বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা

রাজা বাহিনী। ৩০ জন থেকে হাজারজনের দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন বরেন্দ্রখ্যাত রাজশাহী অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর ত্রাস ছিল ‘রাজা বাহিনী’।

জেলার পবা, তানোর, গোদাগাড়ী, মোহনপুর, নওগাঁ ও নিয়ামতপুরসহ আশপাশের এলাকায় একাধিক সফল গেরিলা অপারেশন চালিয়েছে এই বাহিনী। হালকা অস্ত্র নিয়ে সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে লড়েছে সম্মুখ লড়াইয়ে। রাতের আঁধারে গুড়িয়ে দিয়েছে মোহনপুরের কুখ্যাত সাঁকোয়া ক্যাম্প।

তানোর থানায় আক্রমণ করে ছিনিয়ে এনেছে পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়া গেরিলা সহযোদ্ধাদের। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের মুখে মুখে আজও জাগ্রত রাজা বাহিনীর বীরত্বগাথার কথা।

রাজা বাহিনীর প্রধান ছিলেন সফিকুর রহমান রাজা। রণাঙ্গনের লড়াকু এই যোদ্ধা এখন পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বিছানায়। তবুও আগুন ঝরা কণ্ঠ তার। মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো এখনও ভেসে ওঠে তার স্মৃতিপটে। 

জন্ম ও বেড়ে ওঠা :

রাজার জন্ম চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট গোপালনগর এলাকায়। তার বাবা মরহুম মোতাহার হোসেন ছিলেন অভিভক্ত বাংলার সেরিকালচার বিভাগের কর্মকর্তা। দেশ বিভাগের পর তার চাকরি পাকিস্তানে হয়। ওই সময়ে থেকেই তিনি পরিবার নিয়ে রাজশাহীতে চলে আসেন। নগরীর আলুপট্টি এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। প্রমত্ত পদ্মাপাড়েই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন।

ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে রাজা ছিলেন চতুর্থ। ১৯৬৬ সালে রাজশাহীর মুসলিম হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৮ সালে গভ. ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ) থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭২ সালে অনার্স পাস করেন।

নগরীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা। সেখানেই কথা হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। বাসার একটি কামরায় মেডিকেল বিছানা। তাতে আধশোয়া হয়ে রয়েছেন রাজা। ঘরে ঢুকতেই কানে এল রবীন্দ্র সংগীত। তিনি জানালেন, রবীন্দ্র-নজরুলের গান তার ভীষণ প্রিয়। বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানও শোনেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা :

বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিকুর রহমান রাজা জানান, ১৯৭১ সালে তিনি অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিভার্সিটি ট্রেনিং কোর বা ইউটিসি সদস্য ছিলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অধীনে বেশ কিছু ট্রেনিংও করেছেন। ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন না সরাসরি, কিন্তু ছিলেন রাজনীতি সচেতন। অনেকের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ট যোগাযোগ।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর উত্তাল হয়ে ওঠে রাজশাহী। মুক্তিকামী ছাত্রজনতা এক হতে শুরু করে। তিনি থাকতেন শহরের মধ্যভাগে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সংবাদিক মাহতাব উদ্দিনের সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন তিনি। তারা ধরেই নিয়েছিলেন, প্রতিরোধ যুদ্ধ অনিবার্য। এজন্য অস্ত্রের সন্ধানে ঘুরছিলেন তারা। নগরীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে ঘুরে খোঁজ নিচ্ছিলেন কেউ সংগঠিত হচ্ছে কি না।

মার্চের শেষের দিকে রাজশাহী কারাগার ভেঙে কয়েদিরা বেরিয়ে এল। ওই সময় কিছু রাজনৈতিক নেতাও সেখানে বন্দি ছিলেন। তারাও বেরিয়ে এলেন সেদিন। খবর পেয়ে তিনি পদ্মার বাঁধ ধরে জেলখানার দিকে এগুচ্ছিলেন। সেখানে বেড়ি পরা দুইজন তাকে দেখে সাহায্য চান। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তিনি দেখলেন, তারা তাকেই অনুসরণ করছেন।

