গোলাম হোসেন বড় ছেলের বিয়ের পরিকল্পনা করে বাড়িতে পালন করা দুটি গরু বিক্রি করেন স্থানীয় গরু ব্যবসায়ী হাসেম আলীর (৪৫) কাছে। গত রোববার (২ জানুয়ারি) দুটি গরু ১ লাখ ২৪ হাজার টাকা দাম ধরে ৪ হাজার টাকা অগ্রিম নেন। বাকি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা গরু বিক্রি করে দেওয়ার শর্তে গরুগুলো হাসেম আলীসহ ৪ ব্যবসায়ী হাটে নিয়ে যান।

পরদিন সোমবার ব্যবসায়ীরা বীরগঞ্জ উপজেলাধীন মরিচা ইউনিয়নের গোলাপগঞ্জ বাজারে দুটি গরু বিক্রি করার জন্য নিয়ে যান। এ সময় বাদী ও স্থানীয়রা তাদের গরুচোর হিসেবে চিহ্নিত করে আটক করে। সেখানে ছুটে যান গরুর মালিক গোলাম হোসেন। খবর পেয়ে পুলিশ এসে গোলাম হোসেনসহ ব্যবসায়ীদের আটক করে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন পুলিশ তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।

অন্যদিকে গত রোববার (২ জানুয়ারি) রাতে দেবীপুর ইউনিয়নের মুজাবনী প্রধানপাড়া গ্রামের মো. আতাবুর রহমান নামের একজনের বাড়ি থেকে ৫টি গরু চুরি হয়। এ ব্যাপারে তিনি সন্দেহভাজন দুজনের নামসহ অজ্ঞাতনামা ১৪ জনের নামে থানায় মামলা করেন। তিনিও স্থানীয় ও আশপাশের বিভিন্ন হাটবাজারে গরুগুলো খুঁজছিলেন। সোমবার ওই হাটে ব্যবসায়ীদের আটকের খবর পেয়ে তিনি সেখানে যান এবং দুটি গরুর মধ্যে একটি গরু নিজের বলে দাবি করেন।

এ ব্যাপারে গোলাম হোসেনের স্ত্রী হালিমা খাতুন বলেন, আমরা অনেক কষ্ট করে দুটি গরু লালন-পালন করি। একটি সাত মাস আগে ও একটি পাঁচ মাস আগে কিনেছিলাম। এলাকার যারা আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করে, তারাও দেখেছে। এত কষ্ট করে গরু লালনপালন করে এখন আমার স্বামীকে চোর হয়ে জেলখানায় থাকতে হচ্ছে। ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্য গরু বিক্রি করতে গিয়ে আজ আমরা চোর হয়ে গেলাম?

গোলাম হোসেনের বড় ছেলে আব্দুল হালিম বলেন, আমার আগামী মাসে বিয়ে ঠিকঠাক হয়েছে। সে জন্য নতুন ঘর তৈরি করার জন্য আমরা গরু দুটি বিক্রি করি। বিক্রি করতে গিয়ে আজ আমার বৃদ্ধ বাবা চুরির অপবাদে জেলখানায় বন্দি।

স্থানীয়রা জানান, সদর উপজেলার শুকানপুকুরী ইউনিয়নের তেওয়ারীগাঁও গ্রামের বাসিন্দা গোলাম হোসেন (৫৫)। নদীভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে ২০১৭ সাল থেকে দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার খাটিয়ামাটির চর থেকে তেওয়ারীগাঁও গ্রামে বসবাস শুরু করেন। তিনি খোলা বিস্কুট কিনে গ্রামে গ্রামে ফেরি করে বিক্রি করে সংসার চালাতেন। অভাবের সংসারে বাড়তি জোগান দিতে গরু লালনপালন শুরু করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, গোলাম হোসেনের বাসা আমার বাড়ির পাশে। আমি তাকে মামা বলে ডাকি। তিনি অনেক সরল মনের মানুষ। আমি দেখেছি তিনি বাড়িতে গরু লালনপালন করেন। তার ছেলের বিয়েতে যৌতুক নেবেন না বলে তিনি গরু বিক্রি করেছেন বিয়ের খরচের জন্য। আজ তিনি নিজের গরু বিক্রি করতে গিয়ে চোর সাব্যস্ত হলেন, এটা কেমন অত্যাচার?

