বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন

‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে উজ্জীবিত হই। পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার পরে কোনোমতে জীবনরক্ষা করি। এরপরই পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নেই দেশকে পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত করতে যুদ্ধে যাব। মা-বাবাকে না জানিয়ে দূর সম্পর্কের নানা লালনের কাছ থেকে ১০০ টাকা নিয়ে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। জীবনবাজি রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছি।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশকে স্বাধীন করার জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে হাতে তুলে নিয়েছিলাম অস্ত্র। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। স্বাধীনতার জন্য যে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম, আজ জীবনের তাগিদে সেই হাতে চায়ের কেটলি ও কাপ। বিয়ের ৩০ বছরের সংসারে চা বিক্রি করে কেটে গেল ২৭ বছর।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের কাছে একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন।

মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কাটিগ্রামে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা মৃত ইমদাদুল হক। বর্তমানে তিনি এই গ্রামেই স্ত্রী শেফালী আক্তারকে নিয়ে একটি ভাঙা টিনের ঘরে কোনোমতে বসবাস করছেন। দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। ২৭ বছর ধরে চায়ের দোকান করে সংসার চালাচ্ছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

পরিবারের অভাব-অনটনের কারণে লেখাপড়া করতে পারেননি তিনি। যে কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কোথাও চাকরিও নিতে পারেননি। বেকার অবস্থায় কী করবেন, কীভাবে সংসারের হাল ধরবেন, এমন চিন্তায় জীবন হাতাশায় ভরে ওঠে। অবশেষে বেঁচে থাকার তাগিদে দেন চায়ের দোকান। চা বিক্রির অর্থ আর মুক্তিযোদ্ধা ভাতা দিয়েই কোনোমতে চলছে বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিনের সংসার।

মুক্তিযুদ্ধের যাওয়ার অনুপ্রেরণা

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে ঢাকার পোস্তগোলায় একটি ম্যাচ ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতেন বোরহান উদ্দিন। পরে ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের শুরু দিকে দেশে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। আওয়ামী লীগ করার কারণে চলে যায় তার চাকরি। পরে চলে আসেন নিজ বাড়ি মানিকগঞ্জের কাটিগ্রামে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাকবাহিনী তাদের বসতবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পরিবারের সদস্যরা খাল পাড়ি দিয়ে কোনোমতে জীবন বাঁচায়। তখনই বুঝতে পারেন দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে হবে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিনের প্রশিক্ষণ

পাকবাহিনীরা তাদের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তখন অন্যের বাড়িতে ভাত চেয়ে খাইতাম। মুক্তিবাহিনীতে যাব এ কথা মা-বাবাকে বলি নাই। কারণ বললে হয়তো আমাকে যুদ্ধে যেতে দিত না। মা-বাবকে না জানিয়ে দূর সম্পর্কের নানা লালনের কাছ থেকে ১০০ টাকা ধার নিয়ে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। বাজার থেকে প্রথমে রাজিবপুর ইলাহি মাস্টারের বাড়িতে যাই।

মানিকগঞ্জে তখন ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে দলে দলে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমরা প্রায় ২০ থেকে ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা তার কাছ থেকে রোড ম্যাপের চিরকুট নেই। তারপর ইলাহি মাস্টারের বাড়ি থেকে ভোরে আটিগ্রাম যাই। ১৯৭১ সালের মে মাসের ১৮ তারিখে মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেওয়ার জন্য ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য রওনা হই। আটিগ্রাম থেকে লঞ্চে করে প্রথমে সাভার, তারপর ঢাকার সদরঘাট হয়ে গুলিস্তান শাঁখারীবাজারে যাই।

ঢাকা পোস্টের প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন

শাঁখারীবাজারে যাওয়ার পরে দেখি ২০ থেকে ২৫ জনের মধ্য আমরা মাত্র ৭ থেকে ৮ জন। পরে সবাইকে নিয়ে ডেমরা ফেরি পার হয়ে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরের শেষ এলাকা বোদ্দেরবাজারে পৌঁছাই। এরপর সেখান থেকে নৌকা নিয়ে যাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তারপর বর্ডার পার হয়ে ভারতের আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছাই।

