ডালা তৈরির কাজে ব্যস্ত এক নারী

কেউ তৈরি করছেন চাটাই, কেউ ডালা, কেউ কুলা আবার কেউ বানাচ্ছেন চালন কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। তাদের ক্লান্তি নেই। বিভিন্ন আকার ও শৈলীতে তৈরি হচ্ছে এসব পণ্য। নীলফামারীর ডোমারের বড়রাউতা দেবীরডাঙ্গা নামক গ্রামটিতেই বাঁশশিল্পীদের বসবাস। যুগ যুগ ধরে এই গ্রামের পরিবারগুলোর নারী-পুরুষ বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য তৈরিতে পারদর্শী।

বাঁশের সঙ্গে এ গ্রামের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। কিন্তু এই মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। বর্তমান প্রযুক্তির যুগে বাঁশ শিল্পের তৈরি বিভিন্ন জিনিসের জায়গা দখল করেছে স্বল্প দামের প্লাস্টিক ও লোহার তৈরি পণ্য। এজন্য বাজারে বাঁশের তৈরি আসবাবপত্রের চাহিদা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প। ফলে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন এই মানুষগুলো।

বাঁশ দিয়ে কলা, চাটাই, ডালা— কী না তৈরি হয় নীলফামারীর ডোমার উপজেলার বড়রাউতা গ্রামে

নীলফামারী জেলাশহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ডোমার উপজেলার বড়রাউতা গ্রাম। সেখানেই দেবীরডাঙ্গা নামক ছোট একটি এলাকাজুড়ে গুটি কয়েক মানুষ ঐতিহ্য ধরে জীবন ও জীবিকার তাগিদে বাঁশ শিল্পকে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। বাড়ির উঠানে কিংবা বাড়ির ওপর দিয়ে চলে যাওয়া মেঠোপথ অথবা বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে বাঁশ দিয়ে নানা পণ্য তৈরি করছেন গ্রামের মানুষ।

বিভিন্ন পণ্য তৈরির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে বাঁশের উপকরণ

একাধিক বাসিন্দা জানালেন, সকাল থেকে শুরু হয় বাঁশ কাটা, চাছা, চাটাই বাঁধা, শুকানো ও বিভিন্ন ধরনের উপকরণ তৈরির কাজ। সংসারের কাজ শেষে নারীরাও বসেন বাঁশের কাজে। সাধ্যমতো সহযোগিতা করে ছেলে-মেয়েরাও। আগে যে বাঁশ ২০ থেকে ৩০ টাকায় পাওয়া যেত সেই বাঁশ বর্তমান বাজারে কিনতে হচ্ছে ২০০ থেকে আড়াই শ টাকায়। কিন্তু পণ্যের মূল্য বাড়েনি।

দা দিয়ে এক বৃদ্ধ কাটছে বাঁশ

এত কিছুর পরও তারা তাদের এই পূর্ব পুরুষদের কুটির শিল্পের পেশা আঁকড়ে ধরেই কম বেশি যা আয়-রোজগার করছেন তার মাধ্যমে পরিবারসহ টিকে আছেন তারা। তাদের অধিকাংশ পরিবারেরই মাঠে আর কোনো চাষযোগ্য জমি নেই। বসতভিটার মাত্র দু-এক কাঠা জমি যেন তাদের শেষসম্বল।

বাড়ির উঠানে বসে কাজ করছিলেন কারিগর বিনোনাদ দাস। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটা হামার বাপ-দাদার পেশা তাই আঁকড়ি ধরি আছি। ছাওয়াগুলা এখন আর এ পেশায় কাজ করবের চায় না। এতে পরিশ্রম বেশি, লাভ এখনা কম।’

বাড়ির উঠানে বসে কাজ করছেন এক কারিগর

কারিগর পলাশ দাস জানান, ‘এই গ্রামের হাতে গোনা কয়েকটি পরিবার আজও এ কাজে নিয়োজিত আছে। একটি বাঁশ থেকে ১০-১২টি ডালি তৈরি হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিটি পণ্য থেকে ১০-২০ টাকা করে লাভ থাকে। তাই এই সীমিত লাভ দিয়ে পরিবার চালান কষ্টের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

নারী কারিগর শিমুল রানী দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘হামার জমিজমা নাই, এই কাজই হামার কৃষি। মৌসুম আসলে কিছু কাজ করি চলা যায়, কিন্তু সারাবছর ধার-দেনা করি চলার লাগে।’

বাঁশের সামগ্রী তৈরিতে কাটা হচ্ছে বাঁশ

মানবী দাস নামের আরেক কারিগর ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ধার-দেনা ও বিভিন্ন সমিতি থেকে বেশি লাভ দিয়ে টাকা নিয়ে কোনোরকমে টিকি আছি হামরা। হামাক যদি সরকারিভাবে অল্প লাভে ঋণ দেওয়া হয় তাহলে এই কাজ করি হামরা বাঁচমো।’

এদিকে বাঁশ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে এবং বাঁশের পণ্য উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে তৃণমূলে কাজ করছে ব্যাম্বু প্রজেক্ট বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রুরাল ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন (ব্রিফ) এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ২০১৮ সাল থেকে।

বিক্রির জন্য বাঁশের পণ্যগুলো নেওয়া হয়েছে বাজারে

ব্রিফের নির্বাহী পরিচালক শাহ আহসান হাবিব জানান, বাঁশের উৎপাদন বৃদ্ধি, চাষিদের প্রশিক্ষণ, বাঁশের পণ্য বাজারজাতকরণ এবং এই পণ্য ব্যবহারে উৎসাহিতকরণের কাজ করা হচ্ছে। বিভিন্ন সভা সেমিনার, মেলায় প্রদর্শনী করা হয় এসব পণ্যের। এই শিল্পের সঙ্গে যারা জড়িত তারা অর্থনৈতিক কারণে পিছিয়ে রয়েছে। এসব মানুষকে ঋণপ্রদানে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিসিক জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক প্রকৌশলী গোলাম রব্বানী জানান, বাঁশ কুটির শিল্পের মধ্যে অর্ন্তগত। এই শিল্পের সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত, যারা প্রত্যক্ষভাবে উপার্জন করে সংসার চালান। অনেকে আমাদের ক্ষুদ্র ঋণ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত। যারা অর্থ সহযোগিতা চান তাদের আমরা ঋণ দিয়ে পাশে থাকি।

শরিফুল ইসলাম/এমএসআর