বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম

‘আমার পরিবারের কেউ রাজি ছিলেন না। আমার বড় ভাই মতিউর রহমান বলেছিলেন, তুই যুদ্ধে যা, আমিও আসতেছি। এরপর ১৯৭১ সালের ৫ জুন বাড়ি থেকে কাউকে না বলেই চলে যাই মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে ডিসেম্বর মাসের ২০ তারিখ বাড়ি ফিরি।’

এভাবেই ঢাকা পোস্ট প্রতিনিধির সঙ্গে যুদ্ধকালীন স্মৃতিচারণ করছিলেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নজরুল ইসলাম (৬৮)। তিনি ১৯৫৪ সালের ১ জুলাই নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নের মতিউরনগর (সাবেক রামনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

৪ ভাই-বোনের মধ্যে মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। তিনি রায়পুরা থানার সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও রায়পুরা উপজেলার সেক্টর কমান্ডার ফোরামের বর্তমান সভাপতি। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার এখন সময় কাটে তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে পরিবারের সঙ্গে। সুযোগ পেলেই পরিবারের সদস্য ও নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যুদ্ধকালীন গল্প করেন।

যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা

১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমার বয়স তখন ১৮ ছুঁইছুঁই। ভৈরবের হাজী আসমত কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ি। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হই যুদ্ধে যাওয়ার। কিন্তু পরিবারের কেউ রাজি ছিলেন না। এমতাবস্থায় আমি আমার বড় ভাই মতিউরের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি। একপর্যায়ে বড় ভাই মতিউর রহমান বলেন, ‘তুই যা, আমিও আসতেছি’।

বড় ভাইয়ের মুখে এই কথা শোনার পর পরিবারের আর কাউকে না জানিয়েই জুন মাসের ৫ তারিখ পালিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তারপর রায়পুরা থানার আলগিবাজরে আগে থেকেই ঠিক করে রাখা নৌকায় উঠি এবং সেখান থেকে নৌপথেই রাতের বেলা রওনা হই ভারতের আগরতলার উদ্দেশে।

কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং

বাড়ি থেকে বের হয়ে সরাসরি যাই ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায়। যেতে সময় লাগে আড়াই দিনের মতো। ত্রিপুরায় যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগে নেওয়া হতো হাফানিয়া ক্যাম্পে। ওই হাফানিয়া ক্যাম্পে সবার আগে যুবকরা সমবেত হতো। ক্যাম্পের ইনচার্জের দায়িত্বে ছিল আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া নামের একজন। ওই ক্যাম্প থেকে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হতো।

আমাকে পাঠানো হয়েছিল ত্রিপুরা রাজ্যের উদয়পুর জেলার গোকূলনগর ট্রেনিং সেন্টারে। গোকূলনগর ট্রেনিং সেন্টারে আমি রাইফেল এবং গ্রেনেড চালানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেই। এখানের প্রশিক্ষণ শেষ করে আরও উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য আমি যাই ত্রিপুরার পালাটানা ট্রেনিং সেন্টারে। সেখানে এসএমজি, এসএলআর, এলএমজি ইত্যাদি রাইফেলের উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি।

এই প্রশিক্ষণ শেষ করে ক্যাপ্টেন সুজাত আলী নামে একজনের অধীনে আরও কিছু দিন বিভিন্ন অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নেই। এভাবেই কেটে যায় মাস দুয়েকের মতো।

নজরুল ইসলাম কাজ করেছেন তিন নম্বর সেক্টরে। তার সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কে এম শফিউল্লাহ। ট্রেনিং শেষ করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার শুরুর গল্প করতে গিয়ে তিনি বলেন, তিন নম্বর সেক্টরে বিভিন্ন কোম্পানি তৈরি করা হয়েছিল কাজের সুবিধার্থে। তখন ক্যাপ্টেন মতিন নামে সেনাবাহিনীর এক সদস্য একটি নতুন কোম্পানি করে, নাম দিলো ই-কোম্পানি।

‘ওই ই-কোম্পানির সঙ্গে কাজ শুরু করি। প্রথমে আমার সেক্টর কমান্ডার কেএম শফিউল্লাহ থাকলেও শেষ দিকে আমিসহ আমরা সবাই ব্রিগেডিয়ার মো. নুরুজ্জামানের (বীর উত্তর) অধীনে কাজ করি। ওনার বাড়িও আমাদের রায়পুরাতেই’ যোগ করেন তিনি।

