‘নড়াইল সদরের কামাল প্রতাপনগর গ্রামে রাজাকার ও পাকবাহিনী যৌথ হামলা করে। চারদিকে পানিতে থইথই করছে। তখন ২ থেকে আড়াই মাইল সাঁতরে একটা মাঠ পার হতে হয়েছিল। কারণ উঁচু হলে গুলি ছুড়বে। জীবন বাঁচাতে হাঁটুপানিতে সাঁতরে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে গিয়ে উঠি।’

‘এ সময় অস্ত্রটা পর্যন্ত ফেলে যেতে হয়েছে। পরবর্তীতে অবশ্য অস্ত্র উদ্ধার করি। এসে জানতে পারি এক সহযোদ্ধাকে মেরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। তার লাশ পানিতে ভাসছিল।’ এভাবে ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে রণাঙ্গনের রোমহর্ষক বর্ণনা দেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বিশ্বাস।

তিনি বর্তমানে নড়াইল সদরের রূপগঞ্জ বাজার নড়াইল প্রেস ক্লাবের পাশে বসবাস করেন। তার স্ত্রী নাজমা আরা একজন গৃহিণী। ছেলে নাজমুল হাসান লিজা ও মেয়ে নাজনীন সুলতানা লিপি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বিশ্বাসের ছেলে নাজমুল হাসান লিজা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। রাণাঙ্গনের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বর্তমানে বাড়িতে ছাদবাগান করেছেন। তার বাগানে ড্রাগন ফল, ছফেদা, কদবেল, কমলাসহ নানা প্রজাতির ফল, সবজি ও ফুল গাছ রয়েছে।

অনুপ্রেরণা ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ

১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়ার পর এবং ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণে আমাদের স্পষ্ট একটা ধারণা হয়ে গেল প্রস্তুতি নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশ এবং সেখান থেকেই আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই।  ২৫ মার্চ রাতে জানতে পারলাম ৫ দফা মেনে নিয়ে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। রেডিও নিয়ে বসে থাকলাম। কিন্তু রেডিওতে নির্বাচন বা ক্ষমতা স্থানান্তর বিষয়ে সম্পূর্ণ নীরব, যথারীতি অন্যান্য খবর চলছিল।

পরের দিন সকালে কোরআন তেলাওয়াত করে রেডিও নিয়ে বসলাম। তখনও এই বিষয়ে কোনো টাচ করল না। এরপর রেডিও স্টেশন, ঢাকা, খুলনা সব বন্ধ হয়ে যায়। সাড়ে ৭টার সময় বিবিসির খবর শুনলাম। ইয়াহিয়া খান মধ্যরাতে বিমানযোগে ঢাকাত্যাগ করেছেন। তখন বুঝলাম যে কিছু একটা হচ্ছে। তখন গ্রামের বাড়ি থেকে নড়াইলে চলে আসলাম। 

নড়াইল পুলিশ হেডকোয়ার্টারে যাই, অনেকেই সেখানে সংবাদ জানতে যায়। সেখানে এসডিপিও বলেন, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার পাক হানাদার বাহিনী ডিমোলাইজড করে দিয়েছে। আমরা কী করব? এখন জানি না। আপনাদের বললাম, এখন কী করবেন সেটা আপনারা দেখেন। আমাদের সব শেষ। মূলত ওই সময়ই মুক্তিযুদ্ধটা শুরু হয়।

তিনি আরও বলেন, আমাদের এমপি বললেন পাকিস্তান বাহিনী আসবে, চলো তুলালামপুরে একটি ব্রিজ আছে, সেটি ভাঙতে হবে। তখন আমরা হাজারখানেক মানুষ চলে আসলাম। কিন্তু আমি মনে মনে একটা হিসাব করলাম ব্রিজ ভাঙা এটা কি চারটে খানিক কথা? এটা সম্ভব না। আমি সেখান থেকে সরে গেলাম। সরে গিয়ে তখনকার এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দীকী ও কিছু মুরব্বিসহ এখানে একটি অস্ত্রাগার ভেঙে দেই। সেখান থেকে আমি একটি অস্ত্র সংগ্রহ করি।

