বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল

'১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহ শহর ও রেলপথে গফরগাঁও এসে এ জেলা দখল করে নেয় হানাদার বাহিনী। ২২ এপ্রিল আমার পরিবার ফুলবাড়িয়ার একটি গ্রামে আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলাম।

দিনটি ছিল ৯ মে। মাকে বললাম, মামার বাড়ি বেড়াতে যাব। তাদের কী অবস্থা একটু দেখে আসি। মা সহজেই রাজি হয়ে গেলেন। তখন মাকে ফাঁকি দিয়ে আমার ব্যবহৃত একটি সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে সোজা পৌঁছে গেলাম ভারতের ক্যাম্পে।'

ময়মনসিংহ নগরীর থানারঘাটের পাশে স্থাপিত বধ্যভূমির সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধদিনের স্মৃতিগাথা এভাবেই রোমন্থন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমল পাল। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে এই বীর বাঙালির জীবনকাহিনি।

কিশোর বয়স থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হন বিমল পাল। ছয় দফাসহ বাঙালির মুক্তির যে আহ্বান ছিল বঙ্গবন্ধুর, সেই আহ্বানে এককাট্টা ছিল বাম সংগঠনগুলোও। ১৯৬৬ সাল থেকেই আন্দোলনগুলোতে সক্রিয় ছিলেন তিনিও। ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’— আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে বন্দি, তখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জনপদ এ স্লোগানে ছিল মুখর। তিনিও সেই স্লোগান ধরেছিলেন রাজপথে। মূলত এই গণজোয়ারই বিমল পালকে প্রেরণা ও উৎসাহ জোগায় মুক্তিযুদ্ধে যেতে। তাই ১৭ বছর বয়সেই চলে যান স্বাধীনতা ও মুক্তির যুদ্ধে।

১৯৭১ সালের ১১ জুন। তুরা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের উদ্দেশে খোলা ট্রাকে করে একদল তরুণের সঙ্গে শুরু হয় যাত্রা। ১২ জুন এসে উপস্থিত হন ক্যাম্পে। প্রায় এক মাস চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। ১৪ জুলাই পোস্টিং দেওয়া হয় ১১ নম্বর সেক্টরের ঢালু সাব সেক্টরে। এ সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আলী হোসেন, প্লাটুন কমান্ডার মোজাফফর হোসেন, সেকশন কমান্ডার ফারুক আহমেদ। ১৭ জুলাই হালুয়াঘাটের নাগলা ব্রিজ ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। এরপর বারমারি অ্যাটাক, নুন্নি সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে চলে যুদ্ধ।

রণাঙ্গনের বিভীষিকাময় স্মৃতি
ময়মনসিংহ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হালুয়াঘাটের তেলিখালী যুদ্ধ। সেই দিনের কথা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে বিমল পালের। ২ নভেম্বর রাত থেকে মুক্তিযোদ্ধারা ‘আক্রমণ করো এবং দখল করো’ নীতিতে প্রস্তুত ছিলেন। তেলিখালীতে পাকিস্তানি সেনাদের সব বাঙ্কার দখলের পরিকল্পনা সাজান মুক্তিযোদ্ধারা।

এই যুদ্ধে কোম্পানি কমান্ডার আবুল হাশেমের সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর ১৩ রাজপুত রেজিমেন্ট যুক্ত ছিল। ঘাঁটিটি ছিল হালুয়াঘাট সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ক্যাম্প। ১ প্লাটুন ৩৩ পাঞ্জাব, ১ প্লাটুন ৭১ উইং রেঞ্জারের সঙ্গে সমানসংখ্যক রাজাকার। এই আক্রমণের নায়ক ল্যান্স নায়েক মো. মেসবাহ উদ্দিন।

পরদিন ৩ নভেম্বর। তখনো ফোটেনি সূর্যের আলো। সবকিছু দেখা যায় আবছা। ৩৩ পাঞ্জাবের পশ্চিম-দক্ষিণ কোণের পাকিস্তানিদের বাঙ্কারটি দখলে আনতে গুলি শুরু করি শামছুল হকসহ আমরা মুক্তিযোদ্ধারা। গোলাগুলির শব্দে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। মুক্তিযোদ্ধাদের একটাই লক্ষ্য, সব কটাকে মেরে ওদের বাঙ্কার দখল করতে হবে। পাকিস্তানিরাও তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত না পেরে তারা আত্মসমর্পণের সুযোগ চেয়েছিল সুবেদার ধরম পালের কাছে। কিন্তু আমাদের প্লাটুন কমান্ডার আতাউদ্দিন শাহ বলেছিলেন, ‘তোদের কোনো রক্ষা নাই। সব কয়টাকে জবাই করব।’ তাই তারা আত্মসমর্পণের সুযোগ পেল না।

প্রায় চার ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধ শেষে পুরো তেলিখালী ক্যাম্প দখলে আসেন মুক্তিযোদ্ধাদের। যুদ্ধে ৮ জন মুক্তিযোদ্ধা ও ২১ জন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্য শহীদ হন। সে সময় পাকিস্তানিদের দুটো প্লাটুনই সম্পূর্ণভাবে পরাজিত হয়। ফলে ১২৪ জন পাকিস্তানি সেনা ও ৮৫ জন রাজাকার প্রাণ হারায়।

