ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, গণ-আন্দোলন— এসব আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন আফজাল হোসেন। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন সব সময়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে বীরত্বের সঙ্গে জেতেন অনেক অপারেশন। গেরিলা যুদ্ধে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আফজাল পাকিস্তানি হানাদারদের খতম করে ছিনিয়ে আনেন লাল-সবুজের স্বাধীনতা।

সেদিন ৮ এপ্রিল। ইপিআরের মেজর নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন ইয়ার্স আলিয়াসের পরিচালনায় বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে অপারেশন শুরু হয়। সে যুদ্ধে অংশ নেন আফজাল হোসেন। প্রচণ্ড গোলাগুলির পর শত্রুপক্ষ পিছু হটে। বীরত্বের সঙ্গে সে লড়াইয়ে বিজয় লাভ করেন। তারপর ক্যান্টনমেন্টের অস্ত্রাগার দখলে নেন। সেখান থেকে অস্ত্র নিয়ে ফিরে আসেন নওগাঁয়। মান্দা উপজেলার মৈনমে শুরু করেন যুদ্ধ। তারপর রানীনগর উপজেলার একটি এলাকায় একটি সেতু উড়িয়ে দিয়ে ৫০ জন পাকিস্তানি সেনাকে খতম করেন এই গেরিলা যোদ্ধা।

ঢাকা পোস্টের কাছে একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা এভাবেই বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিটের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আফজাল হোসেন। রণাঙ্গনের রক্তঝরা সেসব দিনের কথাগুলো তরুণ প্রজন্মকে জানাতে আজ থাকছে তার স্মৃতিচারণা।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা
গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগী আইয়ুব খানের অসম নীতি এবং স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া খানের অত্যাচার ও বঙ্গবন্ধুর নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসিতে বাঙালি জাতি যখন দিশেহারা, তখন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে প্রস্তুত হন আফজাল হোসেন। পরিবারের সবার মায়া ত্যাগ করে দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের তরে।

প্রশিক্ষণ লাভ
ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ভারতের একটি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিতে যোগদান করেন। সেখানে কর্নেল মজুমদার এর অধীনে রায়গঞ্জে ২১ দিন প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেখানকার সীমান্তে কিছুদিন যুদ্ধ করার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চলে আসেন তিনি।

আফজাল বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠন জননেতা আবদুল জলিল ভাইয়ের নেতৃত্বে নওগাঁ জেলা পরিচালিত হতো। ৭ নম্বর সেক্টরের লেফটেন্যান্ট কর্নেল নুরুজ্জামানের অধীনে থেকে নওগাঁ জেলায় ঢুকে পুরোপুরি গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হই। মান্দা উপজেলার মৈনমে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে প্রথম অপারেশন পরিচালনা করি। ওই গ্রুপে ২৫ থেকে ৩০ জন সহযোদ্ধাকে নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাই। এরপর রানীনগরের একটি ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে সেখানকার প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানি হানাদারকে খতম করি।

রোমহর্ষক স্মৃতিচারণা
একদিন সকালে নাশতা করছিলাম। সেই মুহূর্তে কিছু পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক আত্রাই উপজেলার বান্দাইখাড়ায় পুরুষদের হত্যা এবং নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর খবর পাই। ওই সময় জানতে পারি হানাদাররা সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে আত্রাইয়ের দিকে নৌকাযোগে ধেয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে আত্রাইয়ের বাউল্লাপাড়ায় তিন শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা প্রস্তুতি নিই। সেখানে হানাদারদের ৯টা নৌকা তীরে আসতেই আক্রমণ শুরু করি গুলিবর্ষণ। এতে ৩০ পাকিস্তানি সেনা খতম হয়ে যায়। পরে তারা আরও সৈন্য এনে শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সেখান থেকে আমরা সরে পড়ি।

এরপর নওগাঁ শহরে কয়েকবার আক্রমণ করে পাকিস্তানি হানাদাররা। যুদ্ধে অবতীর্ণ থাকা অবস্থায় আশপাশের অনেক গ্রামের মানুষ আমাদের খোঁজখবর নিতে আসতেন। অনেকেই খাবার নিয়ে আনতেন। অনেকে নিজেদের সন্তান-স্বজনের মতো সেবা করতেন। আবার সাধারণ মানুষরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া চাইতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মানুষ রোজা পালন করতেন। এভাবে সব সময় সাধারণ মানুষ আমাদের উৎসাহিত করেছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা ও প্রাপ্তি
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে যুদ্ধ অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তবে বর্তমানে সেই আদর্শ নেই বলে আপসোস করেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা আজও অবহেলিত বলে মনে করেন তিনি।

মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে অনেক বিভেদ দেখা দেওয়ায় এবং ভুয়া নামধারী কিছু মুক্তিযোদ্ধার কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার গার্ড অব অনার দিয়ে সম্মান ও ভাতা দিচ্ছে, এ জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাই। তবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের চিহ্নিত করে নির্ভুল একটা তালিকা প্রকাশ করতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করি।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নওগাঁ জেলা ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার হারুন অর রশীদ বলেন, জেলায় ৩ হাজার ৩৭৮ জন মুক্তিযোদ্ধা আছেন। এর মধ্যে ৩ হাজার ৩০ জন ভাতা পেয়ে আসছেন। এ ছাড়া যারা শহীদ ও যুদ্ধাহত, তারা কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ভাতা পান। জেলার ১১টি উপজেলায় ১১টি কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ভবনগুলো চালু হলে সেখান থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে যে টাকা আসবে, তা অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে সমানভাবে বণ্টন করা হবে।

তিনি বলেন, বর্তমান সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছে। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

প্রসঙ্গত, আফজাল হোসেন ১৯৫০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা অ্যাডভোকেট মৃত ঈদু মোহাম্মদ মন্ডল, মা মৃত আমেনা বেগম। মা-বাবার সংসারে ৯ ভাই-বোনের মধ্যে আফজাল হোসেন দ্বিতীয় ছিলেন। বর্তমানে বিবাহিত জীবনে তার স্ত্রী ও তিন ছেলে-মেয়ে রয়েছে। তিনি নওগাঁ শহরের মাস্টারপাড়া এলাকায় বসবাস করছেন।

আফজাল হোসেন ১৯৭২ সালে কৃষি ব্যাংকে যোগদান করেন। ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি অবসরে যান এই গেরিলা যোদ্ধা। যুবক বয়সে সেরা ফুটবলার হিসেবে আফজাল এলাকায় পরিচিত ছিলেন। এখন তিনি সামাজিক সংগঠন সম্প্রীতির বাংলাদেশ নওগাঁ জেলা শাখার সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

এনএ