পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাচ্চু মিয়া ও তার মা মরিয়ম বেগম

সমাজের অন্য দশটা মানুষের মতো সুস্থ স্বাভাবিক দিন কাটাচ্ছিলেন বাচ্চু মিয়া (৩৫)। ফুটপাতে বসে জুতা বিক্রি করতেন। সেই টাকা দিয়ে চলত পাঁচ সদস্যের সংসার। নিজস্ব জায়গা-জমি এবং ঘর না থাকলেও অল্প টাকার একটি ভাড়া বাড়িতে থেকে ভালোই চলছিল। বাচ্চু মিয়ার স্বপ্ন ছিল, একখণ্ড জমি কিনে সেখানে ছোট্ট একটা ঘর বানিয়ে বসবাস করবেন। সন্তানদের লেখাপড়া করাবেন। মায়ের সেবাযত্ন করবেন।

কিন্তু বাচ্চু মিয়ার সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল। বাস্তবায়ন করার আগেই তার ‘অর্ধদেহ নিস্তেজ’ (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) হয়ে ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে তিনি গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। এ অবস্থা দেখে দুই শিশু সন্তান নিয়ে তার স্ত্রীও তাকে ফেলে বাবার বাড়িতে পাড়ি জমিয়েছেন।

পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই যুবক প্রায় ৫ বছর ধরে গৃহবন্দি হয়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছেন। তার আপন বলতে এখন একমাত্র বৃদ্ধ মা ছাড়া আর কেউ নেই। মা বর্তমানে স্থানীয় এক রাজমিস্ত্রির সঙ্গে  সহযোগীর কাজ করে অসহায় ছেলের ভরণপোষণসহ চিকিৎসা করছেন।

সম্প্রতি দুর্বিষহ জীবনের কষ্টের এ সকল কথা শোনান নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলা সদরের পশ্চিম বাজারের ড্রেন পাড় এলাকার পক্ষাঘাতগ্রস্ত যুবক বাচ্চু মিয়া। এ সময় তিনি সরকারসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তিদের কাছে তিন চাকাওয়ালা একটি হুইলচেয়ারসহ আর্থিক সহায়তার দাবি করেন।

একটি হুইলচেয়ার পেলে তাকে আর গৃহবন্দি জীবন কাটাতে হবে না। তিনি চেয়ারে বসে চলাচল করতে পারবেন এবং বাড়ির আশপাশে জীবিকা নির্বাহের পথ খুঁজে নিতে পারবেন বলে প্রত্যাশা অসহায় বাচ্চুর।

জানা গেছে, এক সময় বাচ্চু মিয়া ঢাকা থেকে কাজ করতেন। সে সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার মনোয়ারা আক্তার রত্নার সঙ্গে। তারপর রত্নাকে বিয়ে করে তিনি এলাকার বাজারে ফুটপাতে জুতার ব্যবসা শুরু করেন। এরই মধ্যে তারা দুই ছেলে সন্তানের বাবা-মা হয়েছেন।

কিন্তু বাচ্চুর জীবনে হঠাৎ অন্ধকার নেমে আসে। তার কোমড় থেকে পা পর্যন্ত শক্তিহীন হতে শুরু করে। প্রথমে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারলেও ধীরে ধীরে দুই পা অকেজো হতে থাকে। অনেক ডাক্তার-কবিরাজ দেখানোর পরও কোনো উপকার হয়নি। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েন বাচ্চু এবং তার কোমড় থেকে পা পর্যন্ত নিস্তেজ হওয়ায় গৃহবন্দি হয়ে পড়েন তিনি।

সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অচল হয়ে যাওয়ায় পরিবারের লোকজন চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেন। একবেলা ভাত জুটলে আরেকবেলা জুটে না। কিছুদিন ধৈর্য ধরার পর দুই-তিন বছর আগে হঠাৎ একদিন দুই শিশু সন্তান নিয়ে সংসার ছেড়ে বাবার বাড়িতে চলে যান বাচ্চু মিয়ার স্ত্রী।

