বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আজহার আলী হাওলাদার

‘একাত্তরের ২৫ মার্চ। চারিদিকে থমথমে পরিস্থিতি। সবখানে চাপা ভীতি বিরাজ করছিল। বাঙালিরা তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ রাত থেকেই আতর্কিতভাবে হামলা শুরু হলো। সে কি ভয়াবহ পরিস্থিতি! লাশের স্তূপ, মানুষের আহাজারি। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ দেখে কেউ ভাবতে পারেনি, এমনটা হবে।’

‘যুদ্ধ শুরুর আগে তৎকালীন সেনাবাহিনীর সদস্যদের বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) থেকে পাঞ্জাবে আর পাঞ্জাবে থাকা সেনাসদস্যের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয় পাকিস্তান সরকার। বাংলার মুক্তিকামী মানুষের সঙ্গে মিশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে লড়াইয়ের ইচ্ছেটা আগে থেকেই ছিল। মনের ভেতর তখন উত্তাল ঢেউও কাজ করছিল।’

সিদ্ধান্ত নিলাম পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহর থেকে পালিয়ে যাব। তাই করলাম, সেনাবাহিনীর বহর থেকে পালিয়ে ফিরে এলাম গ্রামে। ২৫ মার্চের ঘটনার পর মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে চলে যাই মুক্তিযুদ্ধে।

এটি কোনো গল্প নয়, মৃত্যুকে হাতে নিয়ে একাত্তরের দিনগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে চষে বেড়ানো এক যুবকের বীরত্বের কাহিনি। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আজহার আলী হাওলাদার। তার স্মৃতিতে ফুটে ওঠে যৌবনকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথা।

ঢাকা পোস্টের এই প্রতিনিধিকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মহান মুক্তিযুদ্ধের রোমহর্ষক দিনগুলোর কথা বলেছেন আজহার আলী হাওলাদার। এই সাহসী বীর সন্তান এখন মুদির দোকানদার। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সাথে আলাপকালে পঞ্চাশ বছর আগে অর্জিত বিজয়ের স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার নেপথ্যের ঘটনা

২৫ মার্চ রাত। বরিশালের নিজ বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলেন সিনেমা হলের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল সিনেমা দেখবেন। কিন্তু মাঝপথেই কানে ভেসে আসে গণসংগীতের সুর। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট মঞ্জু রহমানের বাসার সামনে বসেছে গণসংগীতের আসর হয়। সিনেমা দেখা বন্ধ করে গণসংগীতের আসরে যোগ দেন আজহার আলী হাওলাদার।

রাত ১১টার দিকে সেখানে আসেন বর্তমান আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আমির হোসেন আমু। গণসংগীতের আসর থামিয়ে মাইক হাতে ঘোষণা দিলেন ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী হামলা শুরু করেছে। সকলকে দ্রুত অনুষ্ঠান থেকে নিরাপদে বাসায় চলে যাবার কথা বললেন। সকলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যার যার বাসায় চলে গেলেন। সেদিন মনটা ভীষণ উত্তেজিত হয়েছিল। একটা জিদ চেপে বসে, যুদ্ধে যাবার জিদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করব।

আজহার আলী বলেন, ১৯৬৩ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে সদস্য পদে আমার চাকরি হয়। তখনই চিন্তা করেছিলাম জীবনে একবার হলেও যুদ্ধ যাব। সেই প্রত্যয় নিয়ে ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর শিয়াল কোর্ড (ভারত) ও পাকিস্তান যুদ্ধের ফোর্সের তালিকায় তিন নম্বর নামও লিখিয়েছিলাম।

যুদ্ধের আগে থেকেই বাংলাদেশ থেকে তৎকালীন সেনাবাহিনীর সদস্যদের পাঞ্জাবে আর পাঞ্জাবের সদস্যদের বাংলাদেশে পাঠানো শুরু করেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহর থেকে পালিয়ে নিজ বাড়িতে যান আজহার আলী হাওলাদার। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।