আলুপট্টির সূর্যশিখা গানের স্কুলে তাদের নিয়ে গিয়ে উঠলেন। দুজনের একজন ছিলেন কাজি সিরাজুল ইসলাম। একেবারেই খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বেরিয়ে এসেছিলেন জেলখানা থেকে। লুকিয়ে মেজো ভাইয়ের জামা-প্যান্ট তাকে এনে দেন। কাজি সিরাজুল ইসলাম তাদের ভারতে যাওয়ার আহ্বান জানান। প্রতিশ্রুতি দেন অস্ত্রের জোগান দেওয়ার। তাকে সোর্স হিসেবে ধরেই নগরীর পাঁচানি মাঠের ইদ্রিসের মাধ্যমে পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারতে পাঠিয়ে দেন।

রাজা আরও জানান, মার্চের শেষের দিকে নগরীর পশ্চিমাঞ্চলে কিছু সিভিলিয়ান, কিছু আনসার যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হচ্ছিলেন। নওগাঁয় ইপিআরএর সেকেন্ড উইং কমান্ডার ছিলেন মেজর গিয়াস। তিনি নগরীর পশ্চিম পাশে রায়পাড়ায় এসে অবস্থান নেন।

অন্যদিকে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে ক্যাপ্টেন রশিদ অবস্থান নেন শহরের পূর্বাংশে। পদ্মার চরের বিওপি থেকে বেরিয়ে আসা ইপিআর যোদ্ধারা তাদের সঙ্গে যোগ দেন সুবেদার লস্করের নেতৃত্বে। পাঞ্জাবিদের মেরে অস্ত্রসস্ত্র লুট করে আনেন তারা। তারাও যুক্ত হন ক্যাপ্টেন রশিদের সঙ্গে।

রাজা আরও বলেন, যুদ্ধ তখন অনিবার্য। যুদ্ধে অংশ নিতে মার্চের মাঝামাঝি তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। কোথায় যাচ্ছেন, কী উদ্দেশে যাচ্ছেন, কাউকে কিছুই জানাননি। কেউ বাধাও দেয়নি। একদম খালি হাতে এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়েন বাড়ি থেকে।

প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ :

একাত্তরের ২৮ মার্চ রাজশাহীর পুলিশ লাইন চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। পুলিশ লাইনে প্রবেশের চেষ্টা করলে তাদের প্রতিরোধ করেন বাঙাল পুলিশ যোদ্ধারা। সেখানে থেকে পুলিশ সুপার মামুন মাহমুদসহ কয়েকজন অফিসারকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। এই যুদ্ধকে রাজশাহীর প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ বলে উল্লেখ করেন এই গেরিলা যোদ্ধা।

এরপরই রাজশাহী উত্তাল হয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে তছনছ হয়ে যায় পাকিস্তানিদের ডেরা। তারা সেনানিবাসে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু ভারী অস্ত্র না থাকায় সেনানিবাসে আক্রমণ চালাতে পারেননি মুক্তিযোদ্ধারা। তারপরও ৭-১৩ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী শহর ‍শত্রুমুক্ত ছিল।

রাজা জানান, যুদ্ধের শুরুর দিকে তিনি এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহতাব উদ্দিন মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতেন। ওই সময় পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারতের শেখপাড়া কাতলামারি এলাকায় যান। সেখানে কংগ্রেসের এমএলএ ডা. আজিজের বাসায় গিয়ে ওঠেন। তিনি তাদের দেখেই উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন।

বহরমপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। জানালেন, তিনজন ব্রিটিশ সংবাদিক রাজশাহীর মুক্তাঞ্চলে যেতে চান। শুরুতে মাহাতাব উদ্দিন রাজি হচ্ছিলেন না। তিনি বললেন, জীবন তো দিয়েই দিয়েছি, আর চিন্তা করে কী লাভ। শেষে মাহাতাব উদ্দিনও রাজি হয়ে গেলেন।

বেলা ১১টার পর তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়ে রাজশাহীর উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লেন। মাথার উপর গনগনে সূর্য। মধ্য চরে এসে তিন সাংবাদিক ক্লান্ত হয়ে এক পর্যায়ে বসে পড়লেন। কিন্তু তারা তখনও ক্লান্তিহীন। মধ্যচরে তরমুজের আবাদ ছিল। সেই তরমুজ খেয়ে পরে ফের চলতে শুরু করলেন। সন্ধ্যা নাগাদ এসে পৌঁছালেন সার্কিট হাউস এলাকার পদ্মা বাঁধের ওপরে।