এর পরের পরিস্থিতি আরও রোমহর্ষক ছিল। যুদ্ধ শেষ করে যখন ক্যাম্পে ফিরে আসি, তখন আমাদের চোখের সামনে শুধু ক্ষতবিক্ষত লাশ আর লাশ। কারও হাত নেই, কারও পা নেই, কারও মাথা নেই। এমন ক্ষতবিক্ষত লাশ এদিক-সেদিক পড়ে আছে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ আমরা নিয়ে আসি, ভারতীয়দেরটা তারা নিয়ে যায়। এটি ছিল আমাদের জন্য এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। আর পাকিস্তানি বাহিনীদের লাশ সেভাবেই পড়ে ছিল। কেউই সৎকারের ব্যবস্থা করেনি। দিন-রাত শিয়াল-কুকুর তাদের খেয়েছে ছিঁড়েখুঁড়ে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সংকেত ছিল এই ঐতিহাসিক তেলিখালী যুদ্ধ। মূলত ৩ নভেম্বর সেই সম্মুখযুদ্ধের মধ্য দিয়ে শত্রুদের পতন শুরু হয়। ৭ ডিসেম্বর থেকে ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা মুক্ত হতে শুরু করে। এর ঠিক তিন দিন পর ১০ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় ময়মনসিংহ।

সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণা
ফুলপুর ভাইটকান্দির এক তরুণ ছিল, নাম হযরত আলী। সে আমার সমবয়সীই ছিল। পড়াশোনা করত মাদরাসায়। পরনে লুঙ্গি বা পাজামা, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করার জন্য আমরা যখন কাল মার্ক্স, লেলিন বা মাও সে তুংদের গল্প বলতাম, সে তখন উহুদ, বদর যুদ্ধ কিংবা হজরত আলী, হজরত উসমানদের যুদ্ধের কাহিনি বলে প্রেরণা দিত। আমাদের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিত সামনে থেকে। সহযোদ্ধাদের অনেকের কথা মনে হলেও সেই হযরত আলীর কথা আজও মনে পড়ে। মাদরাসাপড়ুয়া ছাত্র আমাদের সঙ্গে যুদ্ধের ময়দানে দেশের জন্য লড়াই করেছে, এটা মনে হলেই বুকটা ভরে যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিবেদিত ছিল সাধারণ মানুষ
আমাদের গ্রামগঞ্জের মানুষেরা শত অত্যাচারের মধ্যে থেকেও বুঝতে পেরেছিল, এই দেশ একদিন স্বাধীন হবেই। একটি গ্রামের কয়েকজন লোক পাকিস্তানিদের হানাদারদের সহায়তা করলেও আপামর জনগণ ছিল মুক্তিকামী। প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকেই কেউ না কেউ দেশে বাঁচাতে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। এ জন্য তাদের পরিবারের সদস্যরাও ভেবেছেন যে দেশ স্বাধীন হবেই। সে জন্য তারা সব সময়ই মুক্তিবাহিনীর দিকে চেয়ে থাকত। আমরা যখনই তাদের আশ্রয় প্রার্থনা করি, তারা সর্বোচ্চটা দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করেছে।

একবার সীমান্ত থেকে ময়মনসিংহ শহরে ১১ জনের দল নিয়ে গেরিলা আক্রমণে এসেছিলাম। কাশিগঞ্জ আসতেই রাজাকারদের সঙ্গে আমাদের একটি সংঘর্ষ হয়। একপর্যায়ে আমরা কিছু সময় একটা বিলের মধ্যে আত্মগোপনে থাকি। পরে সেখান থেকে উঠে এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিই। তার ঘরে আমাদের ১১ জনকে খাবার দেওয়ার মতন তেমন কিছুই ছিল না। ঘরে ছিল শুধু চ্যাপা শুঁটকি আর একটি মিষ্টিলাউ। সেগুলো দিয়েই রান্না করে আমাদের খাইয়েছে। তার একটা ছোট ছেলে আমাদের দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিল। তখন তার মা তাকে অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার মামার বাড়ির মামারা আইছে।’ এভাবেই আমরা সবার সহযোগিতা পেয়েছি।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা ও প্রাপ্তি স্বীকার
৩০০ টাকা দিয়ে শুরু হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা, সেটি এখন ২০ হাজার করেছে বর্তমান সরকার। এতে পরিবারের সদস্যদের কাছে বাড়তি গুরুত্ব পান মুক্তিযোদ্ধারা। তারা স্বাচ্ছন্দ্যে খরচ করতে পারেন সংসারের জন্য। ময়মনসিংহ জেলায় ৫ হাজার ৭৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পান। এ ছাড়া আমাদের চিকিৎসার জন্য সরকার আলাদা ব্যবস্থা করেছে। প্রতিটি উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স করে দেওয়া হয়েছে। যে কারণে মুক্তিযোদ্ধারা আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছেন। এ জন্য আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।

বিমল পাল থাকেন ময়মনসিংহ শহরের বলাশপুর মুক্তিযোদ্ধা আবাসন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত এক বাড়িতে। নগরীর থানারঘাট এলাকায় তার একটি দোকান আছে। দিনের বেশ কিছু সময় তিনি দোকানে বসেন। বাকি সময় তার ছেলেরা দোকান দেখেন। তিনি সময়-সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়েন তরুণ প্রজন্মের মাঝে ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে। পথে-পার্কে ফেরি করেন মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তাই তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্পের ফেরিওয়ালা’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। এ ছাড়া সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী কাজেও সরব উপস্থিতি রয়েছে এ বীর মুক্তিযোদ্ধার।

এনএ