চার বছর আগে দিনমজুরের কাজ করতেন আব্দুল আজিজ বিশ্বাস। সংসারে ছিল অভাব-অনটন। তবে এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে পরিবারটি, অভাব কেঁটেছে। গোবরের ভেতর কেঁচো দিয়ে উৎপাদিত ডার্মি কমপোস্ট (কেঁচো সার) বিক্রি করে প্রতিমাসে ৫০ হাজার টাকা আয় করছেন তিনি। কোনোপ্রকার কীটনাশক ছাড়াই উৎপাদিত এ সার কৃষিতে ফলন বাড়াচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

কৃষি বিভাগ বলছে, বাজারে বিক্রিত কেমিকেল সারের থেকে এর গুণগত মান বেশি। কৃষকরা একবার ব্যবহার করলে আর বাজারের কেমিকেলমিশ্রিত সার ব্যবহার করবেন না। এতে বাজারে বিক্রিত সারের চাহিদা কমে যাবে। সেই সঙ্গে কৃষিতে বিপ্লব ঘটবে।

আব্দুল আজিজ বিশ্বাস (৫৫) সাতক্ষীরা তালা সদরের শিবপুর গ্রামের মৃত মকবুল বিশ্বাসের ছেলে। এই উদ্যোক্তার ভাষ্যমতে, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের কৃষি দিবানিশি অনুষ্ঠানে এমন একটি প্রতিবেদন দেখার পর ঝুঁকে পড়েন কেঁচো সার উৎপাদনের দিকে। এখন বাড়ির আঙিনায় গড়ে তুলেছেন কেঁচো সারের কারখানা।

কেঁচো সার উৎপাদন পদ্ধতি ও খরচ

কেঁচো সার উৎপাদনের প্রক্রিয়া তুলে ধরে উদ্যোক্তা আব্দুল আজিজ বিশ্বাস জানান, এলাকার মধ্যে যাদের বাড়িতে গরু রয়েছে তারা অধিকাংশই গরুর গোবর ফেলে দেয়। আমি সেগুলো তাদের কাছ থেকে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা ২০ টাকায় ক্রয় করি। বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত আরও ২৫ টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর একটি নির্দিষ্ট স্থানে গোবর সংরক্ষণ করি।

সেখান থেকে সার উৎপাদনের জন্য ৩৭টি ছোট ছোট হাউজ ও ৪০টি চাড়ি (সিমেন্টের তৈরি পাত্র) রয়েছে। সেই হাউজ ও চাড়ির মধ্যে গোবর দিয়ে তার ভেতর কেঁচো ছেড়ে দেই। এক মাস পাঁচ দিন পর গোবর পরিণত হয় সারে। কেঁচোগুলো গোবর খেয়ে যে মলত্যাগ করে সেটাই মূলত সার। এরপর চালনের মাধ্যমে কেঁচো ও সার আলাদা করা হয়। সারগুলোতে ছায়াযুক্ত স্থানে ৫-৬ দিন শুকানো হয়। এতে গুণগত মান ভালো থাকে। তারপর বস্তাবন্দি করে বিক্রয় করি।

উৎপাদনে বাড়তি কোনো খরচ নেই জানিয়ে আব্দুল আজিজ বলেন, গোবর ক্রয় করে বাড়িতে নিয়ে আসা পর্যন্ত এটুকুই শুধু খরচ। এছাড়া বাড়তি কোনো খরচ নেই। কারখানার সব কাজ আমি নিজেই করি। প্রতি মাসে কেঁচো সারের উৎপাদন কত? জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, কারখানাটিতে প্রতি মাসে এখন ২২ টন কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে। গোবর লাগে ৪৪ টন। যে পরিমাণ গোবর দেওয়া হয় তার অর্ধেক সার তৈরি হয়।

এলাকাসহ বাইরের কৃষকরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রাখেন। স্যার উৎপাদনের পরই তারা এসে বাড়ি থেকে নিয়ে যায়। প্রতি কেজি সার বিক্রি করি ১০ টাকায়। খরচ বাদে প্রতি কেজিতে ৫ টাকা লাভ হচ্ছে। প্রতি মাসে লাখ টাকারও বেশী সার বিক্রি হয়। এতে খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ৪০-৫০ হাজার টাকা। কৃষকদের মাঝে এই সারের চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। ৭ জানুয়ারি কপিলমুনি এলাকার একজন ঘের ব্যবসায়ী ১০০ বস্তা সার নিয়ে গেছেন। আগে আমার কিছুই ছিল না। পথ দেখিয়েছে কেঁচো। পরিবারের অভাব-অনটন কেঁটে গেছে এখন। 

