স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কান পেতে থাকতাম। পদ্মা নদীর ভাঙন কবলিত পুরো গ্রামের সব মানুষ একসঙ্গে রেডিও শুনতাম। এরই মধ্যে শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় খুব বেশি না বুঝলেও, এটা বুঝতাম যে তারা (পাকিস্তানি) আমাদের সব ক্ষেত্রেই বঞ্চিত করে। জুলুম নির্যাতন করে আমাদের শোষণ করছে। স্বাধীন বাংলা বেতারে ৭ মার্চের এই ভাষণের মাধ্যমেই আমি ধরে নিলাম, পরাধীনতার দিন শেষ হতে চলেছে। এরপর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পাড়া প্রতিবেশী বড় ভাইদের সহযোগিতায় রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছি। 

অস্ত্র হাতে বুকে গুলি বরণ করে দেশ স্বাধীন করেছি। বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মালদা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর আবারও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মৃত্যুর মিছিল দেখেছি। তবে চারদিকে লাশের স্তুপ দেখেও আতঙ্কিত হয়নি। সব সময় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য অপেক্ষায় থাকতাম। কারণ সে সময় মনে হতো, মৃত্যুর থেকে আর উত্তম কিছুই হতে পারে না। দেশবাসীর সহযোগিতা ও সহযোদ্ধাদের রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করতে সক্ষম হয়েছি। বাড়ির সবাই জানত যুদ্ধে আমি মারা গেছি। কিন্তু স্বাধীন দেশে বীরের বেশে বাড়ি ফেরার পর সবাই অবাক হয়েছে। 

ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এভাবেই মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান। তিনি এখনও বুকের ডান পাশে বুলেটের চিহ্ন নিয়ে তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদেরকে মহান স্বাধীনতার গল্প শুনিয়ে বেড়ান। 

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামে ১৯৫৮ সালের ১১ ডিসেম্বর জন্ম বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইদুর রহমানের। তার বাবা রিয়াজ উদ্দিন মণ্ডল ও মা মাজেদা বেগম। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাইদুর রহমান মোল্লাটোলা উচ্চ বিদ্যালয় অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীনের পর তিনি ও আরও কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামে শিবগঞ্জ উপজেলার ঘোড়াপাখিয়া ইউনিয়নের চামা গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। পরে সেখান থেকে তিনি ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থেকে অবসর গ্রহণ করেন। 

বর্তমানে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান কোরআন-হাদিস, বিভিন্ন বই পড়ে অবসর সময় কাটান। এ ছাড়াও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-প্রয়াস মানবিক উন্নয়ন সোসাইটির আমন্ত্রণে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনান। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। পদ্মায় ভাঙন কবলিত শিবগঞ্জ উপজেলার উজিরপুর ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামের নদীগর্ভে তলিয়ে গেলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শহরের বালুবাগানে বাড়ি করেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান। বর্তমানে এখানেই তিনি এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস করেন। 

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার নেপথ্যের গল্প :

১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর শহর থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তাদের গ্রামে যেত স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করতে। এরই মাঝে ৭০ এর নির্বাচনে জয়লাভের পরও ক্ষমতা হস্তান্তর না করা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট (চেয়ারম্যানের পদকে সে সময় প্রেসিডেন্ট বলা হতো) ও মেম্বাররা ছাত্রদের সামনে এসে পদত্যাগ করল। তাদের দাবি ছিল, অবৈধ শাসক আইয়ুব খানের অধীনে কেউ কোনো পদে থাকতে চান না। এসব দেখেই রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হন সাইদুর রহমান। ১৯৭১ সালে ৮ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন তিনি। 

সে সময় খবর পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল রেডিও। গ্রামের সবাই মিলে দেশের যে কোনো অবস্থা সম্পর্কে জানতে খবর পেতে কান পাততেন রেডিওতে। যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান বলেন, সবাই মিলে রেডিওতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যুদ্ধের কোনো বিকল্প নেই। মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকি। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ১৩ এপ্রিল সর্বপ্রথম আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এরপর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের দিকে রাতের অন্ধকারে বাড়িতে কাউকে না জানিয়ে, মাকে পাশের বাড়িতে অংক বুঝিয়ে নিতে যাব বলে পালিয়ে গেলাম। নিজের কাছে থাকা ১২ টাকা ও আরেকজনের দেওয়া ১০ টাকা মিলে ২২ টাকা নিয়ে রাতের অন্ধকারেই পদ্মা পাড়ি দিলাম। পদ্মায় রাত কাটিয়ে সকালে ফারাক্কা বাঁধ হয়ে ভারতে প্রবেশ করি।

প্রশিক্ষণ :

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার এনায়েতপুর উচ্চ বিদ্যালয় মাঠেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ছাত্রসহ অপেশাদার মুক্তিযোদ্ধাদের। এক ব্যাচে ১০০ জন এই প্রশিক্ষণে অংশ নিত। জায়গার সংকুলান না হওয়ায় সেখান থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গৌড় বাগানে। সেখানে চলতে থাকে প্রশিক্ষণ। রাইফেল, এলএমজি, থ্রি নট থ্রি, মর্টার চালানোর প্রশিক্ষণ নেন সাইদুর রহমান। এ সময় বিশেষ প্রশিক্ষণও নেন তিনি। ট্যাংক বিধ্বংসী কামান বা রকেট লঞ্চার চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যুবক সাইদুর রহমানকে। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এক ভারতীয় ক্যাপ্টেনের অধীনে তারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।

ভারতের স্বাধীনতা দিবস ও কাফনের কাপড় প্রদান:

