এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ইঞ্জিনরুম থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন। তবে বরিশাল রুটের পাঁচতারকা লঞ্চগুলোর প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনচালকরা বলছেন, ইঞ্জিন বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অসম্ভব।

২০ থেকে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তারা বলছেন, ইঞ্জিন বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের ইতিহাস কারও জানা নেই। বরং অভিযান-১০ লঞ্চে পরিকল্পিত নাশকতা হতে পারে বলেও ধারণা তাদের। এ জন্য তদন্তে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনারও দাবি জানান তারা।

ঢাকা-বরিশাল রুটে চলাচলকারী এমভি মানামী লঞ্চের প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনচালক আবু সাইদ বলেন, ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগলে এত অল্প সময়ের মধ্যে পুরো জাহাজ (লঞ্চ) ধ্বংস্তূপে পরিণত করতে পারে এমন না। ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হলে আগুন লাগার কোনো কারণই নেই। ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হলে ইঞ্জিন বিকল হতে পারে বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে। বিস্ফোরণ হলে যন্ত্রাংশ ছিটকে গিয়ে কারও গায়ে পড়লে তিনি আহত হতে পারেন কিংবা মারা যেতে পারেন। কিন্তু অমন আগুনের সূত্রপাত বা আগুন ছড়িয়ে পড়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

এই ইঞ্জিন বিশেষজ্ঞ বলেন, আগুনের সূত্রপাত হতে পারে শর্টসার্কিট থেকে। কিন্তু এখন যেসব লঞ্চ নদীতে নামানো হয়, সেগুলোতে শর্টসার্কিট হলে বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা থাকে।

অভিযান-১০ অগ্নিকাণ্ডের প্রসঙ্গে এই চালক বলেন, ওই রাতে নদীতে কুয়াশা ছিল। এতে লঞ্চটি শ্লথ গতিতে চলছিল। যদি অতিরিক্ত গতিতে চলত, তাহলে ইঞ্জিন বিস্ফোরণ ঘটতে পারত। তাতেও তো আগুনের সূত্রপাত হওয়ার কথা না।

আবু সাইদ বলেন, আমি মনে করি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা। ইঞ্জিনরুম কিংবা কেবিন যেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত হোক, অত অল্প সময়ে পুরো জাহাজে আগুন ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটতে পারে না নাশকতা ছাড়া।

তিনি বলেন, আগুন অল্প থেকে ভয়াবহভাবে ছড়িয়েছে। সাধারণত লঞ্চে আগুন লাগলে আমরা তা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। লঞ্চে যদি অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা না-ও থাকে, তারপরও আগুনের সূত্রপাত নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব। কারণ লঞ্চে আগুন লাগার মতো ভয়ংকর রকমের কোনো জিনিস থাকে না। আমি বিশ্বাস করি না, ওই লঞ্চে ইঞ্জিনরুম বা ইঞ্জিন বিস্ফোরণে আগুন লাগতে পারে। তাই এটি নাশকতা।

এমভি পারাবত-১৮ লঞ্চের ইঞ্জিন রুম ইনচার্জ ও সিনিয়র ইঞ্জিনচালক মিজানুর রহমান দীর্ঘ ২২ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হলে আগুনের সূত্রপাতের কোনো কারণই নেই। বিস্ফোরণ হলে ইঞ্জিনের লাইনার বা পিস্টন ছিটকে পড়তে পারে। কিংবা ইঞ্জিনটি পুরোপুরি বাতিল হয়ে যেতে পারে।

মিজানুর রহমান নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, লঞ্চের ইঞ্জিন থেকে আগুনের কোনো ধরনের সূত্রপাত হতে পারে না। আমি ২২ বছর কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হতে দেখেছি। কিন্তু তাকে কখনোই আগুনের সূত্রপাত হয়নি।

তা ছাড়া জেনারেটর বিস্ফোরণ হলে বা জেনারেটরে সমস্যা দেখা দিলে বিদ্যুতের ভোল্টেজে তারতম্য দেখা দেবে। তখন তো ইঞ্জিনরুমে যে দায়িত্বে থাকবেন, তিনি জেনারেটর বন্ধ করে দেবেন। আবার যদি শর্টসার্কিট হয় তাহলে বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ের বিঘ্নতার কারণে জেনারেটর বন্ধ হবে। আগুন কেন লাগবে?

তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ইঞ্জিন থেকে আগুন লাগলে আগে তো নিচতলা পুড়বে। তারপর ওপরের তলায় যাবে। কিন্তু এত দ্রুত ওপরের তলায় আগুন ছড়িয়ে পড়বে কেন? লঞ্চে যদি অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নাও থাকে বা ইঞ্জিনরুমে আগুন লাগে, তাহলেও আগুন দোতলা, তিনতলায় ছড়িয়ে পড়তে পারে না। কারণ, ইঞ্জিন তো থাকে লঞ্চের একেবারে নিচে। সেখানে আগুন লাগলে আর কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও চারপাশে নদীতে পানির ব্যবস্থা তো আছে।

তবে আমি প্রাথমিকভাবে মনে করছি, আগুন ওপরের তলা থেকে এসেছে। অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা কোনো দুর্ঘটনা নয়, একজন ইঞ্জিনচালক হিসেবে আমি মনে করি এটি একটি নাশকতা। তিনি বলেন, আপনি খেয়াল করে দেখবেন অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিন কিন্তু ঠিক আছে। কোথাও ভাঙা নেই। সেটি বিস্ফোরিত হয়নি।

পারাবত-১৮ লঞ্চের গ্রিজার মো. তসলিম বলেন, ইঞ্জিন অতিরিক্ত গরম হয়ে বিস্ফোরণ হলেও আগুন লাগতে পারে না। আমি দীর্ঘদিন ইঞ্জিনরুমে কাজ করি। ইঞ্জিন বিস্ফোরণ দেখেছি। কিন্তু বিস্ফোরণে আগুন লাগার কোনো ঘটনা ঘটতে দেখিনি। আমার মনে হয়, কোনো চক্রান্ত হিসেবে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

ঝালকাঠির বাসিন্দা ফিরোজ হাওলাদার দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে লঞ্চ, ট্রলার, কার্গো, বাল্কহেড সারেন। তিনি বলেন, আমরা হাতেকলমে কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। কিন্তু ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হয়ে আগুনের ঘটনা ঘটবে এমন দাবি যারা করছেন, তাদের কথা আমি মানতে পারলাম না। আমি মনে করি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা শর্টসার্কিটের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। শর্টসার্কিটেই পুরো লঞ্চে আগুন ছড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ঝালকাঠি লঞ্চঘাটে এর আগেও একটি জাহাজে ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হয়েছিল। কিন্তু তাতে আগুন লাগেনি। বিস্ফোরণ হলে ইঞ্জিন ভেঙেচুরে যেতে পারে। যন্ত্রাংশ ছিটকে জাহাজ ছিদ্র হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আগুন লাগার কোনো কারণই নেই।

৩৫ বছর ধরে ইঞ্জিন মেকানিক পেশায় থাকা বাবুল হাওলাদার বলেন, অতিরিক্ত গতিতে চালালে বা পানি না থাকলে ইঞ্চিন বিস্ফোরণ হতে পারে। কিন্তু এতে আগুনের কিছুই নেই।

যদিও রোববার (২৬ ডিসেম্বর) অভিযান-১০ লঞ্চে আগুনের ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল ইসলাম প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনাস্থল পরিদর্শনের আলোকে প্রাথমিকভাবে মনে করেছেন, ইঞ্জিন থেকেই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ইঞ্জিনে ত্রুটি পেয়েছি। যদিও এখনো তদন্ত চলমান। তাই এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশে ছেড়ে আসে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চ। ঝালকাঠি জেলার সুগন্ধা নদীতে রাত ৩টার দিকে লঞ্চটিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে এখন পর্যন্ত ৩৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক জোহর আলী।

এ ছাড়া অগ্নিদগ্ধরা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। আহত হয়েছেন কয়েক শ। ওই লঞ্চে ওই রাতে এক থেকে দেড় হাজারের মতো যাত্রী ছিল বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঢাকা, বরগুনা ও ঝালকাঠিতে মোট তিনটি মামলা করা হয়েছে। সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) সকালে ঢাকায় গ্রেফতার হন লঞ্চের মালিক হামজালাল শেখ।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এনএ