তারাগঞ্জের কালারঘাটে সাঁকো দিয়ে পারাপার হয় ১২ গ্রামের হাজারো মানুষ

‘হামার কপাল খারাপ বাহে। বারবার নেতারা ধোঁকা দেয়। ভোটের সময় চেয়ারম্যান-মেম্বার সগায় (সকলে) হামার লোক হয়্যা (হন) যায়। আর ভোট ব্যারাইলে (পরবর্তীতে) কারো পাত্তা নাই (দেখা যায় না)। হামরা একান ব্রিজের জনতে কতজনোক (অনেককে বলা) কইছি। কায়ো কথা দিয়্যা কথা রাখে নাই। হইবে হইবে করি আইজো (এখন পর্যন্ত) হামার কালারঘাটোত ব্রিজ হইল না।’

দীর্ঘ দিন দাবি জানিয়েও সেতু না হওয়াতে এভাবেই আক্ষেপ প্রকাশ করেন ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান। প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়ে বাঁশের সাঁকো পারাপার হন ষাটোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি।

আব্দুর রহমানসহ ১২ গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার হাজার হাজার মানুষের ভরসা কালারঘাটের বাঁশের সাঁকোটি। এই সাঁকোর ওপর ভর করেই প্রতিদিন বিভিন্ন কাজে নদীর এপার-ওপার যাতায়াত করেন স্থানীয়রা। শুষ্ক মৌসুমে সাঁকোটি ব্যবহার করা গেলেও, বর্ষাকালে তা ডুবে থাকে পানিতে। তখন নৌকা বা কলার ভেলা ছাড়া পারাপারের উপায় থাকে না।

রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে কালারঘাট গ্রাম। সেখানকার সয়ার ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে যমুনেশ্বরী নদী। এ নদীঘেঁষা কালারঘাটের যাতায়াত ব্যবস্থা খুবই নাজুক। নদী পারাপারে নেই কোনো সেতু। এই ঘাটের দুইপাড়ে শাহপাড়া, কাংলাচড়া, উজিয়াল, চারআনী, দোলাপাড়া, বুড়িরহাট, চিলাপাক, চাকলাসহ ১২টি গ্রাম রয়েছে।

বর্ষা-খরা মৌসুমে কষ্ট করেই নদী পারাপার হয়ে আসছে ওইসব গ্রামের অন্তত ১৬ হাজার মানুষ। একটা সেতুর জন্য দীর্ঘ দিন ধরে কেঁদেছেন সেখানকার বাসিন্দরা। কিন্তু কোথাও থেকে সাড়া মেলেনি। বাধ্য হয়ে চাঁদা তুলে নদীর পেটে বাঁশের সাঁকো দাঁড় করিয়েছেন স্থানীয়রা।  নড়বড়ে সেই সাঁকোই এখন পারাপারের শেষ ভরসা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিটি নির্বাচনে নদীর ওপর সেতু নির্মাণের শুধু আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবে কেউ কোনো পদক্ষেপ নেননি। এতে আশপাশের গ্রামের মানুষের দুর্ভোগের সমাপ্তিও ঘটেনি। দীর্ঘদিনেও বহুল কাঙ্ক্ষিত সেতু না হওয়াতে ভোগান্তি বাড়ার সঙ্গে এলাকার ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি-অর্থনীতি, শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবায় এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

সাঁকো দিয়ে পারাপারের সময় চিলাপাক গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘ছবি তুলি কী হইবে, হামার এ্যটে (এই জায়গায়) তো কায়ো (কেউ) সেতুর ব্যবস্থা করি দিলে না। ইয়ার আগোতো (এর আগে) কতজনে ছবি তুলছে, সংবাদ হইছে। কিন্তু আইজ পর্যন্ত সেতু হয় নাই। খালি ভোটের সময় সবায় ফটর ফটর করে (প্রতিশ্রুতি দেয়), কামের বেলা কায়ো নাই। সরকারোক কন হামার এত্তি (এখানে) সেতু বানে দেউক।’

পার্শ্ববর্তী দোলাপাড়া গ্রামের আমিনুর মিয়ারও আক্ষেপের শেষ নেই। কারণ এই নদীর ওপর সাঁকো তৈরি করতে তাকেও চাঁদা গুনতে হয়েছে। তার মতো অনেকেই সাঁকো বানানোর জন্য চাঁদা দিয়েছেন জানিয়ে আমিনুর বলেন, ‌‌‘হামাকগুল্যার নিয়্যা সবায় (সবাই) খালি রাজনীতি করে। সেতু হইলে কারো কারো সেই রাজনীতি শ্যাষ হইবে। সেই তকনে (এ কারণে) সেতু নিয়্যা কায়ো কথা কবার (বলতে) চায় না। কিন্তুক ভোট নাগলে সবায় কয় এবার ব্রিজ হইবে, কোনটে সেই ব্রিজ! হামার কষ্টের শ্যাষ নাই।’

বর্ষা মৌসুমে সাঁকো পারাপার হওয়ার ভয়ে স্থানীয় শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ স্কুলে যেতে চান না এমনটাই জানালেন চিলাপাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মমিনুল ইসলাম। এই শিশুশিক্ষার্থীর দাবি, ‌‌‘নদীতে পানি বেড়ে গেলে সাঁকো পার হতে ছোট শিশুরা বেশি ভয় থাকে। আর সাঁকো যখন পানিতে ডুবে যায়, তখন বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায় না।’

শাহপাড়া এলাকার কলেজপড়ুয়া সামিউল হাসান বলেন, সাঁকো দিয়েই আমাদের এলাকার ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাই। হাজারো মানুষ প্রতিদিন এই বাঁশের সাঁকো দিয়ে যাতায়াত করে। শুকনো মৌসুমে নদীর হাঁটুপানি পার হয়ে যাতায়াত সম্ভব। কিন্তু বর্ষাকালে তো চারদিকে পানি থাকে, তখন দুর্ভোগও বাড়ে। আমরা চাই এখানে একটা স্থায়ী সেতু নির্মিত করা হোক।’

সয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আল-ইবাদত হোসেন পাইলট বলেন, ‘যমুনেশ্বরী নদীর কালারঘাটে সেতু নির্মাণের বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে উঠে এসেছে। কিন্তু বরাদ্দ না থাকায় এখন পর্যন্ত সেখানে দৃশ্যমান কিছু করা সম্ভব হয়নি। হাজারো মানুষ দাবি করেও একটি সেতু পাচ্ছে না। আমি এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং প্রকল্প কর্মকর্তাকে সেখানে সেতু নির্মাণের জন্য জানিয়েছি।’

তারাগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী (এলজিইডি) আহম্মেদ হায়দার জামান জানান, ‌‘কালারঘাটসহ কয়েকটি ঘাটের জন্য বরাদ্দ চেয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এখনও বরাদ্দ মেলেনি। বরাদ্দে মিললে দ্রুত সময়ের মধ্যে সেখানে সেতু নির্মাণ করা হবে।’

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমএসআর