পুরো রেল ছিল তখন বিহারিদের দখলে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজবাড়ীতে প্রবেশের পর বিহারিরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে নির্বিচারে জ্বালাও-পোড়াও ও গণহত্যা শুরু করে। ৬ ডিসেম্বরের পর থেকে অতিমাত্রায় তৎপর হয় ওঠে বিহারিরা। পুরো রাজবাড়ী শহর দখলে নেয় তারা। ৯ ডিসেম্বর শহরের লক্ষ্মীকোল এলাকায় বিহারিদের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ হয়। ওই দিন বিহারিদের গুলিতে রফিক, শফিক ও সাদিক শহীদ হন।

সারা দেশ যখন বিজয়ের আনন্দে উল্লসিত, সৈয়দ খামারের জল্লাদ বাহিনী তখনো স্টেশন রোডের টর্চার সেলে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করছিল। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর রাজবাড়ীর আকুয়ার বিল্ডিংয়ে নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে নির্মম অত্যাচার করা হতো এখানে। অনেককে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে। এ অত্যাচারের বিবরণ শুনে আজও শিউরে উঠি।

ঢাকা পোস্টের কাছে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে রণাঙ্গনের রোমহর্ষক সব ঘটনার স্মৃতিচারণা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. কামরুল হাসান লালী। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে এই বীর সেনানীর জীবনকাহিনি।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার গল্প
নিজের মধ্যে থাকা দেশপ্রেম ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। ১৯৭১ সালে আমি ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। বাবা চাকরি করতেন ময়মনসিংহে। সেই সুবাদে ময়মনসিংহেই থাকা হতো। ওখানেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করি। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বাবার কর্মস্থল ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে নানার বাড়ি রাজবাড়ীর উদ্দেশে রওনা হই। ২৫ মার্চ রাতে বরাট ইউনিয়নের গোপালবাড়ি পৌঁছাই। তখনো আমি ২৫ মার্চের বিভীষিকাময় কালো রাতের কথা জানি না।

২৬ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রেডিও চালু করতেই মুক্তিযুদ্ধের ডাক শুনি ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে’। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে এ কথা শুনে নানা বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে রাজবাড়ী চলে আসি। ওই দিন মার্শাল ল জারি হয়। সেখান থেকে আমি সোজা ভারতের বিহারের চাকুলিয়ায় প্রথম ব্যাচে ট্রেনিংয়ে যোগ দিই। ট্রেনিং শেষে ৭ নং সেক্টরে যোগদান করি। সেখানে কিছু মতদ্বৈধতার কারণে আমি ৮ নং সেক্টরে চলে আসি। সেখানে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন রাজবাড়ীর খানখানাপুরের কৃতী সন্তান আবু আহম্মদ চৌধুরী। তার নেতৃত্বেই যুদ্ধ করি।

পরে তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। পরবর্তী কমান্ডার হন মেজর ম আ মঞ্জুর। আমরা হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে গেরিলা যুদ্ধ করি। আমার বাড়ি রাজবাড়ীতে হওয়ায় কমান্ডার মেজর ম আ মঞ্জুর আমাকে রাজবাড়ীতে পাঠিয়ে দেন।

তারপর রাজবাড়ীতে মো. শহীদুন-নবী আলম, ফকীর আব্দুল জব্বার, মো. ইলিয়াস মিয়া, মো. সিরাজ আহম্মেদ, মো. আবুল হাসেম বাকাউল, আবদুল মোতালেব হিরু, সিরাজ আহাম্মেদ ও জলিল মাস্টার, পাংশার মতিন একসঙ্গে যুদ্ধ করি।

যুদ্ধের রোমহর্ষক স্মৃতিচারণা
১৩ ডিসেম্বর বিহারিরা বিনোদপুর বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রহরীকে হত্যা করে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও রাজবাড়ী শহর তখনো বিহারিদের কবল থেকে মুক্ত হয়নি। তাই রাজবাড়ীকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আক্রমণ আরও বেগবান করার জন্য যৌথ কমান্ড গঠন করা হয়। পরে ১৭ ডিসেম্বর আমি, কামরুল হাসান লালী, ফকির আব্দুল জব্বার, মো. ইলিয়াস মিয়া, মো. সিরাজ আহম্মেদ, মো. আবুল হাসেম বাকাউল, কামরুল হাসান লালী, শহীদুন-নবী আলম, আবদুল মোতালেব হিরু, সিরাজ আহাম্মেদ ও জলিল মাস্টারের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিহারিদের ক্যাম্প ঘিরে রাখি। শুরু হয় তাদের সঙ্গে আমাদের তুমুল যুদ্ধ। এ সময় শতাধিক বিহারিকে খতম করি। পরের দিন ১৮ ডিসেম্বর কয়েক হাজার বিহারি আত্মসমর্পণ করে। রাজবাড়ী হয় স্বাধীন।

সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণা
দেশ শত্রুমুক্ত হয় ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ, কিন্তু আমাদের রাজবাড়ী শত্রুমুক্ত হয় ১৮ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হওয়ার খবর তখনো আমরা পাইনি। তখন আমরা যুদ্ধ করে যাচ্ছিলাম রাজবাড়ীকে শত্রুমুক্ত করার জন্য। যখন একে একে সব মিশন শেষ করে সর্বশেষ একটা মিশনে নেমেছিলাম। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর একটা বুলেট খুশির বুকে গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মারা যায়। আজ তার নামে রাজবাড়ীতে শহীদ খুশি রেলওয়ে ময়দান রয়েছে। ওখানে গেলে আমার তার কথা খুব মনে পড়ে। সহযোদ্ধারা ফেরেশতার মতোন ছিল। তারা আমাকে ঘিরে রাখত যাতে আমার কোনো ক্ষতি না হয়। আই স্যালুট দেম। সহযোদ্ধা ছাড়াও অনেক কৃষক, কাঠুরিয়া আমাদের পাশে থেকেছেন। যারা খাবার দিয়েছেন, তারাও আমার কাছে সহযোদ্ধা। বছরে ৩৬৪ দিন আমরা অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকি। মাত্র একটি গুলির ব্যাপার ছিল। বয়স হয়েছে। সব স্মৃতি তো মনে নেই।

মুক্তিযোদ্ধারা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন্তান
বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. কামরুল হাসান লালী বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। দীর্ঘ ৯ মাস তাদের অবদানের কারণেই আজ আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র। কোনো চাওয়া-পাওয়া থেকে নয়, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়েই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। নিজের ও তাদের পরিবারের কথা না ভেবে ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অস্ত্র হাতে অংশ নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন।

তরুণ প্রজন্মের প্রতি পরামর্শ
তরুণ প্রজন্মের কাছে চাওয়া-পাওয়া বলতে এটাই যে তারা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানুক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তারা ধারণ করুক। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তারা সম্মান দিক। একটি দেশ কীভাবে পরাধীন থেকে স্বাধীন হলো, তা হৃদয়ে ধারণ করলে দেশের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বাড়বে।

মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে রাজনীতি বন্ধ হোক
অর্থ দিয়ে, কোটা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেওয়া যাবে না। কারণ, এটা সে জিনিস না। যে সরকারই থাকুক বা তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান না দিক, কিন্তু কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে অসম্মান করার কোনো অধিকার তাদের নেই। এ দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে ছিল। আমি মনে করি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা জামুকায় যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই দুর্নীতিত জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। ডিও লেটার দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়। একটা লোককে বারবার যাচাই-বাছাই কমিটি থেকে বাতিল করা হয়। তারপর সে মুক্তিযোদ্ধা হয়। রাজবাড়ীতে অনেক স্বঘোষিত কমান্ডার তৈরি হয়েছে। এই প্রজন্মের কাছে আমার চাওয়া, মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হোক। মুক্তিযোদ্ধাদের নামে সব ধরনের রাজনৈতিক ব্যবসা বন্ধ করা হোক। সত্যিকার অর্থে যে কৃষক মুক্তিযোদ্ধা, সে কি ইউএনও/ডিসি অফিসে প্রবেশ করতে পারে? পারে না। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভিন্ন দফতরে প্রবেশ করে। একটা স্বাধীনতার জন্য শতাব্দীর পর শতাব্দী অপেক্ষ করতে হয়। কিন্তু আমরা অনেক সৌভাগ্যবান যে মাত্র ৯ পাশে দেশ স্বাধীন করতে পারলাম।

কেমন আছেন মুক্তিযোদ্ধারা
অনেকেই বলে মুক্তিযোদ্ধারা ভালো আছেন। কিন্তু বাস্তবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা ভালো নেই। যারা মুক্তিযুদ্ধ না করেই মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, সার্টিফিকেট নিয়েছে, তারাই ভালো রয়েছে। যখন অমুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সামনে এসে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে, তখন কষ্ট লাগে। সরকারদলীয় এমপির ডিও লেটারে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হয়। এর থেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কষ্টের আর কী হতে পারে। তবে অনেক কৃষক-শ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তাদের ভাতার পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেটা ভালো দিক। কষ্টের জায়গা হলো দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কথা কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসেও মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়ছে। এর থেকে কষ্টের আর কিছু হতে পারে না।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ রাজবাড়ী সদর উপজেলা ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জলিল মাস্টার ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজবাড়ী জেলায় মোট ১ হাজার ২৪৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে। তার মধ্যে সদর উপজেলায় ৩৬৯ জন, গোয়ালন্দে ১১৩ জন, বালিয়াকান্দিতে ২৩২ জন, কালুখালিতে ১৪৯ জন এবং পাংশায় ৩৮২ জন। ১ হাজার ২৪৫ জনের মধ্যে ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন প্রায় সাড়ে ১১০০-এর মতো। বাকি মুক্তিযোদ্ধারাও ভাতার আওতায় চলে আসবেন।

তিনি আরও বলেন, করোনাকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের ভাতার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের গৃহনির্মাণ করে দিয়েছেন। এ জন্য তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। তবে অনেক অবৈধ লোক সরকারদলীয় এমপি-মন্ত্রীর ডিও লেটার দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে যায়। তারা যখন আমাদের সামনে আসে, তখন আমাদের মতো প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের লজ্জা হয়।

অধ্যাপক ড. আব্দুল লতিফ মিয়ান ও আমেনা লতিফ দম্পতির সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল হাসান লালীর জন্ম ১৯৫২ সালে, রাজবাড়ীর শীতলপুরে। ৬ ভাইয়ের মধ্যে তিনিই সবার বড়। যুদ্ধের সময় ১৯ বছরের তরতাজা এক যুবক কামরুল হাসান লালী। বরাট ভাকলা স্কুল থেকে প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মোমেনশাহী ক্যাডেট স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখান থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শেষ করেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনি।

যুদ্ধ শেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। যুদ্ধকালীন তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমার জেলার ডেল্টা কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন রণাঙ্গনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।

এনএ