টেকনাফের শালবন, টইঙ্গার পাহাড়, মিজ্জিরপাহাড়, পানেরছড়াসহ বিশাল এই পাহাড়ি এলাকা দিন দিন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে পরণিত হচ্ছে বলে জানায় স্থানীয়রা। বেশ কয়েকটি ডাকাত বাহিনীর হাতে জিম্মি এই পাহাড় থেকে অপহরণের শিকার হয়ে সহজে কেউ জীবিত ফেরে না। তাই তারা এই পাহাড়ের নাম দিয়েছেন ‘খুনের পাহাড়’।

স্থানীয়দের দাবি, এই পাহাড়ে মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, বাজার নিয়ন্ত্রণ, অপহরণ করে মুক্তিপণসহ নানা অপরাধে নেতৃত্ব দিতেই সৃষ্টি হচ্ছে একের পর এক এসব সন্ত্রাসী সংগঠন। ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় দিনে দিনে বাড়ছে অস্ত্রের ঝনঝনানি, আধিপত্য নিয়ে হচ্ছে সংঘাত। প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর সংঘর্ষে এ পর্যন্ত অগণিত মানুষের প্রাণ গেছে।

জানা যায়, ২০২১ সালের ২৯ এপ্রিল টেকনাফের মিনাবাজার এলাকার স্থানীয় যুবক আকতার উল্লাহকে (২১) ধানক্ষেত থেকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে মুক্তিপণ হিসেবে ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিল। ধারদেনা করে তার বাবা মৌলভি আবুল কাশেম ১ লাখ টাকা পৌঁছেছিলেন। কিন্তু তবু ছেলের খোঁজ পাননি তিনি। তিন দিন পর উনছিপ্রাং ২২ নং ক্যাম্প থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় আকতারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শেষে তার মরদেহ শনাক্ত করেছে তার পরিবার।

নিহত আকতারের বাবা মৌলভি আবুল কাশেম ঢাকা পোস্টকে জানান, হাতি পাহারা দেওয়ার নাম করে তার ছেলেকে কৌশলে নিয়ে যায়। এক দিন পর অপহরণকারীদের ফোন আসে মুক্তিপণ দেওয়ার জন্য। কিন্তু সঠিক সময়ে মুক্তিপণ দিতে না পারায় তার ছেলেকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় কয়েজন চিহ্নিত হলেও তাদের এখনো পুলিশ আটক করেনি বলে অভিযোগ করেন তিনি।

পুলিশ মরদেহ উদ্ধারের ঘটনার সূত্র ধরে এগোলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপহরণ, চাঁদাবাজি, নারীর ওপর নিপীড়নসহ নানা অপরাধে জড়িত একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপের তথ্য সামনে আসে। এই গ্রুপের মূল হোতা মো. হাকিম ডাকাত মাস্টার গ্রুপের সদস্য।

পুলিশের ধারণা, তারা বর্তমানে মিয়ানমারে অবস্থান করছে। জনপ্রিয় রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার পর থেকে ক্যাম্প ছাড়ে তারা। ‘আরসা’ পরিচয়ে কক্সবাজারের ক্যাম্পে ইসলাম ও মাস্টার গ্রুপের হয়ে কাজ করে এমন ২০ থেকে ২৫ জন রয়েছে। তবে তারা সত্যিই আরসার সদস্য কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

অপহৃত হয়ে শালবন, টইঙ্গারপাহাড় ও মিজ্জিরছড়া পাহাড়ে খুনের শিকার হয়েছে, এমন কয়েকটি পরিবারের সন্ধানে নামে ঢাকা পোস্ট। জানা যায়, হোয়াইক্যংয়ের ঝিমনখালী মিনাবাজার এলাকার দুই যুবক ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে রাতে পাহাড়ের পাদদেশে ফসল পাহারা দিতে গিয়ে অপহরণের শিকার হন। পরে তিন দফায় মুক্তিপণ চেয়ে ব্যর্থ হওয়ায় মেরে ফেলা হয় তাদের। ওই সময় তাদের বনের ভেতর দেখে ফেলায় খুন করা হয়েছিল পুটিবনিয়া এলাকার এক চাষিকে।

গত বছরের জুলাইয়ে অপহরণের শিকার হন টেকনাফের শামলাপুর এলাকার সিএনজি অটোরিকশাচালক মাহমুদুল করিম। বাড়ি ফেরার পথে শামলাপুর-হোয়াইক্যং সড়ক থেকে তাকে নিয়ে যান অপহরণকারীরা। মুক্তিপণ হিসেবে অপহরণকারীরা তার পরিবারের কাছে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার পর অপহরণকারীরা যে নম্বর থেকে ফোন করেছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। অপহরণের এক মাস পর গত আগস্টে বন বিভাগের লোকজন জঙ্গল পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি কঙ্কাল খুঁজে পান। কঙ্কালের পরনের পোশাক দেখে মাহমুদুল করিমকে শনাক্ত করেন তার পরিবারের সদস্যরা।