এদিকে, অসহায় ছেলেকে নিয়ে চরম বিপাকে পড়েন বৃদ্ধ মা মরিয়ম। জীবন বাঁচানোর তাগিদে এক পর্যায়ে বাচ্চুর মা কর্ম খুঁজতে শুরু করেন। অবশেষে স্থানীয় এক রাজমিস্ত্রির সঙ্গে থেকে তাকে সহযোগিতার কাজ নেন। এতে তিনি দৈনিক ৩শ টাকা করে মজুরি পান। প্রতিদিন সে কাজও আবার জুটে না। বর্তমানে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকম চলছে বৃদ্ধ মা ও বাচ্চু মিয়ার জীবন।

বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আগে ভালাই আছিলাম। কোনো রোগ আছিল না। বিয়াও করছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আমি অচল অইয়া পড়লাম। আমার এই অবস্থা দেইখে ছুডু ছুডু দুইডা ছেড়া লইয়া বউডা বাপের বাড়িত গেছেগা। অহন আমার বাইচ্চা থাহনের থাইক্কে মইরে যাওনগাই ভালা। এমন জীবনের কি দাম আছে।

তিনি আরও বলেন, খুব কষ্টে বাইচ্চে আছি। হাটাচলা করতাম পারি না। মা আমারে খাওয়াইতাছে। টেহার অভাবে চিকিৎসাও করাইতাম পারতাছি না। আমার আর ভালা অওনের কোনো সুযোগ দেখতাছি না। তাই সরহার এবং চেয়ারম্যান-মেম্বাররা যুদি আমারে তিন চাক্কাওয়ালা একটা হুইলচেয়ার দিত তাইলে আমার বিশাল উপগার অইতো। জীবনডা বাঁচত।

বাচ্চু মিয়ার মা মরিয়ম বেগম আক্ষেপ করে বলেন, আমার কপালই ভালা না। তা না অইলে যে ছেড়া (ছেলে) আমারে রোজগার কইরা খাওন দিত, হেই ছেড়ারে অহন আমার খাওয়ানি লাগতাছে।  টেহা পয়সা কামাইতা পারে না বইল্লে নাতিডিরে লইয়া বউডাও গেছেগা।

তিনি আরও বলেন, আমরার কোনো জাগা-জমি নাই। বাচ্চুর বাপ মারা গেছে মেলা আগেই। হেইন মরণের পরে থাইকাই মাইনষের বাড়িত থাকতাম। মাইনষের বাড়িত আর কয়দিন থাহুন যায়। তাই কয়েক বছর ধইরে কলমাকান্দা বাজারো ছয়শ টেহা মাসে আম্বর আলীর ঘরডা ভাড়া দিয়া থাকতাছি। একজন রাজমেস্তরির সঙ্গে আমি কাম করি। ডেলি ৩শ টেহা দেয়। প্রত্যেকদিন কামও থাহে না। ছেড়াডারে লইয়া মেলা কষ্ট করতাছি।

তিনি বলেন, কেউ যদি দয়া কইরে আমার ছেড়াডারে একটা হুইলচেয়ার দিত, তাইলে হে ভিক্ষা কইরা অইলেও খাইত পারত। সরকার এবং সমাজের বিত্তশালীদের প্রতি এমন দাবি জানান বাচ্চুর মা মরিয়ম।

মরিয়ম বেগম বলেন, হুনছি সরহার গরিবরে জাগা ও ঘর দিছে। আমারে যুদি একটু জাগা আর একটা ঘর দিত তাইলে একটু শান্তি অইত।

স্থানীয় বাসিন্দা কাজল তালুকদার জানান, বাচ্চু মিয়া প্যারালাইজড হয়ে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। তার বৃদ্ধ মা কাজ করে অসহায় ছেলেকে দেখভাল করছেন। টাকার অভাবে সঠিক চিকিৎসাও করাতে পারছেন না। অসহায় ছেলে ও মাকে সহযোগিতা করার জন্য সরকার এবং এলাকার বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান শেখ গোলাম মৌলার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি অসহায় বাচ্চু মিয়া সম্পর্কে কিছু জানি না। তার বিষয়ে খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় সহায়তা করা হবে।

কলমাকান্দা উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম বলেন, আমাদের কাছে বর্তমানে কোনো হুইলচেয়ারের বরাদ্দ নেই। তবে অসহায় বাচ্চু মিয়ার খোঁজ-খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।

জিয়াউর রহমান/এসপি