সুগন্ধা নদীতে লঞ্চে লাগা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে দেহ। চেনার উপায় নেই স্বজনদেরও। মরদেহ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় পরিচয় মেলার আগেই করা হয়েছে দাফন। অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যুর চেয়েও এ দাফন যেন আরও বেদনাদায়ক ছিল। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে বরগুনার পোটকাখালী গ্রামের গণকবরস্থল।

সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) বিকেলে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে অজ্ঞাতদের স্বজনদের নমুনা সংগ্রহ করতে সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষক রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের একটি মেডিকেল টিম আসে বরগুনায়। এ সময় ৩৫ স্বজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়।

রোববার (২৬ ডিসেম্বর) রাত ৮টা থেকে বরগুনার বিভিন্ন এলাকায় পোটকাখালী গণকবরে ২৩ অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্ত করতে স্বজনদের প্রতি নমুনা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করে বরগুনা জেলা প্রশাসন।

এর আগে শনিবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুরে অজ্ঞাত পরিচয়ের ২৩টি মরদেহ একে একে দাফন করা হয়েছে। মরদেহ দাফন করা হলেও সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে তাদের নমুনা। করা হবে ডিএনএ পরীক্ষা। এরপর জানা যাবে অঙ্গার হওয়া মরদেহের পরিচয় এবং খোঁজ মিলবে স্বজনদের। যদিও তখন এসে শুধু কবর চিহ্নিত করা ছাড়া স্বজনদের আর বেশি কিছু করার থাকবে না।

কবরের পাশেই গেঁথে দেওয়া হয়েছে একটি করে লাঠি এবং লাঠির মাথায় লাগানো হয়েছে অ্যাপিটাফের মতো একটি করে বোর্ড। যেখানে লেখা রয়েছে, অভিযান-১০ লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণকারী। পরিচয়: অজ্ঞাত। এর নিচেই লেখা রয়েছে জিডি নম্বর।

জেলা প্রশাসনের কাছে আসা তথ্য অনুযায়ী, বরগুনায় এখনো ৭ পুরুষ, ৮ নারী ও ১১ শিশুসহ ২৬ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। হয়তো এই ২৩ কবরের মধ্যেও থাকতে পারে তাদের মরদেহ।

বরগুনা সদর হাসপাতালে নমুনা দিতে এসেছেন সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের আমতলী গ্রামের ষাটোর্ধ্ব কনু হাওলাদার। হাতে একটি কাগজ নিয়ে দিগবিদিক ছুটে চলেছেন তিনি। বারবার চিৎকার করে বলছেন, ‘আমার আদরের ধন আবদুল্লাহ কই? অজ্ঞাত পরিচয় লাশের জানাজার দিন বারবার কফিনবন্দি লাশগুলোর মুখ খুলে খুলে দেখছিলেন বলে জানান তিনি। শত চেষ্টার পরও প্রিয় স্বজনের চেহারার সঙ্গে মিল খুঁজে পাননি সেদিন। তাই হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল তাকে।

কনু হাওলাদার বলেন, ঝালকাঠি, বরিশাল, বরগুনার সব হাসপাতালে খুঁজেছি কিন্তু কোথাও আমার ছেলে, ছেলের বউ ও নাতিকে খুঁজে পেলাম না। বরগুনায় যে লাশ আনা হয়েছিল, তাও সবগুলো ভালো করে খুঁজে দেখেছিলাম। কিন্তু বুঝে উঠতে পারিনি, কোথায় আমার আদরের ধনের লাশ।

নান্না হাওলাদার নামের আরেক স্বজন বলেন, আমার বোনও সেদিন ওই লঞ্চে ছিল। আগুন লাগার পর থেকে আর তার খোঁজ পাইনি। গণকবরে যে মরদেহগুলো দাফন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আমার বোন আছে কি না, তাও বুঝতে পারছি না। মরদেহগুলো এমনভাবে পুড়েছে দেখে বোঝারও কোনো উপায় নেই।

সিআইডির ডিএনএ পরীক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, আমাদের সর্বোচ্চ এক মাস সময় লাগতে পারে। কারণ ডিএনএ বের করতে প্রায় ২০ দিন সময় লাগে। যতটা দ্রুত সম্ভব এক মাসের মধ্যে আমরা রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করব।

বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, বরগুনায় লাশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে আমরা পোটকাখালী গণকবরে ২৩টি অজ্ঞাত পরিচয়ের লাশ দাফন করেছি। আমরা প্রতিটি লাশে একটি ক্রমিক নম্বর ব্যবহার করেছি এবং সেই অনুযায়ী ঝালকাঠি স্বাস্থ্য বিভাগ সব লাশের নমুনা সংগ্রহ করে রেখেছে। স্বজন যারা নিখোঁজ প্রিয়জনকে খুঁজে পাননি, সিআইডি নমুনা সংগ্রহ করছে, আমরা দাফন করা লাশের নমুনা মিলিয়ে শনাক্ত করে স্বজনদের কবর বুঝিয়ে দেব।

উল্লেখ্য, ঢাকা থেকে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে অভিযান-১০ লঞ্চ। রাত ৩টায় সুগন্ধা নদীতে চলমান লঞ্চে আগুন লাগে। মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুনের লেলিহান। প্রাণ বাঁচাতে যাত্রীরা ঝাঁপ দিতে থাকেন নদীতে। এতে অনেকে প্রাণে বাঁচলেও নিহত এবং নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন শতাধিক। এ দুর্ঘটনায় সোমবার সকাল পর্যন্ত ৪০ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে দাফনের আগে পরিচয় শনাক্ত হওয়া ১৪টি মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং বাকি অজ্ঞাত ২৩ মরদেহ সরকারিভাবে দাফন করা হয়।

এনএ