কার অধীনে প্রশিক্ষণ

১৯৭১ সালের ২৫ মে (আনুমানিক) ভারতের আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে পৌঁছাই। সেখানে কয়েকদিন পার হলেও আমাদের প্রশিক্ষণে পাঠায় না। পরে ক্যাম্পের একজনকে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী দেওয়া চিরকুট দেখাই। এরপর মেলাঘর থেকে আমাদের পালাটোনায় পাঠানো হয়। পরে ক্যাপ্টেন সুজাদ আলী আমাদের নিয়ে যায়। পরে আগরতলায় মেজর হায়দারের নেতৃত্বে খেলাঘর ২ নং সেক্টর ক্যাম্পে এক মাস প্রশিক্ষণ নেই। সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ধর, মান সিং আমাদের প্রশিক্ষণ দেন। 

প্রশিক্ষণ শেষে পালাটোনা থেকে আমাদের মেলাঘর নিয়ে আসে। এরপর সেখান থেকে ট্রাকে করে বর্ডারের কাছাকাছি নামিয়ে দেয়। সারারাত হেঁটে বর্ডার পার বাংলাদেশে প্রবেশ করি। সেখানে হালকা খাবার খেয়ে নৌকায় করে মুন্সিগঞ্জ হয়ে মানিকগঞ্জের চলে আসি। প্রশিক্ষণ শেষে দেশের ফেরার সময়ও অনেক প্রতিবন্ধকতা পার করতে হয়েছে। 

যুদ্ধকালীন সেক্টর ও যে কমান্ডারের অধীনে যুদ্ধ

প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে মানিকগঞ্জ আসেন। এরপর ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর হায়দারের নেতৃত্বে আঞ্চলিক কমান্ডার ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন তিনি। ২ নং সেক্টরের মানিকগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলের ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চৌধুরীর বাহিনীর থানা কমান্ডার দেওয়ান শফি মাস্টার তাদের যুদ্ধক্ষেত্র ভাগ করে দেন। থানা কমান্ডারের কথামতো মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার দাসকান্দি এলাকায় চেকপোস্ট বসান তারা। কারণ সেখান দিয়ে পাকসেনারা চলাচল করত।

নিজের চায়ের দোকানে বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন

চেকপোস্ট বসিয়ে রাতভর পাহারা দেওয়ার পরে ভোরের দিকে শিবালয় থানা থেকে এসে পাকবাহিনী তাদের ওপর হামলা চালায়। পরে পাকবাহিনীদের লক্ষ করে তারাও গুলি ছোড়েন। দাসকান্দিতে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ করেন তিনি। প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পরে পাকসেনাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হন। এ সময় অনেক পাকসেনা নিহত হয়। পরে তারা মৃতদের কাঁধে করে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। এরপর তিনিসহ মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পে দাসকান্দি ক্যাম্পে চলে যান। এরপর দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ক্যাপ্টেন আব্দুল হালিম চোধুরীর কাছে মানিকগঞ্জ পিটিআিই ক্যাম্পে অস্ত্র জামা দেন বোরহান। 

সহযোদ্ধাদের নিযে স্মৃতিচারণ

মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ভারতের আগরতলার মেলাঘর ক্যাম্পে যাওয়ার সময় আমার সহযোদ্ধা যারা ছিলেন সবাই অনেক সাহসী ও ভালো মানসিকতার ছিলো। মেলাঘরের ক্যাম্পে খাওয়া-দাওয়ার অনেক কষ্ট হলেও সবাই হাসি-খুশি মনে থাকতাম। দিন-রাত বৃষ্টিতে ভিজে প্রশিক্ষণ করার পরেও কারও মুখ থেকে কষ্টের কথা শুনিনি। সবার চোখে-মুখে শুধু দেশ স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখতে পেতাম। 

বোরহান উদ্দিন বলেন, দাসকান্দি এলাকায় পাকিস্তান বাহিনীদের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ চলাকালীন কেউ শহীদ না হলেও তার সহযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাকের কোমরে গুলি লাগে। পাকবাহিনীকে পরাস্ত করার পরে রাজ্জাকে কে যেন নিয়ে যায়। পরে শুনেছেন ওর (রাজ্জাক) কোমরের গুলি বের করার জন্য ভারতে পাঠানো হয়। 