প্রতিবেশী বৃদ্ধ আক্কাস আলী বলেন, আমি লাঠি ছাড়া হাঁটাচলা করতে পারি না। আমার বাড়ির পাশে গোলামের বাড়ি। আমি সেখানে যাই। আমি জানি এগুলো তার নিজের গরু।

প্রতিবেশী শাহ আলম বলেন, আমি নিজেও গরু লালনপালন করি। গোলাম চাচার কাছে মাঝেমধ্যে আসতাম তিনি গরুকে কী কী খাওয়ান দেখতে এবং পরামর্শের জন্য। তার এই দুটি গরু স্থানীয় গড়েয়া বাজার থেকে কেনা, সেটা আমরা জানি।

প্রতিবেশী লাইলি আক্তার বলেন, গোলাম হোসেন ভাইয়ের বউ আমার চাচি হয়। আমিও গরু লালনপালন করি। আমরা একসঙ্গে গরুর জন্য ঘাস কাটি। উনারা দুটি গরু অনেক দিন থেকে লালনপালন করছেন। আমি প্রতিদিন এসে দেখতাম। আজ তিনিই চোর হয়ে গেলেন? এর প্রতিকার চাই।

এদিকে মামলার বাদী আতাবুর রহমান বলেন, গত ২ জানুয়ারি রাতে আমার ৫টি গরু চুরি হয়। তারপর আমি সন্দেহভাজন দুজনের নামসহ অজ্ঞাত ১৪ জনের নামে থানায় মামলা করি। আমি ও আমার আত্মীয়স্বজন মিলে বিভিন্ন বাজারে খোঁজাখুঁজি করি। গত সোমবার বীরগঞ্জের গোলাপগঞ্জ বাজারে বেচাকেনার সময় আমার একটি গরু চিহ্নিত করি। পরে স্থানীয় মেম্বার (ইউপি সদস্য) ও লোকজনের সহায়তায় তাদের আটক করে পুলিশকে ফোন দিই। পরে পুলিশ এসে তাদের থানায় নিয়ে যায়।

শুকানপুকুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান বলেন, গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আমি পুনরায় শুকানপুকুরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছি। আমি নির্বাচন চলাকালীন তার বাসায় গিয়ে দেখি তিনি গরুগুলো লালনপালন করেন। আমি এর আগেও পাঁচ বছর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে থাকাকালে গোলাম হোসেনের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক অভিযোগ পাইনি। তিনি অত্যন্ত সৎ, সরল মানুষ। তিনি কোনো ধরনের খারাপ কাজে সঙ্গে লিপ্ত নন।

ঠাকুরগাঁও সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তানভীরুল ইসলাম বলেন, ২ জানুয়ারি দেবীপুর ইউনিয়নের আতাবুরের বাড়ি থেকে ৫টি গরু চুরি হয়। এ নিয়ে তিনি থানায় অজ্ঞাতনামা ১৪ জনের বিরুদ্ধে এজাহার করলে আমরা নিয়মিত মামলা হিসেবে রেকর্ড করি। এ নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্ত করে। বাদী একপর্যায়ে বীরগঞ্জ উপজেলার গোলাপগঞ্জ বাজারে গরু দেখতে পেয়ে স্থানীয় মেম্বার ও লোকজনের সহায়তায় তার গরু বলে শনাক্ত করেন।

তিনি আরও বলেন, পরে তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে যান। সেখানে গিয়ে আটক গরু ও সন্দেহভাজন লোকদের থানায় নিয়ে আসা হয়। সন্দেহভাজন লোকদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়।

এ মামলায় আদালতে বিবাদীপক্ষে আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত হন অ্যাডভোকেট ইমরান হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমি বিবাদীর আইনজীবী হিসেবে মামলাটি পরিচালনা করছি। গোলাম হোসেনকে মামলায় ১ নম্বর আসামি করা হয়। তবে গরুগুলোর প্রকৃত মালিক হিসেবে দাবি করেন তিনি। দীর্ঘদিন ধরে গরু দুটি লালনপালন করছেন। ছেলের বিয়েতে খরচের কারণে তিনি তার দুটি গরু বাকিতে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন।

তিনি আরও বলেন, বিষয়টি আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আদালত তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গরুর প্রকৃত মালিক যাচাই-বাছাই করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেন। মামলাটির পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ৯ জানুয়ারি।

এনএ