পদ্মা পাড়ে ইপিআর সেক্টর কমান্ডারের বাসভবন ছিল। যুদ্ধের শুরুতে সেটি দখলে নেয় মুক্তিযোদ্ধারা। পরে সেটি যোগাযোগ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হচ্ছিল। রাতের আঁধার ভেদ করে তারা সেখানেই গিয়ে ওঠেন। ওই রাতেই ব্যবস্থা করা হয় একটি ফাঁকা জিপ গাড়ির।ওই রাতেই পশ্চিমাঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সাংবাদিকরা মেজর গিয়াসের সাক্ষাৎকার নেন। ঘুরে ঘুরে নগরীর বিভিন্ন এলাকার চিত্রধারণ করেন। সকালেও কিছু চিত্র নেন। ততক্ষণে খবর এল পাকবাহিনী রাজশাহীর দিতে অগ্রসর হচ্ছে। সময় নষ্ট না করে পরদিন সকালে তারা নগরীর কল্পনা সিনেমা হল এলাকা দিয়ে পদ্মায় নামেন।

সম্ভবত দিনটি ছিল ১৩ এপ্রিল। পদ্মার চরে নামলে চারঘাটের সরদহ পর্যন্ত দেখা যায়। নেমেই দেখেন সরদহ জ্বলছে। লোকজন পিঁপড়ার সারির মতো পদ্মা পাড়ি দিয়ে ভারতে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য ধারণ করলেন ব্রিটিশ সাংবাদিকরা।

সেই দিন বিড়ালদহ এলাকায় ক্যাপ্টেন রশিদ ও সুবেদর লস্করসহ তাদের দল পাক আর্মিকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে রাজশাহীতে। তালাইমারিই তারা ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে। এক পর্যায়ে পুরো রাজশাহীর দখল নেই পাকিস্তানি বাহিনী। তখন গোদাগাড়ীর মহিশাল বাড়িতে অবস্থান নেন ক্যাপ্টেন গিয়াস।

রাজা জানান, ওই দিন ব্রিটিশ সাংবাদিকদের তারা নিরাপদেই ভারতে পৌঁছে দেন। সেখানে মাহতাব উদ্দিন থেকে গেলেও তিনি দেশে ফিরে আসেন। ভারতের লাল গোলা দিয়ে তিনি মহিষালবাড়িতে পৌঁছান। ১৯ এপ্রিল সেখানে সর্বশেষ যুদ্ধ হয়। সেখানেও সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে টিকতে পারেননি বীর মুক্তিযোদ্ধারা। শেষে মহানন্দা সাঁতরে তারা ফের ভারতে চলে যান।

গেরিলা যুদ্ধ :

গেরিলা যুদ্ধে জড়ানোর বিষয়েও জানান রাজা। তিনি বলেন, মে মাসের মাঝামাঝিতে মালদায় কাজি সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে আবার দেখা হলো। তিনি জানালেন, বিহারের চাকুলিয়ায় গেরিলায় ট্রেনিংয়ে লোক পাঠাচ্ছেন। আমাকে দায়িত্ব নিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। আমিও উন্মুখ ছিলেন, প্রস্তাব পাওয়া মাত্রই রওনা দিলাম।

চাকুলিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমানঘাঁটি ছিল। ছিল পরিত্যক্ত রানওয়ে। জঙ্গল কেটে প্রথম সেখানে ক্যাম্প বসানো হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে গিয়ে সমাবেত হয়। চারটি প্লাটুন নিয়ে ফোর ইউং কোম্পানি গঠন করা হয়।  কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব পাই। সেখানে প্রায় দুই মাস চলে গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণে দুই শতাধিক বীর মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়। মূলত ব্রিজ-কার্লভার্ট, রেলাইন বিচ্ছিন্ন করার ট্রেনিং নিয়েছেন তারা। ব্যবহারিক প্রশিক্ষণও নিয়েছিলেন।

রাজা জানান, তিনি যখন দেশে ফিরলেন তখন নেতৃত্ব শূন্য পুরো অঞ্চল। মারাঠা রেজিমেন্টের আওতায় তাদের দেওয়া হলো। তাদের ৩৬ গ্রেনেড দিয়ে দেশে পাঠানোর কথা জানায় মিত্ররা। তিনি প্রতিবাদ করেন। বলেন, আমরা তো যুদ্ধ করে মরব, এটা আমরা জানি। আমরা আত্মঘাতি হয়ে মরতে চাই না। অনেক বির্তকের পর তিনটা পুরোনো স্টেনগান পাওয়া যায়। তা নিয়ে দেশে ফেরেন তারা। পরে মেজর গিয়াস সুস্থ হয়ে দেশে ফেরার পর আরও কিছু অস্ত্র পাওয়া যায়।

