‘চিকিৎসা নগরী’ হিসেবে ফরিদপুরকে বলা হলেও এখানকার চিকিৎসাব্যবস্থা অনেকটা ওপরে চাকচিক্য আর ভেতরটা ফাঁপা। জেলার অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা মোটামুটি মিললেও একমাত্র বক্ষব্যাধী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের অবস্থা বেহাল। হাসপাতালের পুরোনো ইমারত, নিরাপত্তার অভাব, জনবল-সংকট, অরক্ষিত সীমানাপ্রাচীর, নষ্ট জেনারেটর নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালটি। সেবার মান নিয়ে আক্ষেপ রয়েছে খোদ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদেরও।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর শহরতলির ভাজনডাঙ্গা এলাকায় অবস্থিত ফরিদপুর বক্ষব্যাধী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ১৯৬১ সালে আট একর জমির ওপর কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে একটি পুকুরসহ পাঁচ একর জমির ওপর স্থাপিত বক্ষব্যাধি হাসপাতাল। পাশে তিন একর জমির ওপর রয়েছে বক্ষব্যাধী ক্লিনিক। আর চারদিক সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই হাসপাতালের সীমানাপ্রাচীরের দেওয়াল কলামের ওপর স্থাপিত হওয়ায় দেওয়ালের মাঝেমধ্যে ফাঁক-ফোকর রয়েছে। এসব ফাঁক-ফোকর ও হাসপাতালের মূল ফটক দিয়ে অবাধে হাসপাতাল প্রবেশ করছে লোকজন। পুকুরে গোসল করা, কাপড় ধোয়া, ধোয়া কাপড় হাসপাতাল চত্বরে দড়ি টানিয়ে শুকাতে দেওয়াসহ যাবতীয় কাজ করতে দেখা যায় এখানে। হাসপাতালের সামনে একটি পিলারে রংচটা-বিবর্ণ জাতীয় পতাকা টাঙানো দেখে সহজেই অনুমান করা যায় হাসপাতালটির বর্তমান অবস্থা।

হাসপাতালে বর্তমানে ১৩ জন রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানান ওই হাসপাতালে কর্মরত নার্স শায়লা শাওন। কিন্তু নারী ও পুরুষ দুটি ওয়ার্ড ঘুরে দুজন পুরুষ ও চারজন নারীসহ মোট ছয়জন রোগী উপস্থিত থাকতে দেখা যায়। এর মধ্যে দুজন রোগীর যক্ষ্মারোগ রয়েছে, বাকি চারজনের রয়েছে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা।

রোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কোনো রোগীই রাতে হাসপাতালে অবস্থান করে না। তারা সকাল আটটা সাড়ে আটটার মধ্যে হাসপাতালে আসে এবং বেলা আড়াইটা-তিনটার মধ্যে বাড়ি চলে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যে ছয় রোগী রয়েছে, তাদের সবার বাসা ওই হাসপাতালের আশপাশের এলাকায়।

পুরুষ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শহরউদ্দিন খান (৮৭) শহরের টেপাখোলা মহল্লার বাসিন্দা মৃত আসিরউদ্দিনের ছেলে। তিনি জানান, তিন মাস ধরে তিনি এ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তিনি বলেন, এ হাসপাতালে ভর্তি থাকলে তিন বেলা খাবার পাই, তাই ভর্তি আছি। তা ছাড়া তেমন কোনো আহামরি সেবা নেই।

পুরুষ ওয়ার্ডের অপর রোগী জানে আলম (৬৫) ওই এলাকার ব্যাপারিপাড়ার বাসিন্দা। তিনি জানান, তিন মাস ধরে এ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তার যক্ষ্মা নেই। তিনি শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালে কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায় না। নামে সরকারি, কাজে বেসরকারিনির্ভর।

মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন শহরের টেপাখোলা মহল্লার বাসিন্দা ছকদুল বেপারীর স্ত্রী মলিনা বোপারি (৫০)। তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত। তিনি দুই মাস ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি বলেন, পরীক্ষা করাতে গেলেই বলে মেশিন নষ্ট। নিরুপায় হয়ে আমরা এখানে আসি।