আজহার আলী আরও বলেন, যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামের মানুষদের ধরে এনে পাকিস্তান ক্যাম্পে নির্যাতন শুরু করে। নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যা করে। দিনে-রাতে ক্যাম্পের চারপাশে তাকালেই চোখে পড়ত সাধারণ মানুষের লাশ। এ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি থেকে বরিশাল শত্রুমুক্ত করতে শুরু হয় আমাদের মিশন।

কোথায় কার অধীনে ট্রেনিং

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় ফোর্সেস ট্রেনিং থেকে যুদ্ধে যাওয়ার সাহস তৈরি হয়। অবশেষে সেই স্বপ্নপূরণ, তাও দেশমাতৃকার জন্য। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরদিন ২৬ মার্চ সকালে বরিশাল ভেলর্স পার্কে রওনা হন আজহার আলী হাওলাদার। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার পর দেখা হয় মেজর এম এ জলিলের সঙ্গে। তার অধীনে ক্যাম্পে যোগদান করেন।

বরিশাল, পটুয়াখালী, গোপালগঞ্জের পুরোটা আর খুলনা-ফরিদপুরের কিছু অংশ নিয়ে গঠিত হয় ৯ নম্বর সেক্টর। যার দায়িত্বে ছিলেন, মেজর এম এ জলিল। যুদ্ধের সুবিধার্থে নদীবেষ্টিত এ সেক্টরটিকে ভাগ করা হয়, ৩টি সাব-সেক্টরে। প্রায় ২০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রাণপণ লড়েছেন এ সেক্টরে।

আজহার আলী হাওলাদার বলেন, ক্যাম্পে যোগ দেওয়ার পর ২০ নম্বর বাটের রাইফেল ইস্যু করেন মেজর এম এ জলিল। ক্যাম্পের পাশে ম্যাগজিন (গুলি) ভান্ডার থেকে গুলি সংগ্রহের সময়ে সবার চেয়ে বেশি গুলি নেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। এ নিয়ে আমার সহযোদ্ধাদের মধ্যে তর্ক বাঁধে। কোয়ার্টার মাস্টারের মাধ্যমে গুলি সংগ্রহ করে সামনে আসার সাথে সাথে প্রথমে ২০০ গুলি আমার নামে ইস্যু করে মেজর। তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধের সার্বিক দিক নির্দেশনা শোনার পর ব্যারাকে চলে যাই।

মা-বাবার ‘নিষেধ’ অমান্য করে যুদ্ধে যাওয়া

ব্যারাক থেকে রিকশাযোগে রাইফেল ও গুলিসহ বাসায় যান আজহার আলী হাওলাদার। তাকে দেখে কাঁদতে থাকেন তার মা-বাবা। যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেন তারা। সন্তানকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিকে নারাজ মা-বাবা আজহার আলীকে অস্ত্র ফিরিয়ে দিতে বলেন।  বিভিন্নভাবে ভয়ভীতিও দেখান। সেদিন মা-বাবার নিষেধ আর অনুরোধ অমান্য করে যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন আজহার আলী হাওলাদার।

তিনি বলেন, মা-বাবাকে যুদ্ধের বিষয়টা বোঝাতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। এই যুদ্ধ আমার আমাদের সবার মুক্তির জন্য ছিল। পাকিস্তান সরকারের শাসন শোষণ থেকে আলাদা হয়ে একটি দেশ গড়ার জন্য আমি যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমার মতো অনেকেই চাকরি ছেড়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সদস্যদের ছাড়া পাকিস্তানশূন্য। ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের শিয়াল কোর্ডের যুদ্ধে অংশ নেওয়া সকলে ছিল বাঙালি সেনাসদস্য।

আজহার আলী আরও বলেন, পাকিস্তান সেনাসদস্যদের যে প্রশিক্ষণ, আমারও একই প্রশিক্ষণ। কিন্তু মা-বাবাকে তা সহজে বোঝাতে পারিনি। কারণ অনেক মা-বাবাই চাইনি তার সন্তান মৃত্যুকে সাথে নিয়ে যুদ্ধে যাক। তাই পরিবারের অগোচরে পালিয়ে আবারও মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে অস্ত্র ও গুলিসহ চলে যাই।

