বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র সরকার

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযোদ্ধা ছিলেন সুভাষ চন্দ্র সরকার। চোখের সামনে হারিয়েছিলেন ৪ যোদ্ধা সঙ্গীকে। সেই স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি এই যোদ্ধা। সেই স্মৃতি মনে পড়লে এখনো চোঁখের পানি ফেলেন তিনি।

যুদ্ধের ৫০ বছর পর এসেও দেখছেন, স্বাধীনতার সেই মূল্যবোধ, বাঙালির জাতীয়তাবাদ থেকে অনেক দূরে সরে গেছে বাংলাদেশ। খেলাধুলাও দেশের বিপক্ষে পতাকা হাতে অবস্থান নেয় বাঙালিরা। নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট দেয় রাজাকার। দেশ শাসন করবে জনপ্রতিনিধি কিন্তু করছেন কারা? এমন নানা প্রশ্ন তার।

এখন মুক্তিযোদ্ধা হতে চাপ দেয় অনেকে। প্রভাব বিস্তার করে আমাদের বাধ্য করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা বানাতে। এভাবেই যুদ্ধকালীন সময়ের নানা স্মৃতি ও বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র সরকার। স্মৃতিময় সেই দিনগুলির কথা মনে করে চোখের পানি ফেলছেন আর নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে আক্ষেপ করেছেন এই যোদ্ধা।

যুদ্ধে যাওয়ার প্রেরণা

আমি তখন ছাত্র। দেশে সাধারণ নির্বাচন হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন, প্রাদেশিক নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। আলোচনা চলছে দেশে সরকার কীভাবে গঠন হবে। আলোচনা যখন ভেস্তে গেল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সারাদেশে আতর্কিতভাবে একযোগে হামলা চালাল।

সেই অংশ হিসেবেই আমাদের গোয়ালপোতা গ্রামেই আক্রমণ চালাল হানাদার বাহিনীরা। গ্রামের এই বিধ্বস্ত পরিস্থিতি দেখে আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা পেলাম। উপলদ্ধিতে আসল পাকিস্তানিরা আমাদের ক্ষমতা দেবে না। আমাদের যুদ্ধ করেই ক্ষমতা নিতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে হবে।

যেভাবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ

১৯৭১ সালের এপ্রিলে তালা থানার নগরঘাটা ইউনিয়নের গোয়ালপোতা গ্রামে যখন পাকহানাদার বাহিনী গ্রামবাসীর ওপর হামলা করে লুটতরাজ চালায় তখন এই দৃশ্য দেখে আমি ব্যথিত হই। আমি শরণার্থী হয়ে ভারতে যাই। ভেবেছি এই শরণার্থী জীবন আমাদের জীবন নয়। তখন ভারতের বশিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা এমএনএ গফুর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করছেন। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছেন।

তখন আমি যুদ্ধে যাওয়ার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার জন্য আবেদন করি। তকিপুরে ১৮ দিনের ট্রেনিং করি। এরপর বিহারের চাকুলিয়ায় ১ মাসের গেরিলা ট্রেনিং করি। তারপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টার কল্যাণীতে ফিরে আসি। সেখান থেকে যার যার এলাকায় ফিরে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

আমাদের ১৩ সদস্যের গেরিলা একটি টিম করে তালা এলাকায় যুদ্ধ করার জন্য পাঠানো হয়। আমিসহ ১৩ জন গেরিলা তালায় আসলাম। এসে তালার মাগুরায় অবস্থান নিয়েছিলাম। মাগুরায় আমাদের ক্যাম্প ছিল। মুজিব বাহিনীর তৎকালীন ক্যাম্প ছিল সাতক্ষীরা জেলার বাতুয়াডাঙ্গায়।

একদিকে রাজাকার, অন্যদিকে নকশাল

আমরা ফিরেই রাজাকার পাকিস্তানিদের কীভাবে এই অঞ্চল থেকে হঠানো যায় সেই পরিকল্পনা ও কার্যক্রম শুরু করি। তবে যুদ্ধে আমাদের প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায় নকশালরা। এই নকশালরা লুটতরাজ করতো। তাদের হঠানো একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াল। আমরা দ্বিমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়ে গেলাম। একদিকে রাজাকার, অন্যদিকে নকশালদের মোকাবিলা করা।

নকশালরা এলাকায় চুরি, ডাকাতিসহ মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া, এসব কাজ করতো। এই অবস্থার মধ্যদিয়ে বিভিন্নস্থানে অপারেশনে অংশ নেই। কপিলমুনি ছিল এই অঞ্চলের রাজাকারদের ঘাঁটি। আমরা সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই সিদ্ধান্ত মাফিক এই অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধারা একত্র হয় যশোর, কেশবপুরসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন জায়গা থেকে।

পাকিস্তানিদের অতর্কিত হামলা, হারালাম ৩ যোদ্ধা

কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা মাফিক যখন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রম চলমান ঠিক সেই মুহূর্তে মাগুরায় পাকিস্তানিরা আমাদের ওপর অতর্কিতভাবে আক্রমণ করে ২৫ নভেম্বর। তালার মাগুরায় আমাদের অবস্থান জেনে তারা আমাদের ওপর হামলে পড়ে। সেটি ছিল বড় ধরনের যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে আমরা আবু বক্কার, সুশীল ও আজিজ এই তিনজনকে হারালাম। আমাদের সঙ্গে একমাত্র এলএমজি ম্যান ছিল মন্টু, সেও আহত হলো।