রাজশাহীতে গেরিলা যুদ্ধ শুরুর বিষয়টি উল্লেখ করে রাজা বলেন, প্রথম দিকে পাঁচজনকে কিছু গ্রেনেড দিয়ে বিদ্যুৎ অফিস ও কোর্ট উড়িয়ে আসতে বলা হয়। এ সময় তিনজন ফিরলেও দুজন আর ফেরেননি। প্রথম কয়েকটি অভিযানে একই ঘটনা ঘটে। পরে তিনি দলবল নিয়ে দেশে প্রবেশ করেন।

রাজা জানান, পবার পাথরঘাটা হয়ে তারা রাজশাহীতে প্রবেশ করেন। এরপর দামকুড়ায় পৌঁছান। সেখানকার লোকজন তাদের দেখে পালিয়ে যায়। লোকদের প্রশ্ন- গেরিলা কী? কনে গেরিলা? তারা বলেন, আমরা সেই গেরিলা না, আমরা মানুষ। যুদ্ধ করতে এসেছি। মাতৃভূমি মুক্ত করতে এসেছি।

 তিনি আরও বলেন, গেরিলা যুদ্ধের মূল মন্ত্র হামলা করো এবং পশ্চাৎভূমিতে পালিয়ে যাও। কিন্তু আমাদের কোনো পশ্চৎ ভূমি ছিল না। চারপাশে জনগণ এবং তাদের বাড়ি। আমরা এসে আশ্রয় পাইনি। আমরা প্রথমে পবার আদিবাসীদের ফেলে যাওয়া বাড়িতে আশ্রয় নেই। পরে সেখান থেকে আরও উত্তরে গিয়ে গোদাগাড়ীর সৈয়দপুরে অবস্থান নেই। এরপর শত্রু সেনাদের অবস্থান, যাতায়াতের ‍রুট চিহ্নিত করে টার্গেট করে যুদ্ধ হয়। সেখান থেকেই তানোর থানায় কয়েক দফা আক্রমণ হয়। সাঁকোয়া ক্যাম্প আক্রমণ করে গুঁড়িয়ে দেন গেরিলা যোদ্ধারা।

রাজা জানান, সাঁকোয়া ক্যাম্পে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজনসহ নিরীহ লোকজনকে ধরে এনে নির্যাতন চালাত। অনেককেই জীবন্ত সেখানে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। গণহত্যা হয়েছে। খবর পাওয়ার পর ২৬ নভেম্বর গভীর রাতে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সাঁকোয়া ক্যাম্পে আক্রমণ করেন তারা। ওই রাতে পুরো ক্যাম্প তছনছ করে দেন। বহু মানুষকে উদ্ধার করেন। অনেককেই অর্ধমৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

রাজা জানান, তানোর থানায় এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে ধরে এসে সেখানে আটকে রাখত পাকিস্তানি ও তাদের দোসররা। প্রতি রাতে সেখানে পাকিস্তানি আর্মির ট্রাক গিয়ে তাদের তুলে আনত জোহা হলে। সেখানে নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো।

দুয়ারি ও বাগধানি ব্রিজ হয়ে হানাদার বাহিনী তানোর থানায় যেত।  সেই ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেন গেরিলারা। তারা ব্রিজে বিস্ফোরক স্থাপন করবেন এমন সময় দারুশা রাস্তা দিয়ে এসে পাকিস্তানের সেনারা তাদের ঘিরে ধরে। ফায়ার ওপেন করার সময় গেরিলারাও পাল্টা যুদ্ধ শুরু করেন।

অস্ত্র বলতে তখন তাদের কাঁধে রাইফেল, এসএলআর ও এলএমজি ছিল। দুই ঘণ্টার যুদ্ধে গেরিলারা তছনছ হয়ে গেলেন। পিছু হটে যে যার মতো সৈয়দপুরে ফিরে যান। কিন্তু ছয়জনকে আর পাননি। দুপুর নাগাদ খবর আসে দুয়ারি ব্রিজে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আইয়ুবের নেতৃত্বে লোকজন তাদের ধরে ফেলে। ব্যাপক নির্যাতনের পর তাদের তানোর থানায় দেওয়া হয়।