ওই সময় বামপন্থি নেতাদের কাছে সব অস্ত্র চলে যায়। তখন অস্ত্র লুকিয়ে রাখি, পরিস্থিতি কী ঘটে তা জানতে ও বুঝতে হবে। ওইদিন দুপুর ১টার সময় রেডিওতে প্রথম ভাষণ হচ্ছে, ‘আই এম জেনারেল টিক্কা খান, মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, পাকিস্তান জোন বি।’ তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে সামরিক বাহিনী জারি করল ও ধারা-উপধারা ইংরেজিতে বললেন তিনি। পরে সরকার প্রবীর উদ্দিন বাংলা করল। এটা ফেরার পথেই জানতে পারলাম।

আমি ভাবলাম ইন্দোনেশিয়ার জাতির পিতা ড. সুকর্ণের নেতৃত্বেই ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হয়। তার ‘আমি সুকর্ণ বলছি’ বইটি পড়েছিলাম। তাতে বিষয়বস্তু দেখলাম তিনি স্বাধীনতার জন্যে সবকিছু প্রস্তুত রেখেছেন, অর্থাৎ রেডিও স্টেশনগুলো দখল করতে হবে কীভাবে? এক জায়গা থেকে কথা বললে সমস্ত রেডিওতে ওই কথা ভেসে আসবে সেই রকম ব্যবস্থা করেছিলেন।

তখন ওই মুহূর্তে আমার কথাগুলো মনে পড়ল। বঙ্গবন্ধুর সাড়া শব্দ কিছুই পাচ্ছি না, এরকম কিছু কি করা যায় কি না স্বাধীনতার জন্যে? ইয়াহিয়া খান চলে গেল, টিক্কা খান মার্শাল ল ঘোষণা করল। আজ ২৬ তারিখ। তখন রেডিও টিউন করতে থাকলাম। একপর্যায়ে চিটিগাং রেডিও স্টেশনে একটা যুবকণ্ঠে ঘোষণা করছে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র।

‘আমাদের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। আপনারা কেউ ভীত হবেন না। আপনাদের কাছে অনুরোধ আপনারা মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেন। যে যেখানে পারেন যোগদান করেন। তখন বলা হয়, পাকিস্তান রেডিওর কথা কেউ বিশ্বাস করবেন না, বঙ্গবন্ধু আমাদের সাথে থেকেই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, জয় বাংলা।’

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বিশ্বাস বলেন, যুদ্ধের জন্য পরিবার থেকে বিদায় নেইনি। কারণে ধারণা ছিল এটা বললে পরিবার থেকে হয়তো যেতে দিবে না। পরিবারে তখন মা, বাবা, ভাই-বোন ও নানা-নানি, দাদি ছিল। দাদা ছিল না।

ট্রেনিং ও কোন সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ

সাবেক এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বলেন, শিক্ষা জীবনে এনসিসিতে ছিলাম। যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। কিছুদিন ট্রেনিংয়ের পর মাঝাপথে গ্রামে ফিরে আসি। সেখানে এসে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল (ইপিআর) এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে আগ্রহীদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। স্থানীয় সেই বাহিনীর কমান্ডার ছিল ইপিআর সদস্য লুৎফর রহমান বিশ্বাস।  

তিনি বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউর গনি ওসমানী স্থায়ী সরকারের অধীনে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে ৬৪টি মহাকুমাকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন। আমরা ৮ নম্বর সেক্টরে ছিলাম। এটা ছিল সব থেকে বড়। প্রখমে সেক্টর কমান্ডার আবু উসমান চৌধুরী আগস্ট অথবা জুলাই পর্যন্ত ছিলেন। এরপর আসলেন মেজর আবুল মঞ্জুর।
 