রোমহর্ষক ঘটনা ও সহযোদ্ধাদের স্মৃতি

৩ নম্বর সেক্টরের সবচেয়ে বড় যুদ্ধদের একটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়াযুদ্ধ। ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে ৪ তারিখ টানা চার দিন থেমে থেমে চলে এই যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে সামনাসামনি অংশ নেন নজরুল ইসলাম নামের এই যোদ্ধা। তিনি বলেন, সেখানের যুদ্ধটা এতটাই ভয়াবহ ও আলোচিত ছিলো যে তখন বিবিসিতেও এটি দেখানো হয়। এই যুদ্ধের ফাইনাল প্রস্তুতি নেই ২৯ নভেম্বর। এটাই হতে পারে আমাদের জীবনের শেষ অপারেশন এমন মানসিকতা নিয়ে পরিকল্পনা শুরু করি।

এই পরিকল্পনা করি ভারতের আগরতলা বসেই। তার পরদিন ৩০ ডিসেম্বর আমরা আগরতলা এয়ারপোর্ট এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করি আখাউড়ার এক জঙ্গলে। আমরা প্রস্তুত, পাকিস্তানিরা আমাদের আর কিছু দূর সামনেই।

এমন অবস্থায় পাকিস্তানিদের একটি দল আমাদের ডিফেন্সের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায়। তখনও আমরা গুলি করিনি, কারণ গুলি করার অনুমতি ছিলো না কমান্ডার থেকে। অফিসার কমান্ড করলে একযোগে তিন দিক থেকে আক্রমণ করব এমন মানসিকতা নিয়েই গুলি চালানো হয়নি। আমাদের পেছনে ছিল টু বেঙ্গল এবং এলিভেন বেঙ্গল, অমাদের বা পাশে ছিল মেজর হায়দার ও খালেদ মোশারফের দল আর আমরা ক্যাপ্টেন আজিজ গ্রুপ পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করব।

সারারাত অপেক্ষা করেও আমরা কোনো ফায়ার শুরু করতে পারিনি। সবশেষ ১ ডিসেম্বর ভোরে ফজরের আজান হচ্ছিল মাইকে। আজানের পরপরই অনুমতি এলো, সুবেদার আবদুস সোবহান প্রথম ফায়ার করেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও শুরু করলাম, এরপর পাকিস্তানিরাও শুরু করল। কখনো তুমুল ফায়ার, কখনো মৃদু এমন করে চলল টানা দুই দিন।

২ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানিদের আর্টিলার শেল আসতে শুরু করে আমাদের ওপরে। তখন আর টিকে থাকতে পারছিলাম না আমরা। এরপর ৩ তারিখে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও ভারতীয় বিমানের সহয়তায় আমরা নতুন করে আক্রমণে যাই। তখন পাকিস্তানিরা একটু দমতে শুরু করে। সবশেষ ৪ ডিসেম্বর বিকেলে তারা পিছু হটে। ১ থেকে ৪ তারিখের ওই যুদ্ধে শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় ও আমাদের মুক্তিযোদ্ধা মারা যান ৮ জন। আহত হয় আরও ২০ জনের বেশি। আমার নিজেরও ডান হাতের একটা আঙুলের ওপরের অংশ পড়ে যায়, পা কেটে যায়।

কেমন আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা

কেমন আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা এমন প্রশ্নের জবাবে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘এই দেশ স্বাধীন হবার পরে রাজাকার শাহাজাদের রহমানকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসতে সাহায্য করেছিলেন। রাজাকার মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ হলো মিনিস্টার। তখন আমাদের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিতেন না ভয়ে। এখন শেখ হাসিনার সময়ে আমরা ভালো আছি। নিয়মিত সম্মানীভাতা পাচ্ছি , কোনো সমস্যায় পড়লে ব্যক্তিগতভাবেও আমাদের সাহায্য করছেন তিনি।’

জেলায় মোট কতজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জীবিত আছেন এবং কতজন ভাতা পাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে নরসিংদীর সহকারী সমাজসেবা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, সঠিক সংখ্যাটা আমি বলতে পারছি না। এই বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ভালো বলতে পারবেন। আমরা সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতিমাসে তাদের ভাতা দিচ্ছি।

জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোতালিব পাঠান বলেন, নরসিংদীতে তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধারা সবাই ভাতা পান। তালিকাভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু ভাতা পান না, এমন তথ্য জানা নেই আমার। আর ব্যতিক্রম দু-চারজন থাকতে পারে সেগুলোও আমার জানা নেই। যারা ঠিকঠাক কাগজপত্র সাবমিট করেছেন সবাই প্রতিমাসে ভাতা পাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) তথ্যমতে, নরসিংদী জেলায় মোট বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৯০৯ জন। এরমধ্যে নরসিংদী সদরে ২৬২ জন, রায়পুরায় ২৫১, বেলাবতে ৬১, মনোহরদীতে ৮৩, পলাশে ৭৭ এবং শিবপুরে ১৭৫ জন রয়েছেন।

এমএসআর