বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুল আলম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে নন-ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন

আগস্ট মাস। যুদ্ধের ময়দান ভীষণ উত্তপ্ত। পাল্টাপাল্টি আক্রমণ। আমাদের টার্গেট ক্যান্টমেন্ট আক্রমণ করা। সেখান থেকেই পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিল। এ সময় আমাদের পরিকল্পনার সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় মিত্র বাহিনী। গভীর রাত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ক্যান্টমেন্টের চারপাশ আমরা ঘেরাও করি।

আমাদের সহযোগী ভারতীয় মিত্র বাহিনী কামানের শেল দিয়ে রাত থেকেই আক্রমণ শুরু করে। একপর্যায়ে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। লাশের ওপর লাশ পড়তে থাকে। আমাদের অনেক সহযোদ্ধা শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ধানখেতে তিন দিন অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম আমি। জ্ঞান ফিরে আশপাশে তাকিয়ে দেখি লাশের ওপর চিল-শকুনের হাট বসেছে। কী ভয়াবহ দৃশ্য।

এভাবেই একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সামছুল আলম। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ৫০ বছর আগের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আদ্যোপান্ত জানান তিনি।

কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই রণাঙ্গনে নিজের জীবন বাজি রেখে শোষণ-বৈষম্যহীন একখণ্ড স্বাধীন মাতৃভূমি ও একটা পতাকার জন্য যুদ্ধ গিয়েছিলেন সামছুল আলম। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে এই রণবীরের জীবনকাহিনি।

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে চাকরি ও বিদ্রোহ ঘোষণা
একাত্তরে বাঙালি যুবক সামছুল আলম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। যার জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাকে অস্ত্র চালাতে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে হয়নি। সারাদেশে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, শাসন আর নিপীড়ন সামছুলের মনকে নাড়া দেয়। প্রতিদিন বর্বর এ পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ আর নিরীহ বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচারে নিভৃতে কাঁদতেন তিনি। অবশেষে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পোশাক ছুড়ে ফেলেন। পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু বাঙালি সেনাসদস্যকে সঙ্গে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে তিনি অংশ নেন মহান মুক্তিযুদ্ধে।

ঢাকা পোস্টকে সামছুল আলম বলেন, চোখ বন্ধ করে ৫০ বছর আগের সেই দিনটির কথা ভাবলেই শরীর এখনো শিউরে ওঠে। বাবার মুখে ব্রিটিশ শাসন আর পাকিস্তানি শোষণের কথা শুনতাম। তখন আমি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে নন-ক্যাডারভুক্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলাম। নিজের চোখে পাকিস্তান সেনাদের একটার পর একটা ঘৃণীত ঘটনা দেখেছি, বুকটা আঁতকে উঠত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুনে ভীষণ অনুপ্রেরণা পেয়েছি। মনের মধ্যে সাহস সঞ্চার হয়েছিল। বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের কথা শুনে কাঁদতাম। অনেক ভেবেচিন্তে বিদ্রোহ ঘোষণা করি। ৯ মাসের যুদ্ধের কথা নয়-দশ মিনিটের বলা সম্ভব না।

তিনি আরও বলেন, সাধারণ মানুষের মতো আমরা নিজের জীবন বাঁচাতে ছোটাছুটি করিনি। আমরা যখন যুদ্ধে, তখন মনে করতাম আজই হয়তো জীবনের শেষ দিন। গোসল, খাওয়াদাওয়া, ঘুম, নিরাপত্তা কিছুই ছিল না। আমাদের সবার মধ্যে তখন কাজ করছে প্রতিরোধ গড়ে প্রতিশোধের স্পৃহা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে শেষ না করে আমরা কখনো শিবিরে (তাঁবু ক্যাম্পে) ফিরে যায়নি।

পরিবারকে না জানিয়ে চাকরি ছেড়ে যুদ্ধে
সামছুল আলমের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার বিষয়টি তার পরিবারের প্রথমে অজানা ছিল। কারণ, পরিবারের কাউকে চাকরি ছেড়ে বিদ্রোহী হয়ে ওঠার কথা জানাননি তিনি। তাই প্রিয় মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন কারও কাছ থেকেই তার বিদায় নেওয়ার পরিবেশ হয়নি।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, তখন একমুহূর্তের জন্য সময় নষ্ট করার সুযোগ দেখিনি। মনে হয়েছিল যতক্ষণ দেহে প্রাণ আছে লড়েই যাব। আমি স্বশস্ত্র বাহিনীতে থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে চলে যাই। যুদ্ধে যাওয়ার সময় পরিবারের কাউকে কিছু বলা হয়নি। কারও সঙ্গে দেখাও করিনি। ভেবেছিলাম যদি বেঁচে থাকি, তাহলে মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে। নয়তো দেশের জন্য শহীদ হব।

রণাঙ্গনে সেক্টর ও যুদ্ধক্ষেত্র
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একেকটি সেক্টরকে আবার বেশ কয়েকটি সাব-সেক্টরে আলাদা করে একজন অধিনায়কের দায়িত্বে হস্তান্তর করা হয়। এটি ছিল যুদ্ধ পরিচালনার একটি সামরিক কৌশল।

সামছুল আলম অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের মতো যুদ্ধের জন্য আলাদাভাবে কোনো প্রশিক্ষণ নেননি। তিনি সরাসরি ৭ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। দিনাজপুরের দক্ষিণাঞ্চল, বগুড়া, রাজশাহী ও পাবনা জেলা ইপিআর সেনাবাহিনী নিয়ে গঠিত হয় এ সেক্টরটি। বালুরঘাটের নিকটবর্তী তরঙ্গপুরে অবস্থিত ছিল এ সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। ক্যাপ্টেন গিয়াস ও ক্যাপ্টেন রশিদের নেতৃত্বে রাজশাহীতে প্রাথমিক অভিযান চালায় এ বাহিনী।