বোরহান উদ্দিনের বর্তমান অবস্থা

মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের কাটিগ্রাম এলাকায় তিন শতক জমিরে ওপর দোচালা টিনের ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিন। স্ত্রী শেফালি আক্তার, দুটি মেয়ে সুমি আক্তার ও শান্তা ইসলাম স্মৃতি এবং ছেলে সিফাত হোসেন নিয়ে তার সংসার। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আর ছেলে সিফাত ৪ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করছেন।

রাস্তার পাশে সরকারি জায়গায় টিনের ঘর তুলে চায়ের দোকান দেন বোরহান উদ্দিন

লেখাপড়া কম জানার কারণে কোথাও চাকরি হয়নি তার। সংসারের চাহিদা মেটানোর জন্য কাটিগ্রাম বাজারে রাস্তার পাশে সরকারি একটি জায়গায় টিনের ঘর তুলে দেন চায়ের দোকান। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও সংসাররের অভাব অনটনের ২৭ বছর ধরে চা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন বোরহান। তবে চা বিক্রির আয় দিয়ে দুই মেয়েকে বিয়েও দিয়েছেন।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চা বিক্রি করেন বোরহান। তার সময়ে যুদ্ধে যাওয়া অনেক মুক্তিযোদ্ধা অন্য পেশায় ভাগ্যের বদল করতে পারলেও লেখাপড়া কম জানার কারণে তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই প্রতিদিনের চা বিক্রির আয় আর মাস শেষে ভাতার টাকা দিয়ে কোনোমতে তিনি পার করছেন জীবন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শেষ চাওয়া

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অনেক করেছেন। একসময় প্রতিমাসে ভাতা পেতাম ৩০০ টাকা, আর এখন পাই ২০ হাজার টাকা। এজন্য তার প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি, গৃহহীন ও ভূমিহীনদের জন্য আবাসন সুবিধাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সরকার। একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যাওয়ার পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে যে সম্মান দেওয়া হয়, তা আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।

বর্তমানে সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের যে বাড়ি-ঘর দেওয়া হচ্ছে, তা ৪ শতাংশ জায়গা না থাকলে দেওয়ার নিয়ম নেই। তবে নিজের মাত্র ৩ শতাংশ জায়গা রয়েছে তার। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাছে তার এই ৩ শতাংশ জায়গার ওপর একটি বাড়ি করে দেওয়ার দাবি করেন তিনি। শেষ বয়সে এসে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটিই শেষ চাওয়া বলে জানান বোরহান উদ্দিন।

একসময় দেশ স্বাধীন করতে হাতে নিয়েছিলেন অস্ত্র, এখন জীবন বাঁচাতে হাতে নিয়েছেন কেটলি

জেলা প্রশাসক আব্দুল লতিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানিকগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা অনেক ভালো আছেন। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যে সকল সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সেই সুযোগ-সুবিধা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধিও পাচ্ছে। সেই হিসেবে জেলার কোনো মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসার অভাবে বা অন্য কোনো সমস্যায় রয়েছে এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। তবে কোনো মুক্তিযোদ্ধার যেকোনো সমস্যা বা অসুবিধায় আছেন এমন খবর পাওয়া মাত্রই আমরা সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।

তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বোরহান উদ্দিনের যে বিষয়টি শুনেছি। তিনি একজন ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া তার একটি ছেলে পুলিশে চাকরিও করছেন। তার ঘরের বিষয়ে আমারা তালিকা করে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছি। কিন্তু ঘর দেওয়ার ক্ষেত্রে ৪ শতাংশ জমি লাগে, তার আছে ৩ শতাংশ জমি। জমির জটিলতার কারণে ঘরটি বাস্তবায়নে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে।

উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তথ্য অনুযায়ী মানিকগঞ্জে বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ১ হাজার ৮৭৭ জন। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সাধারণ শাখার তথ্যমতে, জেলায় ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ হাজার ৮৬৬ জন।

এমএসআর