মাহমুদুল করিমের বড় ভাই নুরুল করিম জানান, তার ভাইয়ের খুনের ঘটনায় জালাল উদ্দিন ও ইয়াছিন ওরফে নাসির আহমেদ নামের দুই রোহিঙ্গা দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এখন পর্যন্ত পুলিশ সাতজনকে আটক করেছে। তারা প্রত্যেকেই রোহিঙ্গা নাগরিক।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সিএনজি অটোরিকশার লাইনম্যান হওয়াকে কেন্দ্র করে তার ভাইকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দিয়ে অপহরণ করে খুন করা হয়েছে। কিন্তু ঘটনার মাস্টারমাইন্ডরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। তারা আদালতে ওই সব সন্দেহভাজন মাস্টারমাইন্ডকে অন্তর্ভুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু পুলিশের রহস্যজনক ভূমিকায় নেপথ্যের অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং উনছিপ্রাং ২২ নং ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর (ছদ্মনাম) জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রসীরা ক্যাম্পে আটকে রাখার জন্য কাঁটাতারের বেড়া দিলেও সেগুলো কেটে পথ করেছে তারা। এসব পথ দিয়ে বেরিয়ে বিভিন্ন অপরাধকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। ফলে রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে থাকতে হয়। কারণ যেকোনো সময় অপহরণের ভয় থাকে।

স্থানীয়রা আরও জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা মিজ্জিরছড়া পাহাড়ে আটকে রাখে। কারণ, এই পাহাড়ের সঙ্গে টেকনাফের সব পাহাড়ের সংযোগ রয়েছে। তাই এটি সন্ত্রাসীদের জন্য নিরাপদ।

রইক্ষ্যং এলাকার স্থানীয় যুবক ইমন জানান, কিছুদিন আগে গরু নিয়ে পানেরছড়া পাহাড়ে গেলে সেখানে মানুষের দুটি কঙ্কাল দেখতে পান তারা। সেই কঙ্কাল এখনো রয়েছে। এই ক্যাম্পের আশপাশে এ রকম অসংখ্য কঙ্কাল পাওয়া যাবে।

টেকনাফ উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা ফরহাদ মাহমুদ জানান, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন গ্রুপ দিন দিন বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। তারা পাহাড়ের গহিন জঙ্গলে মানুষকে অপহরণ করে নিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ দিতে না পারলে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের এই হিংস্র কর্মকাণ্ডে আমাদেরও আতঙ্কে থাকতে হয়। তাদের তাণ্ডবে স্থানীয় জনগোষ্ঠী আজ খুবই অসহায়।

স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহ আলম জানান, উনছিপ্রাং ক্যাম্পের পেছনে গত বছর দুজনকে অপহরণ করে হত্যা করে। রোহিঙ্গা সন্ত্রসীদের কাছে স্থানীয়রা এখন নিরাপদ নয়।

গত শনিবার (৮ জানুয়ারি) স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় মিজ্জিরছড়া পাহাড়ের কাছে যাই আমরা। পাহাড়টি হোয়াইক্যং উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অন্তত ১০ কিলোমিটার দূরের গহিন অরণ্যে। সেখানে পৌঁছাতে বেশ কয়েকটি পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। সেখানে দেখা হয় দুই কৃষকের সঙ্গে। তারা জানান, প্রাণ হাতে নিয়ে তারা পাহাড়ের পাদদেশে চাষ করতে যান। কারণ, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা যেকোনো সময় অপহরণ করে নিয়ে যেতে পারে, এ ভয় তাড়া করে তাদের সব সময়।

পরদিন রোববার হোয়াইক্যংয়ের উনচিপ্রাং অবস্থানকালীন আমাদের কাছে একদল রাখাল পাহাড়ে পৃথক স্থানে দুটি মানুষের কঙ্কাল দেখতে পাওয়ার খবর পাঠায়। প্রথমে পানেরছড়া পাহাড়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একটি কঙ্কাল পড়ে আছে। কঙ্কালের পরনে প্যান্ট রয়েছে। দ্বিতীয় কঙ্কালটির কাছে পৌঁছাতে গেলে আরও দুই কিলোমিটার বনে ঢুকতে হবে। কিন্তু নিরাপত্তাজনিত কারণে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

এসব বিষয়ে স্থানীয়দের দাবি, উনচিপ্রাং ২২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের বনে তল্লাশি করলে এমন অনেক কঙ্কাল উদ্ধার করা যাবে, যাদের অপহরণ করে মেরে ফেলেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। শুধু স্থানীয় নয়, আধিপত্যের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে নিজেদের সম্প্রদায়ের লোকজনকেও অপহরণ ও খুন করে এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।

আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮-এর (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরান হোসেন এ বিষয়ে বলেন, এপিবিএনের তৎপরতা, স্থানীয় রোহিঙ্গা ও স্বেচ্ছাসেবীদের সমন্বয়ে পাহারা জোরদার করার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিবেশ এখন নিরাপদ। যারা অপরাধে জড়িত ছিল, তারা এরই মধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছে।

এনএ