রাজা বলেন, তাদের জোহা হলে নিয়ে গেলে মৃত্যু অনিবার্য। আবার তারা ছিলেন প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা। তথ্য জেনে যাওয়ারও শঙ্কা ছিল। তাই সব কিছু চিন্তা-ভাবনা করে তারা তানোর থানা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ওই দিন সন্ধ্যার পরপরই তারা চারপাশ দিয়ে তানোর থানা আক্রমণ করেন। তাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পালিয়ে যায় পাকিস্তানিরা। কিছু পাকিস্তানি লোকজন মারাও যান।

তিনি বলেন, থানায় ঢুকে হাজতখানায় ওই ছয় সহযোদ্ধাকে তারা পান। ওই সময় গুলি করে তালা ভাঙতে গিয়ে এক গেরিলা যোদ্ধার পায়ে গুলি লাগে। পরে তাকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই অভিযানে উদ্ধার হয় ছয় যোদ্ধা।

এরপর নভেম্বরের শেষের দিকে তারা আরেকবার তানোর থানায় আক্রমণ করেন। ওই যুদ্ধে রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্র মোনায়েম মঞ্জুর এবং কাটাখালীর মাসকাটাদিঘী বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র ইসলাম শহীদ হন। তাদের কবর সৈয়দপুরে আছে। রাজশাহী অঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধের শহীদের কবর এই দুটিই। এই কবর দুটি সংরক্ষণের দাবিও জানান এই গেরিলা কমান্ডার।

ত্রাসের নাম রাজা বাহিনী

রাজা বাহিনী পাকিস্তানিদের কাছে ত্রাস ছিল জানিয়ে রাজা বলেন, তাদের অবস্থান সম্পর্কে জানতো পাকিস্তানিরা। কিন্তু কখনও তারা আক্রমণের সাহস দেখায়নি। একবার কাঁকনহাট হয়ে রেললাইন ধরে গিয়ে তাদের ঘিরে ধরে পাকিস্তানি সেনারা। দ্রুত তারা নিজেদের অবস্থানে গিয়ে হানাদারদের সঙ্গে প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওই যুদ্ধের এক পর্যায়ে গেরিলারা পিছু হটে। কিন্তু গোলাগুলি চালিয়ে যান। সেই যুদ্ধে কয়েশ পাকিস্তানি আর্মি মারা যায়। তাদের ট্রেনে করে ‍তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটে পাকিস্তানি বাহিনী।

বর্তমান অবস্থা :

রণাঙ্গনের এই লডাকু যোদ্ধার ভাগ্যে জোটেনি বীরত্বপূর্ণ খেতাব। কিন্তু তাতেও আক্ষেপ নেই সফিকুর রহমান রাজার। তিনি বলেন, আমরা কোনো খেতাব পাওয়ার জন্য যুদ্ধ করেনি। এই যে ভাতা পাচ্ছি, এজন্যও যুদ্ধে যাইনি। তবে তাকে ভারতে কমিশন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কি কারণে সেটি পরে পাননি, তা আর তলিয়ে দেখেননি। মেজর গিয়াস উদ্দিনও স্বীকার করেন, খেতাব তার পাওনা ছিল। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য পূরণ হয়নি জানিয়ে রাজা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ যেভাবে এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল সেভাবে এগোয়নি। এখন বঙ্গবন্ধুকন্যা হাল ধরেছেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেছেন।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আজও পূর্ণতা পায়নি। মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা ইস্যুতে মুক্তিযোদ্ধাদের বিতর্কিত করা হয়েছে। পরিহাস করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তি নষ্ট করার এখতিয়ার কারও নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা সম্মান পাচ্ছেন না বলেও জানান রাজা।

আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানান আহ্বান জানান এই গেরিলা কমান্ডার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের এক কোটি শরণার্থীও ইতিহাসের অংশ। এই দিকটি বরাবরই উপেক্ষিত থেকে গেছে। আবার অনেকেই ভাড়াটিয়া বাহিনী হিসেবে ভারত সহায়তা করেছে। কিন্তু সেটি ভুল। আমরাই সামনে থেকে লড়াই করে যুদ্ধ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছি। পেছন থেকে ভারত কেবল সহায়তা করেছে।

এসপি