কৃষি বিভাগের সহায়তা

আব্দুল আজিজ বিশ্বাস জানান, কৃষি বিভাগ কোনো সহায়তা দেয় না। এমনকি গত চার বছরে একটি বারের জন্যও পরিদর্শন করতেও আসেনি। আমি নিজেই যেভাবে পারছি সেভাবেই করছি। কৃষি বিভাগ থেকে সরকারি সহায়তা পেলে সার কারখানাটি আরও বড় পরিসরে করার ইচ্ছা রয়েছে। এতে এলাকার কৃষকরা উপকৃত হবে। 

এখন খামারে কেঁচো ও সারের পরিমাণ

৪ বছর আগে উত্তরবঙ্গের একজনের নিকট থেকে ১২ কেজি বিদেশি কেঁচো ক্রয় করেছিলাম ১১ হাজার টাকায়। এখন খামারে কেঁচো রয়েছে ৩-৪ মণ। যার বাজারমূল্য এক থেকে দেড় লাখ টাকা। কেঁচো বংশবিস্তার করায় এর পরিমাণ এখন বেড়ে গেছে। বর্তমানে স্টকে কোনো সার না থাকলেও কিছুদিনের মধ্যেই ২২ টন সার বাজারজাত করা যাবে। যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে চার লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকা। বিক্রির পর খরচ বাদ দিয়ে অর্ধেক লভ্যাংশ থাকবে।
  
যা বলছেন এলাকার কৃষকরা

তালা সদরের মাঝিয়াড়া গ্রামের কৃষক রিপন মুন্সি জানান, কেঁচো সার ব্যবহারের ফলে জমিতে সবজির উৎপাদন বেড়েছে। বাজার পাওয়া কীটনাশকের সার ব্যবহার থেকে এই সার ব্যবহারে খরচও অনেক কম। সে কারণে এলাকার কৃষকরা জমির উর্বরতা ফিরিয়ে আনা ও ফলন বৃদ্ধির জন্য এই সার ব্যবহার করছেন।

তালার ইসলামকাটি ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের গরু খামারি অরুণ সেন জানান, আমরা বাড়িতে তিনটা গরু রয়েছে। গরুর গোবর আগে ফেলে দিতাম। অনেকে আবার মশাল তৈরির কাজে লাগাতো গোবর। তবে সেই গোবর প্রক্রিয়াজাত করে এখন সার তৈরি হচ্ছে। উৎপাদিত সারের চাহিদাও রয়েছে অনেক। এতে একদিকে গরুর গোবর বিক্রি করে খামারিদের বাড়তি কিছু আয় হচ্ছে আবার সেটিকে প্রক্রিয়াজাত করে সার বিক্রির মাধ্যমে তারাও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।

যা বলছে কৃষি বিভাগ

সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে প্রাপ্ততথ্যে জানা গেছে, জেলায় বর্তমানে কেঁচো সার উৎপাদন কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন ৯৭৮ জন চাষি। চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪৪৫ টন। যার বাজারমূল্য ২ কোটি ১৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। এখন জেলায় প্রতি মাসে কেঁচো সার উৎপাদন হচ্ছে ১৯৫ মেট্রিক টন। রবি মৌসুমে ৫৯৮ হেক্টর সবজি ফসলে এই সার ব্যবহার হয়েছে। 
 
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক নুরুল ইসলাম জানান, কেঁচোকে বলা হয় প্রকৃতির লাঙল। কেঁচো থেকে উৎপাদিত সারের উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। প্রথমত এটি পরিবেশবান্ধব। এছাড়া মাটি থেকে গাছ যে ১৭টি খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে তার ৮-১০টি উপাদান রয়েছে এই সারে। জমিতে অতিরিক্ত মাত্রায় দিলেও কোনো ক্ষতিকর প্রভাব নেই।

তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগ থেকে এদের প্রদর্শনী সহায়তা দেওয়া হয়। কৃষকদেরও এই সার ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়ে থাকে। কৃষকরা যদি এই সার ব্যবহার করে তবে আগামীতে অন্য সার আর ব্যবহার করবে না। কৃষি ক্ষেত্রে কেমিকেলমিশ্রিত বাজারে বিক্রিত সারের চাহিদা কমে যাবে সেই সঙ্গে কৃষিতে একটি বিপ্লব ঘটবে।

এমএসআর