বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ মজুমদার

‘আমার মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমি যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি শুনেই মা কান্নাকাটি শুরু করেন। খুব সোচ্চার ছিলেন যেন আমি যুদ্ধে যেতে না পারি। তবে আমার বাবার অনুপ্রেরণায় মাকে না জানিয়ে যুদ্ধে চলে যাই। কয়েক সপ্তাহ পর বাড়ি থেকে খবর আসে আমার জন্য মা কান্নাকাটি করেই যাচ্ছেন। আহাজারির সময় পড়ে গিয়ে মা হাত ভেঙে ফেলেছেন।’

‘সেদিন রাতে মাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তান বাহিনী আমাকে গ্রেফতার করে। এরপর এলাকার গণ্যমান্যরা আমার পক্ষে সুপারিশ করেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিনি’ এই মর্মে নিয়মিত হাজিরা দেওয়ার শর্তে আমাকে ছেড়ে দিয়েছিল। তখন আমি আবার আমার বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’

কথাগুলো বলছিলেন মায়ের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে দেশের জন্য নিজের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা এক সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ মজুমদার (৭২)। তিনি হলেন কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার নাথেরপেটুয়া বিনয়ঘর এলাকার বাসিন্দা। ঢাকা পোস্টের এ প্রতিবেদককে একান্ত সাক্ষাৎকারে এই স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

কোথায় কার অধীনে প্রশিক্ষণ

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ মজুমদার বলেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণের পর আমাদের এলাকা নাথেরপেটুয়াতে মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলি। এই পরিষদে বিভিন্ন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি সদস্য যোগ দেন। পরবর্তীতে ২৫ মার্চ কালরাতের পর আমারা আরও তৎপর হয়ে যাই। তখন আমাদের প্রশিক্ষণ দেয় সুবেদার লুৎফর রহমান। পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় তখন আমরা পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে পিছু হটতে বাধ্য হই।

তারপর আমরা ২৩ এপ্রিল চৌদ্দগ্রাম চিওড়া দিয়ে ভারত চলে যাই। তখন আমার সঙ্গে ছিলেন মান্নান, মাকসুদসহ কয়েকজন। আমরা ভারতের কাঁঠালিয়া ক্যাম্পে প্রশিক্ষণে যোগদান করি। সেখানে আমাদের এমপি জালাল সাহেব ছিলেন। এই ক্যাম্পে ঝুঁকি থাকায় আমাদের স্থানান্তর করা হয় বুড়িমারী ক্যাম্পে। সেখানে প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের গোলাবারুদ দিয়ে দেশে পাঠানো হয়।

সাঈদ মজুমদারের যুদ্ধক্ষেত্র ও সেক্টর

বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ মজুমদার ২ নম্বর সেক্টরে কুমিল্লা ও নোয়াখালী অংশে গেরিলাযোদ্ধা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ।

আবু সাঈদ মজুমদারের ঢাকা পোস্টেকে বলেন, মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ হয়েছে। কোথাও গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছি, কোথাও গুলি করেছি। তখন মুক্তিযুদ্ধ ততটা সুসংগঠিত ছিল না।

যুদ্ধকালীন স্মরণীয় ঘটনা

যুদ্ধকালীন স্মরণীয় ঘটনা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবু সাঈদ মজুমদার বলেন, ফেনীর মাতুভূঁইয়ায় আমরা অস্থায়ী ক্যাম্প করে যুদ্ধের পরিকল্পনা করি। রাজাকাররা আমাদের অবস্থান পাক হানাদার বাহিনীদের জানিয়ে দেয়। তারা আমাদের চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। আমাদের বেঁচে ফিরে আসার কোনো পথ খোলা ছিল না। এ সময় আমাদের কয়েকজন সহযোদ্ধা গুলিতে মারা যান। তখন আমি ছদ্মবেশ ধারণ করে হামাগুড়ি দিয়ে কোনোরকম একটি বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম।

তিনি আরও বলেন, পবরর্তীতে গৈয়ারভাঙ্গা এলাকায় পরিকল্পিতভাবে পাক হানাদার বাহিনীকে আক্রমণ করি। তখন আমাদের সঙ্গে তাদের সরাসরি যুদ্ধ হয়। পাকিস্তান বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আমরা জয়ের বেশে এগিয়ে যাই। তারপর লাকসাম আসি। তখন পাক হানাদার বাহিনী অস্ত্রের মুখে টিকতে না পেরে পরাজয় বরণ করে। তখন লাকসাম হানাদারমুক্ত হয়।

কয়েক মাস যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কি না, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সাঈদ মজুমদার। তিনি বলেন, কয়েক মাস আমরা লুকিয়ে যুদ্ধ করেছি। যখন ভারত ও ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল। সেই সঙ্গে ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

তখন থেকে আমাদের সাহস বেড়ে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হতে এখন মাত্র সময় ব্যাপার ছিল। বিমান হামলা ও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর তৎপরতায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে দীর্ঘ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

কুমিল্লাজুড়ে তখন আনন্দ মিছিল চলছিল। আমরা আনন্দে আত্মহারা। যখন দেশ স্বাধীন করে বাড়িতে ফিরে যাই। তখন আমাকে মা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে বলেন, ‘আমি আকাশের চাঁদ পেয়েছি’। মা এত খুশি হয়েছে যা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান অবস্থা ও প্রাপ্তি স্বীকার

আবু সাঈদ মজুমদার বলেন, যারা মুক্তিযুদ্ধে না করেও নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সম্মানীভাতা নেন তাদের দেখলে আমি খুবই কষ্ট পাই। আমি অন্তর থেকে তাদের ঘৃণা করি। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে অমুক্তিযোদ্ধাদের যেন বাদ দেওয়া হয়। অপরদিকে কিছু সত্যিকারের যোদ্ধা প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন তারা বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে পারেনি। রেকর্ডে না আসায় তারা সার্টিফিকেট পাননি। তবে কিছু মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে জয়বাংলা বলে স্লোগান-মিছিল করেনি তারাও এখন বীর মুক্তিযোদ্ধা।

বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে আবু সাঈদ মজুমদার বলেন, বেঁচে থাকতে এত সুন্দর বাংলাদেশ দেখব আমরা আশা করতে পারি নাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে দেশের অনেক উন্নয়ন করেছেন। আমি দোয়া করি তিনি যেন দীর্ঘদিন বেঁচে থেকে দেশটাকে সুন্দরভাবে চালান।

জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে বর্তমান সরকার আমাদের যে সম্মানে ভূষিত করেছে তাতেই আমরা খুশি। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন, ঘর নির্মাণ, সম্মানীভাতা সব কিছুই মিলে আমরা এই সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ। কষ্টে অর্জিত এই বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এমনটাই প্রত্যাশা করি।

কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার সফিউল আহমেদ বাবুল বলেন, গেজেটভুক্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় দেশের সব জেলা থেকে সর্বোচ্চসংখ্যাক বীর মুক্তিযোদ্ধা কুমিল্লার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন। যার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৯ হাজার। এর মধ্যে  নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন ৮৫ শতাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

আবু সাঈদ মজুমদার ১৯৫২ সালে তৎকালীন লাকসাম জেলার মনোহরগঞ্জের নাথেরপেটুয়া বিনয়ঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৃত নজর আলী ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। তার মা জোবেদা খাতুন। পরিবারে রয়েছে ৫ ভাই ও ২ বোন। পাকিস্তান আমলে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন ও কর্মজীবনে আবু সাঈদ মজুমদার চট্টগ্রাম পোর্টে কর্মরত ছিলেন। তার এক ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে।

এমএসআর