সাইদুর রহমান জানান, ১৪ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে তাড়াহুড়ো করে প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়। কারণ পাইপলাইনে অনেকেই অপেক্ষায় ছিল প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। তাদেরকে সুযোগ করে দিতেই ১ মাস ৮ দিনে আমাদের প্রশিক্ষণ শেষ করা হয়। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাপ্টেন তার ভাষণে বলেন, তোমাদের দেশ স্বাধীন করতেই এখানে এসেছো প্রশিক্ষণ নিতে। যুদ্ধে খেতে পাবে না, পরতে পাবে না, এমনকি মৃত্যুও হবে। এসব কোনো ব্যাপার না। মূল লক্ষ্য দেশ স্বাধীন করা। এরপর কাফনের কাপড় দিয়ে পাঠিয়ে দিল যুদ্ধে। সেই কাপড় মাথায় বেঁধে প্রবেশ করলাম নিজ দেশে। শুরু হলো রনাঙ্গনের লড়াই। 

রণাঙ্গনে সেক্টর ও যুদ্ধক্ষেত্র:

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৎকালীন অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে (বর্তমান বাংলাদেশ) ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে। প্রতিটি সেক্টরে একজন করে সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, একেকটি সেক্টরকে আবার বেশ কয়েকটি সাব-সেক্টরে আলাদা করে একজন অধিনায়কের দায়িত্বে হস্তান্তর করা হয়। এটি ছিল যুদ্ধ পরিচালনার একটি সামরিক কৌশল।

সাইদুর রহমান ৭ নম্বর সেক্টেরের অধীনে ৩ নম্বর মহদিপুর সাব-সেক্টরে যুদ্ধ করেন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর কাজী নুরুজ্জামান (২৭ সেপ্টেম্বরের আগে দায়িত্বে ছিলেন, মেজর নাজমুল হক) ও সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। সাইদুর রহমান জানান, ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের অধীনে যুদ্ধ করলেও তার সঙ্গে সরাসরি কখনও দেখা হয়নি। ক্যাপ্টেন গিয়াস ও ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নির্দেশনায় সাইদুর রহমান চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কয়লাবাড়ি-ধোবড়া এলাকায় সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। 

বুকে গুলিবিদ্ধ ও হাসপাতালের লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা:

একটি সম্মুখযুদ্ধে ২১ সেপ্টেম্বর শত্রুর একটি গুলি আঘাত করে সাইদুর রহমানের বুকের ডান পাশে। আহত অবস্থায় সহযোদ্ধারা তাকে মালদা হাসপাতালে ভর্তি করে। সেখানে প্রায় মাসখানেক চিকিৎসা নেন। চিকিৎসা নেওয়ার সময় এক ভিন্ন অভিজ্ঞতা দেখতে হয় তাকে। সাইদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসাধীন অবস্থায় দেখলাম কয়েকজনের মর্মান্তিক মৃত্যু। চোখের সামনে ছটপট করতে করতে মারা গেল তারা। 

গুলির আঘাত নিয়েই যুদ্ধে অংশ ও বাড়ি ফেরা:

প্রায় মাসখানেক মালদা হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর সাইদুর রহমান গুলির আঘাত নিয়েই আবারও ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। তিনি বলেন, পরেরবার যুদ্ধে গেলেও সহযোদ্ধারা সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে দেয়নি। তাই অস্ত্র না চালালেও আমার নেওয়া প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছি। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মনে হতো মৃত্যুই পরম শান্তি। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। চারিদিকে লাশের স্তুপ দেখেও এসব স্বাভাবিক মনে হতো। 

তিনি আরও বলেন, সহযোদ্ধাদের রক্ত ও দেশবাসীর সহযোগিতায় দেশ স্বাধীন হলো। এরপর স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে মাথা উচু করে বাড়ি ফিরেছি। কিন্তু অবাক করার বিষয়, পরিবারের সবাই মনে করেছিল আমি যুদ্ধে মারা গেছি। আমাকে পেয়ে বাবা-মা আবেগে আপ্লুত হয়ে গেছিল। এই অনূভুতি প্রকাশ করার মতো নয়। 

স্বাধীনতা ও দেশের বর্তমান উন্নয়ন:

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. সাইদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জীবন বাজি রেখে দেশকে স্বাধীন করলেও এমন একটা সময় গেছে যখন, নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে সংকোচ লেগেছে। নিজেকে নিরাপদ মনে করতাম না। তবে বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছে, তা অকল্পনীয়। এখন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। বর্তমানে সবক্ষেত্রেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করা হয়। আমরা কোনোদিন ভাবতেও পারিনি, রাষ্ট্র মুক্তিযোদ্ধাদের এভাবে মর্যাদা দিতে পারে। 

দেশের উন্নয়নে স্বাধীনতা যুদ্ধের সার্থকতা হয়েছে উল্লেখ করে সাইদুর রহমান বলেন, প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি বলে দেশের উন্নয়ন তেমন চোখে পড়ছে না। কিন্তু আমার নিজের দেখা স্বাধীনতার পাঁচ দশকে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে বাংলাদেশের। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশের যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে, তা আমাদের ভাবনারও বাইরে। আর্থিক, সামাজিক, প্রযুক্তি, শিক্ষা-চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। অথচ একটা সময় ছিল যখন প্রত্যেক বছর ১৫ থেকে ২০ টন খাদ্য ঘাটতি ছিল বাংলাদেশে। উন্নত দেশ ও বিদেশি সংস্থার সহযোগিতার দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ। 

তিনি আরও বলেন, মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ পাকিস্তান আমলে ঢাকা যেতে ট্রেনে সময় লাগত দেড় থেকে দুই দিন। খুব শীঘ্রই বাংলাদেশ অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে যাবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। 
 
প্রসঙ্গত, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২ হাজার ১১৩ জন মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।

আরআই