দেশের উত্তরের জনপদ পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার গ্রামাঞ্চলে সকাল হলেই একটি বাইসাইকেলের সামনে রকমারি বই ও গাছ নিয়ে ছুটতে দেখা যায় তরুণ মাহামুদুল ইসলাম মামুনকে। প্রতিদিন সকাল হলে মামুন বেরিয়ে পড়েন বই ও গাছ নিয়ে। তেঁতুলিয়ার গ্রামে গ্রামে এখনো শীতের কুয়াশার ভোরেও তাকে দেখা যায় সাইকেলে সেট করা বইয়ের ঝুড়ি, গাছের চারার ব্যাগ নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরতে। 

সঙ্গে প্লাস্টিক ও পলিথিন প্ল্যাকার্ড। ঘুরে ঘুরে কোথাওবা আগে পড়তে দেওয়া বই বদলে দিচ্ছেন, বই পড়ার জন্য গাছের চারা পুরস্কার দিচ্ছেন। কোথাওবা বসিয়ে ফেলছেন বই পাঠের আসর। আসরে যেমন সাহিত্যবই, বিজ্ঞানচিন্তা, ধর্নীয়বই পাঠ করছেন তেমন শিশুকিশোরদের স্কুলের পড়াশোনার খোঁজখবরও নিচ্ছেন।

পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলোতে এভাবেই বিনামূল্যে পড়িয়ে ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করে তুলছেন বছরের পর বছর একই গতিতে।সাইকেল চালিয়ে ঘুরে ঘুরে গ্রামে গ্রামে বই বদলে দিয়ে দিয়ে পড়ান মামুন; শুধু তাই নয় বই পাঠের আসরও বসান। আর প্রতিদিন গাছের চারা পুরস্কার হিসেবে শিশু-কিশোরদের হাতে তুলে দেন।

জানা গেছে, মাহমুদুল ইসলাম মামুন উপজেলার সদর ইউনিয়নের আজিজনগর এলাকার মৃত আজহারুল ইসলাম ও মাহমুদা বেগম দম্পতির দ্বিতীয় ছেলে। মামুন রংপুর কারমাইকেল কলেজে বাংলায় স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করেছেন। মামুন শৈশব থেকেই গাছ লাগানোর মধ্যদিয়ে তার এই কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। কালক্রমে যোগ হয়েছে নানা ধরনের সামাজিক কাজ।

মহামারি করোনাকালেও থেমে থাকেনি এই পরিবেশবন্ধু ও শিক্ষাকর্মীর কাজ। দূরত্ব বজায় রেখে বইয়ের আসর বসান, আসরে তিনি নিয়মিত সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, ইমিউনিটি বাড়াতে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ দেশীয় ফল খাওয়া, প্রোটিন, শাকসবজি, পর্যাপ্ত পানি পান এসব বিষয়ে তদারকি করেন।

এলাকার শিশুকিশোররা মন্ত্রমুগ্ধের মতো মামুনের কথা ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও শোনেন। এ যেন বিনে পয়সার শিক্ষক। মামুন  স্থানীয় অনেক ছাত্র-ছাত্রীদের বাড়িতে নিয়ে এসে বিনা পয়সায় প্রাইভেটে পড়ান। প্রতিদিন গাছ বিতরণ ও বই পড়ানোর পাশাপাশি নানা কিছু শেখান শিশুদের। চলতে ফিরতেই মামুন শিশু-কিশোর থেকে সব বয়সী মানুষের গাছ ও বইয়ের আবদার মেটান।
 
শুধু তাই নয়, সাড়া জাগানো এই তরুণকে প্রতিদিন বাজারে উচ্ছিষ্টাংশ সংগ্রহ করেও রিসাইকেল করতে দেখা যায়। এতে বাজার যেমন আর্বজনা ও দুগর্ন্ধমুক্ত হয়েছে তেমনি বাজারের উচ্ছ্বিটাংশ আগে দোকানদার দেশের একমাত্র ক্ষুদ্রতম নদী গবরায় ফেলানোর কারণে গোবরা নদী যে দূষণ হয়েছিল তা মামুন এমন ভিন্নধর্মী উদ্যােগে আজ নদী দূষণমুক্ত হয়েছে।

জানা যায়, মামুনের এসব ভিন্নধর্মী উদ্যােগ বাস্তবায়ন করতে তিনি কারও কাছে সহযোগিতা নেন না। মামুন তার বাড়িতে নিজে হাঁস, মুরগি, কবুতর পালনসহ, সবজি চাষ করে গ্রামে বা বাজারে বিক্রি করে যে সামান্য অর্থ পান, তা দিয়েই তিনি গাছের চারা ও বই কেনার পাশাপাশি অন্য সামাজিক কার্যকর্ম পরিচালনা করছেন ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে।

এ বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী রুপা আক্তারের সাথে। সে জানায়, মামুন আংকেল আমাদের বই দেয়। বইয়ের আসর বসিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দান করায়। আমাদের ফলের গাছ উপহার দেয়। সেই গাছ রোপণ করি আমরা। মামুন আংকেল আমাদের যে বই দেয় সেই বই পড়া শেষ হলে তিনি বাসায় এসে ফেরত নিয়ে আবার নতুন বই দেন। এতে আমি অনেক কিছু শিখতে পারি।

একই কথা বলেন সজল হোসেন নামে আরেক শিক্ষার্থী। সে জানায়, ‘মামুন চাচ্চু আমাদের খাবার আগে সাবান দিয়ে হাত ধুতে বলে, পরিষ্কার-পরিছন্ন থাকতে বলে। সবময় ফলমূল খেতে বলে। পাশাপাশি আমাদের ভালো করে লেখাপড়া করতে বলে। মামুন চাচ্চু আমাকে বিনা পয়সায় তার বাড়িতে প্রাইভেট পড়ায়। আমি এবার এসএসসি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করেছি। তিনি কয়েকদিন পর পর গাছ ও বই উপহার দেয় এতে আমাকে অনেক ভালো লাগে।’

