রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার বড়বড়িয়া বেলতলার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জিনারুল বিশ্বাস (৪০)। রাজশাহীর আন্তজেলার রোজা নামের গাড়িতে সহকারীর কাজ করতেন তিনি। ২০০১ সালে যুবক বয়সেই বসেছিলেন বিয়ের পিঁড়িতে। বেঁধেছিলেন সংসার। তবে বেশি দিন টেকেনি সেই সংসার।

২০০২ সালে একটি দুর্ঘটনায় আহত হন জিনারুল। এতে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় তাকে। তারপর কোমর থেকে পায়ের নিচ পর্যন্ত ক্ষত থেকে শরীরে শুরু হয় পচন। এতে পুরোপুরি শয্যাশায়ী হতে হয় তাকে। এরপর থেকে তার জীবনে নেমে আসে অন্ধকার ও একাকিত্ব। হয়ে পড়েন কর্মহীন। এ কারণে ২০০৩ সালে তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যান। তাতে কী? অচল ও রোগাক্রান্ত সন্তানকে তো আর ফেলতে পারেননি জিনারুলের মা জহুরা বেওয়া (৭২)। সেই থেকে আজ অবধি সন্তানকে আগলে রেখেছেন তিনি।

এই কুড়ি বছরের ভেতরে আর কখনো যোগাযোগ করেননি জিনারুলের স্ত্রী। জিনারুলের সংসারে একটি কন্যাসন্তান ছিল। তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান তার স্ত্রী। লোকমুখে জিনারুলের মা শুনেছেন, সম্প্রতি তার নাতনির বিয়ে হয়ে গেছে। তবে কেউই তাদের জানাননি কিছু।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় আট বছর বয়সে জিনারুল তার বাবাকে হারিয়েছেন। এরপর যুবক বয়সে দুর্ঘটনার দুই পা হারান। বাঁচার সম্ভবনা একেবারেই ছিল না তার। তবু মায়ের সেবাযত্নে কিছুটা সেরে ওঠেন। জিনারুলের স্ত্রী চলে যাওয়ার পর তার ছোট ভাইয়েরাও তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। কারণ, চলাচলে ব্যর্থ জিনারুলকে প্রস্রাব-পায়খানা থেকে খাওয়াদাওয়া— সবই করতে হয় বিছানায়। এসবই দেখাশোনা করেন তার মা।

জিনারুলকে বাড়ি থেকে একেবারে এলাকার বাইরে ক্ষেতের পাশে রাখা হয়। খোলা স্থানে দীর্ঘদিন পড়ে থাকেন তিনি। কিন্তু ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে কষ্ট হওয়া দেখে ওই গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য জজ মিয়া ও তার ভাই আব্দুল হাকিম বাঁশ ও একটি টিনের চালা তুলে দেন। এ ছাড়া মানুষের দান করা কম্বল ও পুরোনো কাপড় দিয়ে কোনোরকম দিন কাটান জিনারুল।

স্ত্রী ও নিজ ভাইদের অবজ্ঞার পাত্র হলেও তার মা তাকে দেখাশোনা করেন। রাতে অন্ধকারে মোমবাতি জালিয়ে ছেলের মুখে খাবার তুলে দেন। মানুষের বাসায় কাজ করে কিংবা এর-ওর কাছে চেয়ে চিন্তে নিজের ও পঙ্গু ছেলের খাবার জোগাড় করেন বৃদ্ধা জহুরা।

জহুরা বেওয়া ঢাকা পোস্টকে জানান, মাঝবয়সে তিনিও স্বামী হারিয়েছেন। হারিয়েছেন বড় ছেলে জহুরুলকে। এরপর কামরুল, জিয়ারুল, মিনারুল, জিনারুল ও ছোট ছেলে আমিরুলকে মানুষ করেছেন অতিকষ্টে। এখন সব ছেলেই আলাদা সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বর্তমানে বড় ছেলে জহুরুলের রেখে যাওয়া একখণ্ড জমিতে ছোট ছেলের সঙ্গে থাকেন তিনি। তবে সেখানে তার ঘরটিও ভেঙে পড়ার উপক্রম।

তিনি আরও বলেন, তার ছোট ছেলে আমিরুলও বাসের সহকারীর কাজ করেন। তিনিই ভাই জিনারুলকে একটু-আধটু দেখতেন। তবে করোনায় তার কাজ না থাকায় তিনি আর দেখাশোনা করতে পারেন না। এখন গ্রামবাসীদের কাজ করে আর চেয়েচিন্তেই চলে জীবন।

নবী আলম নামের এক স্থানীয় যুবক বলেন, ছোটবেলা থেকেই জিনারুল চাচাকে দেখছি এভাবেই পড়ে আছেন রাস্তার পাশে। তার বৃদ্ধ মা-ই তার সব দেখাশোনা করেন। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় তার কষ্ট দেখে খুব খারাপ লাগে। একাকী জীবনযাপনের কারণে মানসিকভাবেও অসুস্থ তিনি। এখন কোনো কিছুর সঠিক উত্তর দিতে পারেন না, ভুলভাল বলেন।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, চারঘাটের সুযোগ্য সন্তান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও স্থানীয় জনপ্রশাসনের কাছে বিনীত অনুরোধ এ অসহায় মা-ছেলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাদের কষ্ট লাঘব করুন। আপনাদের সামান্য সহযোগিতায় তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে পারেন। তাদের জীবনের দুঃখের সমাপ্তি ঘটলে আমরা গ্রামবাসী অত্যন্ত আনন্দিত হব।

বড়বড়িয়া বেলতলা ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নং ওয়ার্ডের নবনির্বাচিত সদস্য জামাল উদ্দিন বলেন, তার অসুখ-বিসুখের কারণে বাড়ির লোকজন তাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি। রাস্তার পাশে রেখেছে। বর্তমানে তীব্র  শীতে কষ্টে আছে জিনারুল। মাস ছয়েক আগেই ঝড়ে উল্টে গিয়েছিল জিনারুলের টিনের চালা। পরে স্থানীয়দের সহায়তায় তা ঠিক করে দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, জিনারুলের বাবা সহায়-সম্পত্তি রেখে যাননি। এদিকে জিনারুলের নানার সম্পত্তি থাকলেও জহুরা বেওয়ার সৎভাই সব নিজ নামে লিখে নেয়। জহুরা বেওয়ার বড় ছেলের পাঁচ কাঠা জমি রেখে মারা যায়। এখন ওইটুকু ভিটার ওপরই জহুরা ও তার ছোট ছেলের বসবাস।

জহুরা বেগম তিন মাস, পাঁচ মাস পর বয়স্ক ভাতার কিছু টাকা পান। আর জহুরুল প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তা দিয়েই চলে তাদের টুকটাক। দুর্ঘটনার সময় শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে জিনারুল এককালীন ৬৪ হাজার ৫০০ টাকা পেয়েছিলেন। সেগুলো চিকিৎসাতেই শেষ। পরে উপজেলা প্রশাসন থেকে একটি হুইলচেয়ার দেওয়া হয়। সেটিও অভাবে বিক্রি করে দেয়। আমি দায়িত্ব পেলেই জিনারুলের জন্য চেয়ারম্যান ও ইউএনওর কাছে তার বিষয়ে বলব।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মুঠোফোনে নবনির্বাচিত সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক ও চারঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা সামিরার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তারা ফোন রিসিভ করেননি। (বার্তা প্রেরক মো. নবী আলম, চারঘাট, রাজশাহী)

এনএ