বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রইছ আলী

‘হবিগঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় চা বাগান অধ্যুষিত চুনারুঘাটের রেমা বাগানে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাঞ্জাবিদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। বাগানের ৫ নম্বর ভ্যানগার্ডে আমরা অবস্থান করি। এ সময় পাঞ্জাবিরা খবর পেয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আমরা প্রতিরোধ করি। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে বিজয়ের পর অস্ত্র জমা দিয়ে টাকা পয়সা হাতে না থাকায় দুই দিন হেঁটে বাড়িতে ফিরি।’

কথাগুলো বলছিলেন হবিগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রইছ আলী। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে মুক্তিযুদ্ধকালীন নানা স্মৃতির কথা উল্লেখ করেন জেলার এই বীর সন্তান। পাশাপাশি তিনি যুদ্ধের সময় অনুপ্রেরণা, যুদ্ধের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথাও বর্ণনা করেন। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রইছ আলীর বয়স প্রায় ৮০ বছর। তিনি হবিগঞ্জের পুরান মুন্সেফী আবাসিক এলাকার আকবর আলী ও মালুম চান বিবির সন্তান। রইছ আলী ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের জনক।  

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া

একাত্তরে টগবগে যুবক রইছ আলী। চাকরি করতেন আনসার বাহিনীতে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চর ঐতিহাসিক ভাষণ ও ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর দেশ মাতৃকার টানে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। রইছ আলী বলেন, আমরা ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার সাবেক সেনাপ্রধান মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এরপর কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী ও ইউনুছ চৌধুরীর সঙ্গে যোগ দেই। শেরপুর, সাদিপুর ও সিলেটের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করে একপর্যায়ে ভারতে ট্রেনিংয়ে অংশগ্রহণ করি। এরপর হবিগঞ্জের চুনারুঘাট চা বাগান ও খাগাউড়া এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। 
  
সবচেয়ে বড় যুদ্ধ

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রইছ আলী জানান, হবিগঞ্জের মধ্যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় চা বাগান অধ্যুষিত চুনারুঘাটের রেমা বাগানে। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাঞ্জাবিদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। 
তিনি বলেন, বাগানের ৫ নম্বর ভ্যানগার্ডে আমরা অবস্থান করি। এ সময় পাঞ্জাবিরা খবর পেয়ে আমাদের ওপর আক্রমণ করলে আমরা প্রতিরোধ করি। এই যুদ্ধে আমাদের সহকর্মী শায়েস্তাগঞ্জের রমিজ আলী মারা যান। তাৎক্ষণিকভাবে আমরা তাকে দাফন করি। এছাড়া অনেক পাঞ্জাবি এই যুদ্ধে মারা যায়।

 

যুদ্ধের স্মৃতি

রইছ আলী বলেন,  আমাদের ক্যাম্পে পাঞ্জাবিরা পারকুল ও কালেঙ্গা ফরেস্ট অফিসের দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। এ সময় তাদের গুলিতে আমাদের এক সাথী ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। পরে তার মরদেহ আমরা দেখে আঁতকে উঠি। সহযোদ্ধার বুকের মধ্যে বুট জুতার অনেক দাগ। তখন মনে হয়েছে তাকে শুধু গুলি নয়, অনেক নির্যাতন করে মারা হয়েছে। সেদিনের কথা মনে হলে আজও গা শিউরে ওঠে। 

বিজয়ের সংবাদ

বীর মুক্তিযোদ্ধা রইছ আলী বলেন, যুদ্ধের সময় হবিগঞ্জের বিভিন্ন জনের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ ছিল। তাদের মাধ্যমে আমরা বিজয়ের সংবাদ পাই। বিজয়ের সংবাদ পেয়ে অনেক অনেক খুশি হই। আমরা নিজস্ব দেশ পেয়েছি। আমরা স্বাধীন। 

অস্ত্র জমা ও বাড়িতে ফেরা

যুদ্ধ শেষে সিলেটে মেজর সি.আর দত্তের নিকট অস্ত্র জমা দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন বীর মুক্তিযোদ্ধা রইছ আলী। তখন সিলেট থেকে প্রথমে হেঁটে সুরমা ব্রিজ পাড় হয়ে কদমতলি দিয়ে ডিঙ্গি নৌকায় পার হয়ে আবার একটি বাসে করে শেরপুর আসেন। শেরপুর থেকে হেঁটে বাহুবল পুটিজুরি হয়ে দুই দিন পর বাড়িতে ফিরে আসেন।  

সম্মান ও মর্যাদা

রইছ আলী বলেন, জাতির জনকের কন্যা আমাদের অনেক সম্মান দিয়েছেন। প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা করে ভাতা দিচ্ছেন। দেশের মুক্তিযোদ্ধারা অনেক খুশি। আমাদের সবচেয়ে বড় সম্মান হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন। সাধারণ কোনো মানুষ মারা গেলে এ সম্মান দেওয়া হয় না। এতে করে আমরা গর্বিত। কোনো চাওয়া-পাওয়ার আশায় যুদ্ধে যাইনি। শুধুমাত্র দেশ রক্ষার্থে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। 

প্রত্যাশা

জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। দেশের উন্নতি হলে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অনেক ভালো লাগে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সবাইকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানান বীর মুক্তিযোদ্ধা রইছ আলী।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলায় তেলিয়াপাড়া ডাকবাংলো থেকে সারাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।  ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধে জেলার ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। যুদ্ধে আহত হন ৩৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া নিরীহ অসংখ্য মানুষ পাক হানাদারদের নির্মম নির্যাতনে শহীদ হন। এসব শহীদদের জন্য তেলিয়াপাড়া, ফয়জাবাদ, কৃষ্ণপুর, নলুয়া চা বাগান, বদলপুর, মাখালকান্দিতে বধ্যভূমি নির্মিত হয়েছে। 

আরএআর