করোনাকালীন স্কুল বন্ধ থাকায় অভাব-অনটনের সংসারে অর্থ জোগান দিতে জেলা শহরের একটি টাইলস ফ্যাক্টরিতে কাজ করত মোস্তাফিজুর রহমান। ছোট ভাই মোস্তাকিম রহমানও সংসারের অভাব ঘোচানোর চেষ্টায় একটি দোকানে কাজ শুরু করে। টানাপোড়েনের সংসারে তবু পড়াশোনা ছাড়েনি মোস্তাফিজুর রহমান ও মোস্তাকিম রহমান।

দুজনই নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মোস্তাফিজুর জিপিএ-৫ পেলেও মানবিক বিভাগ থেকে ছোট ভাই মোস্তাকিম জিপিএ-৪.৪৪ অর্জন করে।

তাদের পড়াশোনার অভিযানে শক্তি জুগিয়েছে শিক্ষক ও সহপাঠীরা। বিনা পয়সায় পড়ানো, পোশাক দেওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্নভাবে তাদের সহযোগিতা করে সহপাঠীরাও। তবে এসএসসিতে উত্তীর্ণ হলেও তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে শঙ্কিত মা মোশনে আরা। যেখানে তিন বেলা পেট ভরে খাওয়া কষ্টকর, সেখানে পড়াশোনা যেন স্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নীলফামারী পৌরসভা এলাকার হাড়োয়া দেবিরডাঙ্গা এলাকার পল্লিচিকিৎসক মাহাবুল ইসলামের ছেলে মোস্তাফিজুর ও মোস্তাকিম। ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাদের বাবা মাহাবুল। চিকিৎসায় সব শেষ হয়েছে তাদের। এখন কোনোরকমে থাকার ঘরের জমিটুকু ছাড়া আর কিছুই নেই তাদের।

সংসার আর পড়াশোনার খরচ জোগাতে মা মোশনে আরা কিছুদিন আগে একটি কোম্পানিতে যোগ দেন। সেখানকার সামান্য আয় দিয়ে সংসার খরচ চলতে থাকে তাদের। অভাবের কারণে মায়ের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বড় ছেলে মোস্তাফিজুর। একটি টাইলস ফ্যাক্টরিতে কাজে যোগ দেয় সে। সেখানে পাওয়া ২০০ টাকা হাজিরা মায়ের হাতে তুলে দেয় সে। চারজনের সংসার কোনোরকমে চলতে থাকে তাদের।

মা মোশনে আরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোস্তাফিজুরের বাবা রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য যেটুকু জমি আর দু-একটি দোকান ছিল, সব বিক্রি করে শেষ হয়ে যায়। ছিল ঋণের বোঝাও। এরই মধ্যে মারা যান তিনি। কিছুই রেখে যাননি। তিন ছেলে আমার। তাদের পড়াশোনা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম।

তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে একটি ফ্যাক্টরিতে যোগ দিই। পড়াশোনার পাশাপাশি বড় ছেলে মোস্তাফিজুরও একটি কোম্পানিতে কাজ করে কিছু পেত। সেগুলো দিয়ে সংসার চালানো হচ্ছিল। কিন্তু তিনজনের পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে স্কুলের স্যাররা দুই ছেলের পাশে দাঁড়ান। বিনে পয়সায় প্রাইভেট পড়ান। পোশাকও কিনে দিতেন। কষ্টের মাঝে দুই ভাই এসএসসি পরীক্ষা দিলে একজন জিপিএ-৫ ও অন্যজন একটু কম পায়।

তিনি বলেন, দুই ছেলে পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু আমার তো কোনো সাধ্য নেই। খরচ চালানো আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি চাই তারা মানুষ হোক। বাবা নেই। কে দাড়াঁবে পাশে?

মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলে, বাবা মারা যাওয়ার পর কীভাবে সংসার চলবে, পড়াশোনার খরচ সব মিলিয়ে অনিশ্চয়তায় অসহায় হয়ে পড়ি আমরা। এমন সময় সহপাঠীরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। স্যাররা না থাকলে তো পাসই করতে পারতাম না। আমরা সংগ্রাম করে এসএসসি পাস করি। কোনো দিনও বাইরে কিছু খেতে পারিনি টাকার অভাবে। আমার মায়ের পক্ষে আমাদের খরচ বহন করা কোনো দিনও সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা দুই ভাই স্বপ্ন দেখি ভালো কিছু করার। আমরা বড় কর্মকর্তা হতে চাই।

ছোট ভাই মোস্তাকিম রহমান বলে, মায়ের পাশাপাশি বড় ভাইও কাজ করে সংসারের খরচ বহন করেছে। কষ্টের কারণে আমিও একটি দোকানে কাজ শুরু করি। অল্প কিছু টাকা পেতাম। সেটিও সংসারে দিয়েছি। বাবা না থাকা কতটা কষ্টের, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। মা-সহ চারজনের সংসার কীভাবে চলবে আর আমাদের পড়াশোনারই বা কী হবে, এ নিয়ে চিন্তিত আমরা।

নীলফামারী সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক বিপ্লব কুমার দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, তারা অত্যন্ত মেধাবী কিন্তু দারিদ্র্য তাদের পেছনে ফেলে রেখেছে। আমরা শিক্ষকরা তাদের পড়িয়েছি। পোশাক দিয়েছি। অনেক কষ্ট করে তারা স্কুলে এসেছে।

তিনি বলেন, বিভিন্ন সময় তাদের খবর নেওয়া হতো। বাবা মারা যাওয়ার পর তাদের সংসার চালানো কষ্টের মধ্যে পড়ে। আমরা চাই মেধাবী দুই ছাত্র যেন নিভে না যায়। তারা পড়াশোনা চালিয়ে যাক। এ জন্য বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত। 

এনএ