শুরুর দিকে ৭ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর নাজমুল হক। তিনি একাত্তরের ১০ এপ্রিল থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নেতৃত্ব দেন। ২৭ সেপ্টেম্বর মিত্র বাহিনীর সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক শেষে ভারতের শিলিগুড়ি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফেরার পথে মেজর নাজমুল হক দুর্ঘটনায় মারা যান। এরপর মেজর কাজী নূরুজ্জামান দায়িত্ব পালন করেন।

সামছুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আলাদাভাবে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিতে পারিনি। বরং অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে আমি নিজে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। শুরুতে ময়মনসিংহ এবং সবশেষে দিনাজপুর জেলায় যুদ্ধ করেছি। আমার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নূরুজ্জামান (বীর উত্তম)। তার নির্দেশনায় আমরা অন্তত ৪০টি জায়গায় যুদ্ধ করি। হিলিতে আমি নিজে একটা সাব-সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছি। কয়েকটি অতর্কিত আক্রমণ ও পার্বতীপুরের কাছে একটি ট্রেন বিধ্বস্তে সাহসী ভূমিকা ছিল আমাদের সেক্টর সৈন্যদের।

রণাঙ্গনের রোমহর্ষক স্মৃতি
দিনরাতে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া নেই। কত দিন ধরে নাওয়া-গোসল নেই, তা-ও মনে পড়ত না। এতটা পরিবর্তন হয়েছিল চেহারার যে হঠাৎ কেউ দেখলে চিনতে পারত না। ঠিকমতো রাতে ঘুমানো হয়নি। দাড়ি-গোঁফ কাটার সুযোগ হয়নি। আমাদের সবার চোখে শুধু আক্রমণের নেশা। পাকিস্তানি সেনাদের খতম করতেই পারলেই যেন সব ক্ষুধা মিটে যায়।

সামছুল আলম বলেন, জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশটাকে স্বাধীন করার স্বপ্নই ছিল আমাদের উদ্দেশ্য। কখনো যুদ্ধ থেকে বেঁচে ফিরব, এটা ভাবিনি। পাকিস্তান আর্মির একটি ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করার জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। হেডকোয়ার্টারটি ছিল ময়মনসিংহের ধানুয়া কামালপুরে। পাকিস্তানিরা সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার পরিকল্পনা করত।

আগস্ট মাসে আমরা সেই ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করি। রাতের বেলায় ক্যান্টনমেন্টের চারদিক ঘেরাও করি। সেখানে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় মিত্র বাহিনী ছিল। তারা কামানের শেল দিয়ে রাত থেকেই আক্রমণ শুরু করে, যাতে পাকিস্তানি সেনারা চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। পলায়নরত সেনাদের যাতে আমরা হত্যা করতে পারি তাই আমরা ব্যারাকের মধ্যে বসে পড়ি। শুরু হয় সামনাসামনি যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমার দুপাশে অনেক সহকর্মী মারা যায়। সৌভাগ্যক্রমে আমি বেঁচে যাই।

সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। রক্ত ঝরছিল, দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে না পেরে আমি একটা ধানখেতে শুয়ে পড়ি। সেখানে গুলিবিদ্ধ অচেতন অবস্থায় তিন দিন কেটে যায়। আমার জ্ঞান ফিরলে আশপাশে তাকিয়ে দেখি মানুষের লাশের ওপর চিল-শকুনের ঝাঁক। শরীর থেকে মাংস খুঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে। সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে আমি সুস্থ হয়ে আবার দলে ফিরে যাই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৭ নম্বর সেক্টর অধীনে হিলিতে (হাকিমপুর) অনেক বড় একটি সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয়।

তিনি বলেন, শত্রুকে খতম করে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামের দিকে রওনা হই। দীর্ঘ ৯ মাস পর বাড়ি পৌঁছালে মা-বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। শত শত মানুষ আমাকে দেখতে আসেন। তাদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছিলাম, তা চিরস্মরণীয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা ও প্রাপ্তি
বর্তমান সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধারা ভালো আছেন বলে দাবি সামছুল আলমের। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ও আমরা মুক্তিযোদ্ধা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি ভালো আছি। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সামাজিক মর্যাদা, প্রশাসনিক সহায়তা, চিকিৎসাপ্রাপ্তিসহ মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি ও কর্ম নিশ্চয়তা এখনো পুরোপুরিভাবে ব্যবস্থা করা হয়নি। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যেসব পরিকল্পনা নিয়েছে, তার কিছুটা বাস্তবায়ন হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, হাকিমপুর উপজেলার মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১০৩ জন, সবই সরকারি সুবিধাপ্রাপ্ত। প্রতি মাসে সরকারিভাবে তাদের ভাতা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ৪৫ জন, জীবিত ৫৮ জনের মধ্যে কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধা এখনো অসচ্ছল রয়েছেন। সরকার তাদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থা করছে। বাদ পড়া কিছু মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় ওঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, সামছুল আলম ১৯৫১ সালের ২২ নভেম্বর দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার দক্ষিণ বাসুদেবপুর গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৃত খুরশিদ আলম মন্ডল, মা রাহেজান বিবি। তিনি বর্তমানে হাকিমপুর পৌর এলাকায় বসবাস করছেন। তার তিন ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছেন। সবাই কর্মহীন। সামছুল আলম যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি করেন।

এনএ