প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে সুগন্ধি জাতের ধান চাষ করে আসছে এদেশের কৃষকরা। এসব ধান থেকে প্রাপ্ত সুগন্ধি চালের কদর সবার কাছেই। বিয়ে-শাদী, অতিথি আপ্যায়ন কিংবা বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে সুগন্ধি চাল ছাড়া চলেই না। কিন্ত খুব বেশি পরিমাণ সুগন্ধি ধানের জাত আমাদের দেশে নেই।

একসময় এসব জাতের ধান চাষ হলেও বর্তমানে চাষ একেবারেই কমে গেছে। জাত সংরক্ষণ বা ফলন কম হওয়া এসব জাত হারিয়ে যাবার অন্যতম কারণ বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে দেশের কৃষি থেকে অনেকটাই হারাতে বসেছে ধানের এ জাতগুলো।

অন্যদিকে, সুগন্ধি চালের চাহিদা মিটাতে প্রতিবছর বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আমদানি করতে হয়। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশেই কীভাবে অধিক ফলনশীল সুগন্ধি ধান আবাদ করা যায় -এ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে আসছিলেন দেশের ধান বিজ্ঞানীরা। 

আর এ গবেষণায় তারা সফলও হয়েছেন। এখন শুধু পুরনো জাত থেকেই নয়, সাধারণ জাতের ধান থেকেও পাওয়া যাবে সুগন্ধি চাল। আর এটা সম্ভব হয়েছে ক্রিসপার কাস-৯ নামক একটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে ধানের জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে। 

বৈজ্ঞানিক এ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন জার্মানির ইমান্যুয়েল শাপেন্টিয়ের ও যুক্তরাষ্ট্রের জেনিফার ডোউডনা। এ কারণে ২০২০ সালে রসায়নে তারা নোবেল পুরস্কারও লাভ করেন। সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ২-৩ বছরের মধ্যে যে কোনো ফসলের কাঙ্খিত গুণাগুণ (সুগন্ধি, রোগ ও পোকাপ্রতিরোধী) যোগ করে ট্রান্সজিনমুক্ত জাত উদ্ভাবন করা যায়। এ কাজটি করতে সফল হয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও কীটতত্ত্ববিদ ড. পান্না আলী জানান, এটি ফসলের জিন পরিবর্তন করার একটি আধুনিক প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের কাঙ্খিত গুণাগুণ যোগ করে নতুন জাত উদ্ভাবন করা যায়। 

তিনি বলেন, পরীক্ষা করে দেখা গেছে ধানে BADH2 জিন সক্রিয় থাকলে ২-এসিটাইল-১-পাইরোলিন (2AP) উৎপাদন ব্যাহত করে সুগন্ধি তৈরিতে বাধাগ্রস্ত করে। সব ধানেই সুগন্ধি বৈশিষ্ট্য রয়েছে কিন্তু BADH2 জিন থাকার কারণে সুগন্ধি বৈশিষ্ট্য প্রকাশ হতে পারে না।

ড. পান্না আলী জানান, ক্রিসপার ক্যাস-৯ পদ্ধতিতে  BADH2 জিনটি নিষ্ক্রিয় করে অধিক ফলনশীল যেকোনো ধানের যাতে সুগন্ধি বৈশিষ্ট তৈরি করা যায়। একই পদ্ধতিতে ধান গাছে সেরোটোনিন উৎপাদন ব্যাহত করে ধানের প্রধান অনিষ্টকারী পোকা বাদামি ঘাসফড়িং ও মাজরা পোকা প্রতিরোধী ধানের জাত উৎপন্ন করা যায়। ফলে একদিকে সুগন্ধি জাত, অন্যদিকে একই পদ্ধতিতে প্রাকৃতিকভাবে পোকা প্রতিরোধ করা সম্ভব।

কীটতত্ত্ববিদ ড. পান্না আলী বলেন, সভ্যতার শুরুতে বন থেকে সংগ্রহ করা বীজ কৃষকের মাঠে চাষাবাদের মাধ্যমে কৃষির সূচনা হয়। বিজ্ঞানীরা ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য এতদিন নির্ভরশীল ছিলেন ইনট্রুডাকশন, ক্রসিং ও সিলেকশন, হাইব্রিডাইজেশন, মিউটেশন ইত্যাদি পদ্ধতির ওপর। হাল আমলে ফসলের জাত উদ্ভাবনে জিএমও (জ্যানেটিকাল মডিফাইড ক্রপস) প্রযুক্তি আসলেও, জিএমও ফসল নিয়ে সারা বিশ্বে চলছে পক্ষ-বিপক্ষ মতামত। কিন্তু ক্রিসপার কাস-৯ মূলত ফসলের জিন পরিবর্তন করার একটি আধুনিক বিতর্কমুক্ত একটি প্রযুক্তি।

সম্প্রতি কীটতত্ত্ববিদ ড. পান্না আলীর নেতৃত্বে ব্রি’র একদল গবেষক ২০২০সালের জুনে ক্রিসপার কাস-৯ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুগন্ধি ও পোকা প্রতিরোধী ধানের ৩০টি গাছ পেয়েছেন। তারা আমন মৌসুমের ব্রি ধান ৮৭, এবং বোরো মৌসুমের ব্রি ধান ৮৯ ও ব্রি ধান ৯২ জাতে ক্রিসপার কাস-৯ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সুগন্ধি জিন ঢুকিয়েছেন। একই পদ্ধতিতে ওইসব গাছে সেরোটোনিন উৎপাদন ব্যহত করতে ওই জিন ঢুকিয়ে সফল হয়েছেন। সেরোটিন উৎপাদন ব্যহত হলে ধানের প্রধান অনিষ্টকারী পোকা বাদামি ঘাসফড়িং ও মাজরা পোকা প্রতিরোধী গুণ তৈরি হয়। 

সম্প্রতি গাছগুলো ফলন দিয়েছে। বর্তমানে ধানের শীষগুলো পাঁকতেও শুরু করেছে। ব্রি’র মহাপরিচালক মো. শাহজাহান কবির সহকর্মীদের নিয়ে ক্রিসপার কাস-৯ পদ্ধতি ব্যবহার করে উদ্ভাবিত ওই ধান গাছ পরিদর্শন করেছেন।

ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির জানান, ধান চাষে চারটি বিষয়কে টার্গেট করে আমরা এ পদ্ধতি প্রয়োগ শুরু করেছি। বিষয়গুলো হলো ব্লাস্ট রোগের জীবাণু ও বাদামি ঘাস ফড়িং আক্রমণ সহায়ক জিন নক আউট করা, সাধারণ ধানে সুগন্ধি গুণ ঢুকানো ও থার্মোসেনসিটিভিটি নিয়ন্ত্রণ করা।

তিনি আরো বলেন, বাজারে সুগন্ধি চালের দাম বেশি। গরিব অনেক মানুষ তা ক্রয় করতে পারে না। দেশে প্রচলিত সুগন্ধি জাতের ফলনও কম। কৃষকরা মাজরা ও কারেন্ট পোকার (বাদামি গাছ ফড়িং) এর কারণে প্রায় ১০-১৮ ভাগ ফলন হারান। এসব পোকা দমনের জন্য কৃষকরা প্রচুর পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার করেন। যা পরিবেশ ও মানব স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর। এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে আমরা এক ধাপ এগিয়ে যাব।

এমএএস