যুদ্ধের রোমহর্ষক স্মৃতি

অনেক বড় অপারেশন করতে হয়েছে। সবকিছু ছিল ঠান্ডা মাথার পরিকল্পনা থেকে। কত রাস্তাঘাট, ব্রিজ ওড়াতে হয়েছে। বড় বড় গাছ ফেলতে হয়েছে। যাতে পাকিস্তানি হায়েনার দল সামনে এগোতে না পারে। এমন স্মৃতিতো চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় বলে জানান আজহার আলী।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের রাতের বেলা অপারেশন। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন অবস্থাতেই পাকিস্তান বাহিনীর ওপর আঘাত হানতে হবে। এ জন্য আমাদের  প্রচুর আর্টিলারি সাপোর্ট ছিল। হামলার জন্য সব প্রস্তুতি শেষ। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বাজতেই শুরু হয় ঝড়ের মতো গুলিবর্ষণ।

আজও সেই সব কথা মনে পড়লে শরীরে কম্পিত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা আমার দেশের নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে। নদী-মাঠে শুধু লাশ আর লাশ পড়ে থাকতে দেখেছি। যুদ্ধের সময় বিহারিরা নিরীহ মানুষের সবকিছু লুট করে নিত। এ সময় ভোজালি (চাকু) দিয়ে হত্যা করত বিহারীরা।

৭ ডিসেম্বর বরিশাল রহমতপুরে কুদ্দুস মোল্লার দলের সঙ্গে বর্তমান বরিশাল বিমানবন্দরে পাকিস্তান বাহিনীর ঘাঁটিতে আক্রমণ চালায় আজহার আলীর দল। সেদিন বিকেলে বরিশাল শহরে ঢুকে পড়েন তারা। শত্রুমুক্ত হতে থাকায় চারদিক থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বরিশালের দিকে আসতে থাকেন।

সহযোদ্ধাদের নিয়ে স্মৃতিচারণ

সহযোদ্ধা সাবেক আনছার সদস্য চেরাগ আলীকে ভুলতে পারেননি আজহার আলী। কারণ যুদ্ধের রণক্ষেত্র থেকে তার সহযোদ্ধা আর ফিরে আসেননি। খুলনায় একটা যুদ্ধে তিনি মারা যান। যুদ্ধ শেষ করে স্বাধীন দেশে ফিরে এসে সহযোদ্ধার স্ত্রী ও দুই সন্তানের করুণ পরিণতি দেখেছেন তিনি। আনসার সদস্যের স্ত্রী হয়েও মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে সন্তানদের খাবারের ব্যবস্থা করেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী।

আজহার আলী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম দায়িত্ব নেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দায়িত্ব গ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সকলে তাদের আগের কর্মস্থলে যোগদান করবেন। এ ঘোষণারে পরে অনেকেই সাবেক কর্মক্ষেত্রে যোগদান করেন। কিন্তু আমার আর সেনাবাহিনীতে ফিরে যাওয়া হয়নি।
 
বীর মুক্তিযোদ্ধা আজহার আলীর পরিবার

বরিশালের কাজিরহাট সন্তিষপুর গ্রামের বাসিন্দা আজহার আলী হাওলাদার। তার বাবা মরহুম হোসেন আলী হাওলাদার, মা মরহুমা সালেহা বেগম। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা আজহার আলী পাকিস্তান সরকারের আইয়ুব খানের আমলে তৎকালীন সেনাবাহিনীতে সদস্য পদে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার বাসনা থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বহর থেকে পালিয়ে আসেন তিনি।

স্বাধীনতার পরে জীবনসঙ্গী হিসেবে আমেনা বেগমের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আজহার আলী হাওলাদার। সংসার জীবনে তাদের রয়েছে চার ছেলে ও চার মেয়ে। সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ছাড়াও জমি ও ঘর পেয়েছেন আজহার আলী হাওলাদার। বর্তমানে তিনি মুদি পণ্যের ব্যবসা করেন।

এমএসআর