চিকিৎসাধীন উত্তর টেপাখোলা মহল্লার বাসিন্দা রিকশাচালক দেলোয়ার বেপারীর স্ত্রী হালিমা বেগম (২৯) বলেন, তিনি যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত হয়ে তিন মাস ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি বলেন, রাতে নিরাপত্তার সমস্যার কারণে তারা কেউ হাসপাতালে থাকেন না, যে যার বাড়িতে চলে যান।

রোগীরা জানান, সকালে এসে তারা সকালের নাশতা খান। দুপুরের খাবার খেয়ে, রাতের খাবার নিয়ে বাড়ি চলে যান। ওই হাসপাতালে রান্নার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছেন বাবুর্চি হিরা খান (৩৬)। তিনি জানান, তিনি আটজনের জন্য রান্না করেন। সকালে কলা-পাউরুটি ও ডিম দেওয়া হয়। দুপুর ও রাতে ভাত ও তরকারি দেওয়া হয়। যেদিন মাছ করা হয়, সেদিন রোগীপ্রতি ১৫০ গ্রাম মাছ এবং যেদিন মাংস রান্না হয়, সেদিন রোগীপ্রতি ৫৬ গ্রাম মাংস দেওয়া হয়।

হাসপাতালে নার্স নীরু শামসুন্নাহার বলেন, সকাল আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত তাদের হাসপাতালে ডিউটি করতে হয়। গত বছর (২০২১) এ হাসপাতালে মোট ৫২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বক্ষব্যাধি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে রয়েছে জনবলের সংকট। ক্লিনিকে জুনিয়র কনসালট্যান্ট থেকে শুরু করে আয়া পর্যন্ত মোট পদ আছে ১৭টি। এর মধ্যে জুনিয়র কনসালট্যান্ট, মেডিকেল অফিসারসহ ১৫টি পদ ফাঁকা রয়েছে।

অপরদিকে, বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার ফার্মাসিস্টসহ পদ রয়েছে ১৯টি। এর বিপরীতে কর্মরত আছেন ১৭ জন। এর মধ্যে তিনজন ওয়ার্ড বয় ও দুজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জেনারেল হাসপাতাল ও সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে ডেপুটেশনে রয়েছেন। এ ছাড়া আটজন স্টাফ নার্সের মধ্যে চারজন বর্তমানে করোনার টিকা দেওয়ার কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে তাদের এ হাসপাতালে কাজ করার সুযোগ নেই।

ফরিদপুর বক্ষব্যাধি হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার মেরিনা পারভীন বলেন, লোকবল একটা বড় সমস্যা। পাশাপাশি ডেপুটেশনে থাকায় এ সমস্যা আরও জোরালো হচ্ছে। এলাকাবাসীদের আচরণগত সমস্যা আছে। রোগীরা রাতে থাকেন না নিরাপত্তার অভাবের কারণে। সীমানাপ্রাচীর ঠিক করে দেওয়ার জন্য বহুবার কর্তৃপক্ষের কাছে লেখা হয়েছে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয় না।

তিনি বলেন, এ হাসপাতালের অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে আছে। জেনারেটর বহুদিন ধরে নষ্ট। সম্প্রতি একটি এক্স-রে মেশিন দেওয়ায় কাজ করা যাচ্ছে। কফ পরীক্ষা করা হয়। সাত বছর ধরে যা বন্ধ ছিল। যক্ষ্মারোগীদের আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা নিয়মিত করা প্রয়োজন। বিশেষত রক্তের সব ধরনের পরীক্ষা (সিবিসি) করার প্রয়োজনীয়তা বেশি। এখানে করা সম্ভব নয় বলে রোগীদের বাইরে থেকে করাতে হয়। মেশিন না থাকাসহ নানা প্রতিকূলতা চলছে এখানে।

ফরিদপুরের সিভিল সার্জন মো. ছিদ্দীকুর রহমান বলেন, যক্ষ্মা হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সমস্যার ব্যাপারে আমরা অবগত আছি। এর সমাধানে এবং জনবল সংকট কাটানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এনএ