যেসব স্মৃতি আজও কাঁদায়

৮ ডিসেম্বর নড়াইলে এক বীর মুক্তিযোদ্ধাকে (শহীদ মিজানুর রহমান) মেরে হাত এবং পা বাঁশে বেঁধে একটি স্টুডিওর সামনে ফেলে পাকবাহিনী ছবি তুলেছিল। ওই ছবিটা স্টুডিওর মালিক দেশ স্বাধীনের পরে জেলা কমান্ডার থাকাকালীন আমাকে দিয়েছিল। এছাড়া ১০ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর হেডকোয়ার্টার পানি উন্নয়ন বোর্ডের অভ্যন্তরে যেখানে গণকবর, সেখানে আমরা হামলা করি। ওইদিন সম্মুখযুদ্ধে মতিয়ার নামে একটা ছেলে মারা যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিতে পারলে হয়তো বাঁচতো, রক্তঝড়ে রক্তের অভাবেই শেষ পর্যন্ত সে মারা যায়।

শহীদ মিজানুর রহমানের লাশ

তিনি বলেন, যখন সবাই একসঙ্গে থাকতাম তখন কেউ এসে যদি বলত কারও আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু হয়েছে; এটা শুনে যতটা না কষ্ট পেতাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট পেতাম রণাঙ্গনে গুলি খেয়ে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে। কারণ এভাবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মারা গেলে কীভাবে দেশ স্বাধীন করব? এই ভেবে।

নড়াইল গণকবর

পাকহানাদাররা পিস কমিটির নিয়ন্ত্রণে কাজ করত। তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিল মাওলানা সোলাইমান। তোলালামপুর গ্রামে বাড়ি। ওইগ্রামে তার শত্রু যারা ছিল তাদের বাড়ি থেকে রাজাকার দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে আসল। এরপর তাদের দিয়েই কবর খুঁড়িয়ে কবরের সামনে দাঁড় করিয়ে রাজাকার দিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে মাটি চাপা দেয়। এই হচ্ছে নড়াইল গণকবর। ওখানে (কবরে) ৮ জন রয়েছেন।

বিজয় উৎসব ও আক্ষেপ

১০ তারিখে নড়াইলে আমরা বিজয় অর্জন করলাম। স্বাভাবিক বিজয় অর্জনের পর একটা আনন্দ উৎসব ভেতরে আসে। এখানে ৫৪ জন হানাদার-রাজাকার ছিল। তাদের জেলখানায় নিয়ে ঢোকালাম। কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকে গেল আজকে নড়াইল হল, কয়েকদিন আগে যশোর হয়েছে, এমন হচ্ছে। কিন্তু পুরাটা কখন স্বাধীন হবে। ১৬ ডিসেম্বর তারা আত্মসমর্পণ করে। এরপর উল্লাস শুরু হয়ে গেল।
 

বীর মুক্তিযোদ্ধারা আর আর্থিক অনটনে নেই। এখনও কিছু প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যারা তালিকাভুক্ত হননি। অথচ যারা মুক্তিযুদ্ধ করেননি এমন অনেকেই টাকা পাচ্ছেন। তবে যারা টাকা পাচ্ছেন তারা আর্থিক অনটনে নেই।

আরও একটি কষ্টের বিষয় পাকিস্তান আমলে দেশের আমলারা দেখেছি, কোনো জায়গায় বক্তৃতা দিতে গেলে বলতেন, পাকিস্তান জিন্দাবাদ। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সরকারি আমলাদের দেখেছি, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলেছে। কিন্তু এখন জয় বাংলা কেউ বলেন না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বক্তৃতা শেষে জয় বাংলা শব্দটা কেউ ব্যবহার করে না। 

বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাই বিশ্বাস বলেন, মুক্তিযোদ্ধা ভাতাপ্রাপ্ত সকলেই বর্তমানে ভালো আছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকার জমি-বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এছাড়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাসের ব্যবস্থা করেছেন। নড়াইল সদরে ২৮৩, কালিয়ায় ৭১৮ ও লোহাগড়ায় ১ হাজার ৩০২ জন গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন।

এমএসআর