বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরেন্দ্র নাথ সরকার বিমল

‘২১ দিন প্রশিক্ষণ শেষে ধানুয়া কামালপুরে সম্মুখযুদ্ধে যোগ দিই। সেখানে দিনরাত পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ হয়। এমন কোনো অস্ত্র নেই যা ওই যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়নি। যুদ্ধে আমাদের অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। সেই যুদ্ধে কয়েকবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি। এক রাতে একটি কুকুর নিয়ে রেকি করতে যাই...।’

‘...যেতে যেতে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছাকাছি চলে যাই। এ সময় কুকুরটি মাটি খুঁড়তে থাকায় শব্দ হয়। শব্দ শুনেই পাকিস্তানি বাহিনী মেশিন গানের গুলি ছুড়তে থাকে। পরে আমি মাটিতে (রোলিং করতে করতে) শুয়ে শুয়ে আসতে থাকি। এসময় আমার কোম্পানির লোকজন বুঝতে পারে আমি মৃত্যুর মুখে পড়েছি, তাই তারা পাল্টা গুলি ছোড়ে পাকিস্তানিদের লক্ষ্য করে। সেই যাত্রায় বেঁচে যাই।’

ঢাকা পোস্টের টাঙ্গাইল প্রতিনিধির সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন টাঙ্গাইলের গোপালপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরেন্দ্র নাথ সরকার বিমল।

সেই সময়ের তরুণ সমরেন্দ্র নাথ সরকার মাতৃভূমিকে রক্ষায় নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ শোনার পর নিজেকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। সম্মুখযুদ্ধে একবার গ্রেনেডের বিকট শব্দে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় বেঁচে যান তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা

তখন এইচএসসি দ্বিতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলাম। দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এরমধ্যে দেশ স্বাধীনের জন্য বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করেন। ৭ই মার্চ ভাষণ শুনে অনুপ্রেরণা জাগে। ২৫ মার্চ যখন ঘুমন্ত বাঙালিকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে শুরু করে। তখন বুঝলাম এখনই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। খোঁজ নিতে থাকলাম কীভাবে যুদ্ধে যাব, কোথায় যাব, কার কাছে যাব?

পরে জানতে পারলাম ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এরপর যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ৬ জুন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠলাম। উঠেই রান্নাঘরে থাকা পান্তা ভাত, ডাল, কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। এ সময় মা দেখে জিজ্ঞাসা করল, এত ভোরে খাচ্ছিস, তোর বেশি ক্ষুধা লাগছে নাকি? পরে মাকে বললাম, হ মা ক্ষুধা লাগছে।

খাওয়া শেষে লুঙ্গি আর শার্ট পরে কিছু টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা জিজ্ঞাসা করলেন, খোকা কই যাস? যুদ্ধে যাওয়ার কথা বললে মা যেতে দিতো না, তাই মাকে ‘বাজারে যাচ্ছি’ বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। পরে বাজারে যাওয়ার পর আরও দুইজনের সাথে চলে যাই বয়রা নামক ঘাটে। সেখান থেকে নৌকাযোগে দুই দিনে ভারতের মাইনকার চরে গিয়ে পৌঁছি।

সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণ

মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট (সদস্য ভর্তি) করা হবে। মাইনকার চর থেকে ১৪ কিলোমিটার ডাবল মার্চ করে আমরা সেখানে পৌঁছি। পৌঁছানোর পর ক্যাপ্টেন নিয়োগী আমাদের ভর্তি করেন প্রশিক্ষণে। মহেন্দ্রগঞ্জ এফএফ ক্যাম্পে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ হয়। সেখানে ধনবাহাদুর প্রশিক্ষণ করান। আমাদের ২১ দিন প্রশিক্ষণ করানো হয়। পরে বলা হল আরও উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হবে।

প্রশিক্ষণ শেষে নিয়ে যাওয়া হলো জামালপুরের ধানুয়া কামালপুরে। সেখানে দিনরাত যুদ্ধ হয় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে। ওই যুদ্ধে বহু বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছেন। সে সময় বয়স কম হওয়ায় সব সময়ই সামনের সারিতে থাকতাম। সেই যুদ্ধে অনেকবার মৃত্যুর মুখে পড়েছিলাম। একদিন যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের কাছাকাছি চলে আসে। তখন আর কমান্ডারের কমান্ড শোনার খেয়াল নাই।

যখনই পাকিস্তানি বাহিনী দেখলাম, তখনই ফায়ারিং শুরু করি। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানিদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তুমুল যুদ্ধের মধ্যে ইপিআরের তিনজন এমএমজি নিয়ে আসল। এমএমজি বসিয়েই ব্রাশফায়ার শুরু করল। এমএমজির চেইনটা শেষ হওয়ার পরই আমাদের পিছু হটতে বলা হয়।

এরমধ্যে মর্টারের শেল সেখানে পড়তে শুরু করে। সে সময় একটি পুকুরের পাশে দাঁড়াতেই একটু দূরে মর্টারের শেল পড়ে। মর্টারের শব্দে সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে এক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমাকে ক্যাম্পে নিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এর কয়েকদিন পর ট্রেইনার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন দুইজন পাকিস্তানি সেনাকে গুলি করে হত্যার পর আমাদের জন্য অস্ত্র নিয়ে আসেন।