গুরুতর আহত অবস্থায় কোনোরকমে তাকে রেসকিউ করে পার্শ্ববর্তী গ্রাম দোহারে নিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নদীপথে উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। এই যুদ্ধে আমাদের এমন শোচনীয় অবস্থা হওয়ার কথা না। তবে কপিলমুনি যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের অস্ত্র ছিল, সেগুলো কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প উড়িয়ে দেওয়ার জন্য সেদিকে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আমরা এদিকে বেরিকেড সৃষ্টি করি। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের ওপর চলে এ হামলা। সংখ্যাও আমরা কম ছিলাম। পজিশনটাও শত্রু মোকাবিলা করার জন্য ভালো ছিল না।

যুদ্ধকালীন স্মরণীয় ঘটনা

বিহারের ট্রেনিং নেওয়ার পরে আমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব দিল যে, পাকিস্তানিরা যে অ্যান্টি মাইন স্থাপন করেছে সীমান্তে সেগুলো অপসারণ করো। সেগুলো অপসারণ করতে গিয়ে বৈকারীতে একজন সঙ্গীর পা উড়ে গেল। সে যে কি বীভৎস অবস্থা! আমি ভীষণভাবে আপসেট হয়ে গেলাম। দেশ স্বাধীন করতে হবে এটা ভেবে চিন্তা করালাম যে, আমরা আরও বেশি সতর্ক হব।

আমরা হলাম গেরিলা, আমাদের কাজ হচ্ছে হিট এবং রান। আমরা তো শত্রুর মুখোমুখি হব না। আমরা শত্রুকে তাদের অসতর্ক অবস্থায় আক্রমণ করব। সুতরাং আমরা আরও বেশি সতর্ক অবস্থায় চলব। এরপর বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আরও দৃঢ় মনোবল নিয়ে আবার কাজ শুরু করলাম। পরে ক্যাম্পে চলে গেলাম। এরপর আহত অবস্থায় মারা যান সেই সঙ্গী।

 
আরেকটি স্মৃতির কথা মনে করে চোখের পানিতে ভাসেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র সরকার। তিনি বলেন, মাগুরার যুদ্ধ। নভেম্বরে সেই যুদ্ধের কথা আমি ভুলতে পারি না। আমার পাশেই বুকে গুলি লাগল তিন সঙ্গীর। তারা বলল যে, ‘আমাদের বাড়িতে সংবাদ দেবেন, আপনি আমাদের লিডার। শত্রুর মোকাবিলা করতে গিয়েই আমরা শহীদ হয়েছি। আমরা ভীরু কাপুরুষের পরিচয় দেয়নি। এই কথা বাড়িতে জানিয়ে দেবেন। আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে শহীদ হচ্ছি। আমরা বাঁচবো না। এই কথাগুলো বাড়িতে জানিয়ে দেবেন।’

এই কথা আমি আজও ভুলতে পারিনি। আমি বলেছিলাম, ‘জানিনে আমি বাঁচব কি না। তবে তোমাদের কথা জাতি চিরদিন মনে রাখবে। তোমাদের কথা জাতির কাছে অবিনশ্বর হয়ে থাকবে। যদি বেঁচে থাকি, তবে তোমাদের কথা আমি সবাইকে জানিয়ে দেব।’ যখন রাত হলো, গোলাগুলি শেষ হলো। তিনজন শহীদকে একই জায়গায় সমাধিস্থ করি। হিন্দু মুসলমান একই জায়গায় শুইয়ে দেই। হিন্দু-মুসলিম আমরা দেখিনি।

এখন চাওয়া কী?

আজকের বাংলাদেশের যে তরুণ যুব সম্প্রদায় বাংলাদেশের যে ইতিহাস সেটা ভালোভাবে জেনে ১৯৭১ সালের যুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহীদের চেতনা ধারণ করে দেশ পরিচালনা করুক, ত্যাগের মূল্যায়ন করুক, তাদের ত্যাগের গুরুত্ব দিক। তাহলেই দেশ চলবে। ছোট দেশ হলেও সমস্ত কিছুতেই আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব। কারো মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না।

বর্তমানে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান সমস্যা

এখন অনেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হতে চাই। আমাদের প্রেশার দেয় তাদের মুক্তিযোদ্ধা বানাতে হবে। তার জন্য কেউ কেউ আর্থিক সুযোগ সুবিধা নিচ্ছেন। এর থেকে কীভাবে বাঁচব? সেটার কোনো পথ পাচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী, জামুকা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। কেননা টাকা নিয়ে প্রভাব বিস্তার করে আমাদের বাধ্য করছে বীর মুক্তিযোদ্ধা বানাতে, আমরা এখন অসহায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র সরকার সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নগরঘাটা ইউনিয়নের গোয়ালপোতা গ্রামের জ্ঞানেন্দ্রনাথ সরকারের ছেলে। বর্তমানে সাতক্ষীরা শহরের আমতলা এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন তিনি। বাড়িতে পত্রিকা পড়ে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে যুদ্ধের গল্প শুনিয়ে এখন সময় কাটে বীর মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ চন্দ্র সরকারের।

বাড়ির আঙিনায় ফুলের বাগানেও পরিচর্যা করেন অবসর সময়ে। এক ছেলে ও দুই মেয়ে সন্তানের জনক তিনি। ছেলে রাহুল সরকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় ইউনিয়ন সমাজকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন। মেয়ে রাখি সরকার গৃহিণী ও বন্যা সরকার একজন সমাজসেবী। সাতক্ষীরা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন সুভাষ চন্দ্র সরকার। বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। বর্তমানে ৭১ সালের বধ্যভূমি ও স্মৃতি সংরক্ষণ কমিটি সাতক্ষীরা জেলা শাখার আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

এমএসআর