এদিকে ছোট ছোট শিশুদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ায় অবিভাবকের কাছে বেশ জনপ্রিয় এই তরুণ। তার বিষয়ে কথা হয় স্থানীয় কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে। তারা বলেন, বর্তমান যুগে কেউ কারো না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে মামুনের মতো একজন মানুষ শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাইজে সে যেভাবে বিনাপয়সায় বই ও গাছ উপহার দিচ্ছে, বিনাপয়সায় লেখাপড়া পড়াচ্ছে, সামাজিক কাজ করছে এটা অনেক প্রশংসনীয় উদ্যােগ। 

এ বিষয়ে কথা তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের আজিজনগর এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, মামুন আমার এলাকার ছোট ভাই। সে মানুষের উপকার ও পরিবেশ দূষণরোধে যে কাজ করছে এটা প্রশংসনীয় কাজ। সে এলাকার গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই ও গাছ দেওয়ার পাশাপাশি লেখাপড়া শেখাচ্ছে। অনেকেই তার কাছে পড়ে ভালো ফলাফল করছে।

মামুনের বিভিন্ন সামাজিক উদ্যােগের মধ্যে সবচেয়ে নজর কেড়েছে মাছ বাজারের উচ্ছ্বিটাংশ নিজ হাতে অপসারণ ও পরিবেশ দূষণ রোধে প্লাস্টিক জড়ানোর পর তা পুড়ে ফেলানোর উদ্যাগে। তার এমন উদ্যােগে তেঁতুলিয়ায় পরিবেশ ও নদীদূষণ অনেকটাই রোধ হয়েছে বলে দাবি স্থানীয়দের।

তেঁতুলিয়া চৌরাস্তাবাজারের মাছ দোকানি উমর আলী তিনি বলেন, আগে মাছের নাড়ি-ভুঁড়ি নদীতে ফেলতাম। এতে নদী দূষণ হতো। আমাদের ভুল কাজ দেখে মামুন নিজ হাতে প্রতিদিন বাজারে এসে একটি বালটিতে করে এসব নিয়ে গিয়ে মানুষের হাঁস-মুরগিকে দেন। শুধু তাই এ থেকে জৈবসার তৈরি করে গাছের গোড়ায় দেন মামুন।

মামুনের মা মাহমুদা বেগম বলেন, আমার ছোট ছেলে মামুন শৈশব থেকেই পরিবেশপ্রেমী ছিল। পরে ধীরে সে বিনামূল্যে বই ও গাছ বিতরণ করতে শুরু করে। এখন আমার ছেলে প্রতিদিন গাছ লাগানোসহ এক হাতে দশ রকম দেশসেবা করে চলছে। সে কখনও কারও কাছে টাকাপয়সা চায়নি। এতো কাজ করে সবার মতো কোনো চাকরিও নিতে পারেনি। রাষ্ট্র যদি আমার ছেলের একটু খোঁজ নিত তবে মা হিসেবে শান্তি পেতাম।

পরিবেশপ্রেমিক তরুণ মাহামুদুল ইসলাম মামুন বলেন, আমার সব কাজ ইবাদতের মতো। আমি টাকা চাই না, আমি চাই আমার কাজকে মানুষ, রাষ্ট্র সম্মান করুক। কষ্ট করে কাজ করা আমার সয়ে গেছে। দুর্যোগে জরাগ্রস্ত পৃথিবীর জন্য এসব কাজ এখন জরুরি। তাই এখন এসব কাজকে আমি ইবাদত মনে করি।

তিনি আরও বলেন, বলতে গেলে দুই যুগের বেশি সময় ধরে গাছ লাগাচ্ছি। এখনো প্রতিদিন গাছ লাগানো, নদী দূষণরোধে বাজারের উচ্ছ্বিটাংশ রিসাইকেল করা, পলিথিন প্রতিরোধ, গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বই পড়ানোসহ নানাবিধ দেশসেবা চালিয়ে যাচ্ছি। ইবাদতের মতো! এসব কাজে থেকে নিজের জন্য চাকরিও জোটাতে পারিনি! দিনরাত নামাজ কালামের মতো পরিবেশকর্ম ও পড়ানোও আমার ইবাদত, আল্লাহ ভরসা!

তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি এরশাদ হোসেন সরকার বলেন, মামুন ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা ও পরিবেশ দূষণরোধে কাজ করছে। সে প্রতিদিন কোনো-না-কোনো পাড়া-মহল্লায় গিয়ে জ্ঞানের আসর বসিয়ে শিশুকিশোরদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের গল্প ও বিভিন্ন বিষয়ে পাঠ দান করাচ্ছে। মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বই ও গাছ বিতরণ করছে দীর্ঘদিন ধরে। পাশাপাশি সে পরিবেশ ও নদী দূষণরোধে বিভিন্ন সামাজিক উদ্যােগ নিয়েছে যা সমাজের জন্য অনেক মঙ্গলজনক।

তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, মামুন নামে ওই তরুণ বিনামূল্যে বই ও গাছ বিতরণের  পাশাপাশি পরিবেশ দূষণরোধে যে কাজ করছে আসলেই একটি প্রশংসনীয় উদ্যােগ। মামুন যদি তার সামাজিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে কোনোপ্রকার সহযোগিতা চায় সেক্ষেত্রে তেঁতুলিয়া উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে সহযোগিতা করা হবে।

এমএসআর