জাহাঙ্গীর হোসেন তোতার ডান পায়ে লোহার শিকল পরিয়ে ঘরের খুঁটির সঙ্গে তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এর আগে বাঁ পায়ে শিকল ছিল। সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হলে ডান পায়ে শিকল দেওয়া হয়। এভাবে দিনের পর দিন তাকে আটকে রাখা হয়। তার বাড়িতে কেউ গেলে তাদের পা জড়িয়ে ধরে শিকল খুলে দিতে বলেন তোতা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তিনি সুস্থ। কিন্তু পাগল সাজিয়ে ছোট ভাই শিকলবন্দী করে রেখেছে।

তবে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আশ্বাস দিয়েছেন, শিকলবন্দী ওই ব্যক্তির চিকিৎসা করানো হবে। এদিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

শিকলবন্দী ব্যক্তির নাম জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে তোতা (৫৫)। বরিশাল জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামে তার বাড়ি।

জানা যায়, রাজিহার ইউনিয়নের রাংতা গ্রামের আলতাব হোসেনের বড় ছেলে তোতা। শুরুর জীবনে সবই ছিল তার। সর্বশেষ লেখাপড়া করেছেন সরকারি তিতুমীর কলেজে। কিন্তু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে প্রতিবেশীদের মারধর করায় পায়ে পরানো হয় শিকল। এভাবেই কেটে গেছে আট বছর। অভিযোগ উঠেছে, সম্প্রতি তার ছোট ভাই তার স্বাক্ষর নিয়ে সব জমি লিখে নিয়েছেন।

আরেক স্থানীয় ফারুক হাওলাদার বলেন, তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীর হোসেন তোতা বড়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজে পড়াশোনা অবস্থায় মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন তিনি। ১০ বছর আগে পরিবার তাকে বিয়ে করালেও সুস্থ না হওয়ায় স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান।

স্থানীয় দুলাল মাতুব্বর জানান, রাংতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মানিক মিয়া তোতার ছোট ভাই। তিনি শিক্ষক হলেও আট বছর ধরে বড় ভাইকে চিকিৎসা করাননি। নিজে থাকার জন্য পাকা ভবন নির্মাণ করলেও বড় ভাইকে রাখছেন ধানের গোলাঘরে। এখন তোতা মিয়া সুস্থ হলেও বেঁধে রেখেছেন তাকে। আর এ সুযোগে স্বাক্ষর নিয়ে লিখে নিয়েছেন তার ভাগের সম্পত্তি।

প্রতিবেশী সাইফুল আকন বলেন, আমরা এত দিন জানতাম জাহাঙ্গীর হোসেন তোতা মারা গেছেন। কিন্তু বাড়ি এসে দেখলাম তিনি জীবিত এবং শিকলে বন্দী আছেন। ছোট একটি টিনের চালার ধানের গোলাঘরে তোতাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। কোনো দিন খাবার খায়, কোনো দিন না খেয়ে থাকতে হয় তাকে, এমনটা জানান স্থানীয় কামরুজ্জামান সবুজ।

এ বিষয়ে রাংতা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, ছোট ভাইয়ের অবহেলার কারণে দীর্ঘ আট বছর ধরে জাহাঙ্গীর হোসেন তোতা শিকলবন্দী। শুধু সম্পত্তি নিজের নামে করতে একমাত্র বড় ভাইকে কোনো রকম সুচিকিৎসা না করিয়ে শিকলবন্দী করেছে সে।

জাহাঙ্গীর হোসেন তোতার মা হাওয়া বেগম বলেন, ২৮ বছর ধরে মানসিক সমস্যা নিয়ে অসুস্থ রয়েছে তোতা। ৮ বছর আগে বাড়ির পাশের সেলিম মল্লিকের স্ত্রী মাকসুদা বেগমকে মারধর করার কারণে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছি।

অভিযোগ বিষয়ে তোতার ছোট ভাই রাংতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মানিক মিয়া বলেন, আমার বড় ভাইয়ের মানসিক সমস্যা আছে। এ কারণেই তাকে শিকলবন্দী করে রাখা হয়েছে। ভাইয়ের চিকিৎসা করতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েছি। তাকে বর্তমানে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। ভালো চিকিৎসার সুযোগ পেলে তার চিকিৎসা করার ব্যবস্থা করব। সম্পত্তি লিখে নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, তার স্বাক্ষর নিয়েছি জমির কাগজপত্র ঠিক করার জন্য।

এদিকে জাহাঙ্গীর হোসেন তোতার সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা সুশান্ত বালা।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল হাশেম জানান, সরেজমিনে তদন্ত করে শিকলবন্দী থেকে মুক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে। যদি তাকে অসৎ উদ্দেশ্যে বেঁধে রাখা হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এনএ