একান্ত আলাপচারিতায় নিজের বর্তমান অবস্থার কথা বলতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন এই প্রবীণ বীর মুক্তিযোদ্ধা। কান্না বিজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন,  আমার সাংসারিক অবস্থা এখন মোটেও ভালো নয়। সারাজীবন শুধু দিয়েই গেছি। বিনিময়ে কিছু চাইনি। আমার এখন ৭৮ বছর বয়স, এই বৃদ্ধ বয়সেও আমার ছাত্র পড়ায়ে খেতে হয়। আমি অনেক দ্বারে গেছি। ঘুরে ঘুরে ফিরে এসেছি।

আমি ও আমার স্ত্রী দুজনেই সুপ্রিম কোর্টের উকিল ছিলাম। তবু আমার ঘরে খাবার নেই। আমার একটু মুরগির মাংস খেতে ইচ্ছা করে, ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছা করে। কিন্তু আমি পারি না। ওষুধ কেনার টাকাও আমার নেই এখন।

তবুও আমি সরকারের কাছে কিছু চাই না, এক টাকাও লাগবে না। কিন্তু আমি আমার যোগ্য স্বীকৃতি চাই? আর এতদিনেও কেন পেলাম না তার জবাব চাই? আর সহযোদ্ধারা কেউ যদি বলতে পারেন আমি থার্ড-ইন কমান্ড ছিলাম না তবে রাস্তায় বুক পেতে দেব- আমাকে গুলি করে মার।

তিনি আরও বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, মাগুরা-১ আসনের সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শেখর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো বোন তহমিনা, শাহাজান খানের স্ত্রী রোকাইয়া সবাই আমার ছাত্র ছিল। কিন্তু কেউ আমার খোঁজ নেয় না। আমার এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রাইভেট পড়িয়ে খেতে খুব কষ্ট হয়।

কোথায় থাকেন এখন

তিনি বলেন, আমার মূল বাড়ি বাগেরহাট সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নে। আমি বর্তমানে শহর রক্ষা বাঁধের কাছে অবস্থিত বধ্যভূমির নিকটে একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করি। এবং কোর্ট মসজিদ এলাকার নিকটবর্তী নিউ মার্কেটে আইন বই জগৎ নামের একটি ছোট্ট দোকানঘরে বসে ছাত্রদের পড়াই।

একজন মুক্তিযোদ্ধার এমন অবস্থা মেনে নেওয়া যায় না জানিয়ে মাসুমা রুনা নামের ড. মো. আলতাফ হোসেনের একজন ছাত্রী বলেন, আমরা চাই স্যারের এই করুণ অবস্থা থেকে যেন মুক্তি মিলে। মরণোত্তর কোনো সন্মাননার প্রয়োজন নেই। তিনি যেন বেঁচে থাকতেই তার যোগ্য সম্মানটুকু পান।

আলতাফ হোসেন সম্পর্কে বাগেরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক সহকারী কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাকিম বলেন, আলতাফ স্যার ছিলেন আমাদের থার্ড-ইন কমান্ড। আমাদের প্রতিদিন-ই রাজাকার, আলবদর, পাকবাহীনির সঙ্গে যুদ্ধ চলত। কিন্তু দুঃখের বিষয় যখন লাল তালিকা হয়েছে তখন তিনি বাগেরহাটে ছিলেন না। চাকরির জন্য বাইরে থাকায় তিনি তালিকাভুক্ত হতে পারেননি। আমরা তার নাম কাগজপত্রসহ ঢাকায় পাঠিয়েছি। আশা করি, তিনি নতুন তালিকায় তার নাম আসবে।

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলতাফ হোসেন

বাংলাদেশ গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ-১৯৭১ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন, খুলনা প্রকল্পের প্রাক্তন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ আলী আহমেদ বলেন, আলতাফ সাহেব আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। তিনি স্বাধীনতাযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে স্বাধীনতার এত বছর পরেও তিনি তার প্রাপ্য সম্মানটুকু পাননি।

তিনি আরও বলেন, আজকে তিনি জীবনের চরম সংকটময় অবস্থায় রয়েছেন। অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে বিভিন্ন কৌশলে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছেন। অথচ দেশমাতৃকার একজন প্রকৃত যোদ্ধা আজ অবহেলিত হয়ে পড়ে রয়েছে। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই অন্তত জীবনের এই অন্তিম মূহূর্তে এসে তিনি যেন অন্তত তার স্বীকৃতিটুকু পান।

জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, জেলায় ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৪ হাজার ৮৫০ জন। এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৭০৩, কচুয়ায় ৩০৬, ফকিরহাটে ১৮১, মোল্লাহাটে ১ হাজার ৪২৩, চিতলমারীতে ৮১৯  মোংলায় ২৩৯  রামপালে ২৫০  মোরেলগঞ্জে ৪৪৭ এবং শরণখোলায় ৪৯২ জন রয়েছেন।

বাগেরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার শাহিনুল আলম ছানা বলেন, ১৯৭১ সালে যারা যুদ্ধ অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাদের তালিকা তৈরি করে সরকার যে ভাতা প্রদান করে সেই তালিকা অনুযায়ী জেলায় প্রায় ৫ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন কারণে বাদ পড়া আরও ৫০০ জনের নাম প্রক্রিয়াধীন রয়েছেন।

এমএসআর