পরে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন বললেন, আজ কামালপুর দখল করে শত্রুমুক্ত করব। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় দখলমুক্ত হওয়ার উপক্রম। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন আইয়ুবীকে জ্যান্ত অবস্থায় ধরার জন্য ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন যখন বাংকারের সামনে যান তখন পাকিস্তানিদের ব্রাশফায়ারে তিনি মারা যান। দীর্ঘক্ষণ যুদ্ধ হয় সে সময়। এরমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। সেই যুদ্ধে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনসহ দুই থেকে আড়াইশ বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

এরপরই আমাদের কোম্পানি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। গোপালপুরের নলীনবাজারে আসি। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আসার খবর শুনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী আমাদের রিসিভ করে তার বাহিনীভুক্ত করেন। এরপরই গোপালপুরের হেমনগর, বেলুয়া, ডুবাইল, পাকুয়া, সূতী, নন্দনপুর, ভূঞাপুর এলাকায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আসাদুজ্জামান আরজু। 

গোপালপুরে সম্মুখযুদ্ধের পাশাপাশি গেরিলাযুদ্ধও হয়। কোম্পানি কমান্ডার আসাদুজ্জামান আরজুর নেতৃত্বে দুই দিনব্যাপী গেরিলাযুদ্ধ হয়। কমান্ডারের নির্দেশে ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফায়ার করতে করতে এগিয়ে যাই উপজেলা সদরের দিকে।

তখন সেখানে ছিল রাজাকাররা। আমাদের ফায়ার করা দেখে তারা পেছাতে থাকে। পরে এ্যসিল্যান্ড অফিসের ওখানে দুইটি রাজাকারদের বাংকার ছিল। বাংকারের কাছাকাছি গিয়ে জিএফ রাইফেল মাধ্যমে গ্রেনেড নিক্ষেপ করি। গ্রেনেড বাংকার দুইটির মাঝখানে পড়ায় রাজাকাররা ভীত হয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। আমরা জয়বাংলা স্লোগান দিই।

পরে নন্দনপুর আসার পর দেখলাম পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে টাঙ্গাইলের দিকে যাচ্ছে। এরমধ্যে ভারতের বিমান আকাশে ভাসছে। এই কারণে আমরা আর তাদের পিছু নিইনি, কারণ ধারণা করলাম তারা বিমানের বোমার নিক্ষেপেই মারা যাবে। সেদিন ১০ ডিসেম্বর গোপালপুর হানাদারমুক্ত হয়। 

মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের সহযোগিতা

যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষদের অনেক সহায়তা পেয়েছি। তাদের সহায়তা ছাড়া দেশ স্বাধীন হতো না। তারা জীবন দিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করেছেন। যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা রাজাকার, আলবদর, আল শামসে যোগদান করে বিভিন্ন অপরাধ করেছে। প্রশিক্ষণের সময় মহেন্দ্রগঞ্জে সেখানকার উপজাতিরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য চিড়া, ফলমূল, রান্না করে দিত। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধারা রান্না করার সময় পাইনি। সাধারণ মানুষরাই তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন।

যখন যুদ্ধে গিয়েছিলাম। তার কয়েকদিন পরই বড় ভাইকে পাকিস্তানিরা ধরে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। ভয়ে তিনি পালিয়ে থেকেছেন। তখন বাড়িতে বাবা-মা, ভাই ও সাত বোন থাকতেন। যখন তারা দেখলেন, এখন আর জীবনের নিরাপত্তা নাই। জীবন বাঁচাতে রাতে তারা নদী পার হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। এরপর রাজাকাররা আমাদের ঘরে লুটপাট করে ভিটেমাটি সমান করে ফসলি মাঠ বানিয়ে দখল করে রেখেছিল।

কেমন আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতার আওতায় নিয়ে আসেন। বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ২০ হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা পান। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাকা ঘর, জমি দান করেছেন। বর্তমানে অনেক খুশি আমরা। কারণ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী মনে করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা বঙ্গবন্ধুরই সন্তান। এতে তার ভাই হিসেবেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের দেখেন।

কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কাউন্সিলের যুগ্ম মহাসচিব ও যুদ্ধকালীন কোম্পানি কমান্ডার আসাদুজ্জামান আরজু বলেন, আমরা ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ করেছিলাম। সেখানে সমরেন্দ্র নাথ সরকার বিমলও ছিল আমাদের ক্যাম্পে। ক্যাম্পে রিক্রুট হওয়ার পর তিনটি প্লাটুন হয়েছিল। সেখানে নেপালের আর্মি ধনবাহাদুর আমাদের ট্রেইনার ছিলেন। ক্যাম্পের স্টোরের দায়িত্ব ছিল। মেজর তাহের বিমলকে আমার কোম্পানিতে পাঠিয়ে দেন। তাকে নিয়ে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করি।

তিনি আরও বলেন, বিমল ছিল অ্যাডভ্যান্স পার্টির একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। যারা সামনের সারিতে যুদ্ধ করতেন। বিমল খুবই সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ভূঞাপুর থানায় ৩-৪ জন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। সেখানে দেখলাম ৯৩ জন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। তারা কীভাবে হল এটা আমার বোধগম্য নয়। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সমরেন্দ্র নাথ সরকার বিমল ১৯৫৪ সালের ২৮ নভেম্বর গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মৃত কৃষ্ণকান্ত সরকার ও মাতা মৃত প্রিয়বালা সরকার। তার বড় ভাই অমরেন্দ্র নাথ সরকার মারা গেছেন। তার ৭ বোন রয়েছে। তিনি বর্তমানে গোপালপুর পৌরসভার জলধারা আবাসিক এলাকায় বাস করেন।

এমএসআর