বনের গাছ কেটে সেখান দিয়ে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের ফলে পরিবেশে ব্যাপক বিপর্যয় হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় ও পরিবেশবাদীরা। সম্প্রতি ধুনুয়া-এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতু-নলকা গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণে বনের গাছ কাটার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে বনের ১১ হাজার ২৪৬টি গাছ কাটা পড়বে বলে জানা গেছে।

এর আগে ২০১৪ সালে ধুনুয়া-এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতু-নলকা গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)। ফলে টাঙ্গাইলের সখীপুর উপজেলার কালমেঘা, কালীদাস, গজারিয়া, প্রতিমা বংকী, ছিলিমপুরসহ কয়েকটি এলাকায় সামাজিক বনায়ন ও সংরক্ষিত বনের গাছ কাটা পড়বে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) টাঙ্গাইল অঞ্চলের গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, বনকে ধ্বংস করে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন হলে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশের বৃহৎ স্বার্থে বনের যে পরিমাণ গাছ কাটা হবে, তাতে পরিবেশের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না।

সরেজমিন ধুনুয়া-এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতু-নলকা গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্পের টাঙ্গাইল অংশের সখীপুর উপজেলার কালমেঘা এলাকায় গিয়ে এর কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। তবে গ্যাস পাইপলাইনের কাজ ধুনুয়া থেকে কালমেঘা এলাকায় গিয়ে শেষ হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিমা বংকী এলাকায় গ্যাস লাইনের পাইপ স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) সূত্রে জানা গেছে, তিতাস গ্যাস অধিভুক্ত ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগ, পশ্চিমাঞ্চল রাজশাহী ও রংপুর বিভাগ এবং বিভাগে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ধুনুয়া-এলেঙ্গা ও বঙ্গবন্ধু সেতু-নলকা গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইন নির্মাণ প্রকল্প’ হাতে নেয় সরকার। জাতীয় গ্যাস গ্রিডের সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ৯৭৯ কোটি ১৭ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়/জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)।

২০১৯ সালে এই গ্যাস ট্রান্সমিশন পাইপলাইনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এটির কাজ শেষ করতে পারেনি জিটিসিএল। এতে সময়সীমা বাড়িয়ে এটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে ২০২১ সালে।

গ্যাসলাইনের জন্য রাখা পাইপ

জানা গেছে, টাঙ্গাইল অংশের সখীপুরে বনের গাছ কাটার অনুমতি না পাওয়ায় গ্যাস পাইপলাইনের কাজ বন্ধ হয়েছে। পরে গ্যাস কোম্পানি জিটিসিএল টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে গত ২০১৬ সালে চিঠির মাধ্যমে টাঙ্গাইল বনভূমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। এরপর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে কর্তৃক সংশোধিত কার্যনির্বাহী সংক্ষিপ্তসার তৈরি করে ২০২০ সালের জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠায়।

সখীপুর বনের কালমেঘা গ্রামের জি এম তোফাজ্জল বলেন, মহামারি রোধে গাছপালার কোনো বিকল্প নেই। সেই গাছ কেটে গ্যাস লাইনের কাজ হবে শুনছি। যদি বনের গাছ কাটা হয়, তাহলে পরিবেশের ভারসাম্য থাকবে না। এতে এভাবে বন উজাড় হলে পরবর্তী সময়ে এলাকায় বৃষ্টিপাত নাও হতে পারে। বনের গাছ না কেটে বিকল্পভাবে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করা হোক।

উপজেলার কালিদাস গ্রামের চান মিয়া বলেন, শুনতেছি বনের গাছ কেটে গ্যাসের পাইপ বসাবে। এতে সামাজিক বনায়নসহ সংরক্ষিত বনের বহু গাছ কাটা পড়বে। এতে স্থানীয় ব্যক্তিদের ক্ষতি হবে। কারণ, গাছ থাকলে সরকারেরও লাভ, এলাকার মানুষেরও লাভ।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, বনের গাছ প্রচুর বিষাক্ত অক্সিজেন গ্রহণ করে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করে। সেই গাছ যদি কেটে ফেলা হয়, তাহলে এলাকার মানুষের ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশেও এর প্রভাব পড়বে।

সখীপুরের ফতেয়া রেঞ্জের কালমেঘা বিট কার্যালয়ের কর্মকর্তা আব্দুল মোতালেব বলেন, টাঙ্গাইল অংশে গ্যাস পাইপলাইনের জন্য এখনো বনের গাছ কাটার কার্যক্রম শুরু হয়নি। পাইপলাইনের জন্য এই বিটের আওতাধীন কতটুকু জায়গা বা বনের গাছ কাটা হবে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।

টাঙ্গাইল অংশে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের জন্য আট একর এবং লাইনের পার্শ্ববর্তী ৫০ একর জায়গা পড়বে। যেখানে দেশের বড় কল্যাণের কাজটা (পাইপলাইন) করা হচ্ছে, সেখানে কাজ হওয়ার পর বন বিভাগ থেকে পুনর্বনায়ন করা হবে।

ডা. মোহাম্মদ জহুরুল হক, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) টাঙ্গাইল অঞ্চলের গবেষণা কর্মকর্তা সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, বনের গাছ কাটতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) বা পরিবেশগত পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকার সেটা করে না কখনো। গাছ কাটলে বনের কতটুকু ক্ষতি হবে, কতটুকু ভালো হবে, সেটা লেখা থাকে ওই ইআইএ প্রতিবেদনে। বনের গাছ কাটা একটা প্রাণঘাতী সিদ্ধান্ত। এটা কীভাবে অনুমোদন দেয়! পরিবেশ নিয়ে চারদিকে সবাই তোলপাড়, সেখানে পরিবেশ রক্ষাকারী বনকে বনের গাছ কাটার জন্য অনুমোদন দিয়েছে।

সোমনাথ লাহিড়ী বলেন, পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য বনের ওপর কোনো ধরনের খবরদারি করার কোনো দরকার নেই। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশ দুটোরই মারাত্মক ক্ষতি সাধন হবে। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের ক্ষতির পাশাপাশি সব ইকো সিস্টেম পরিবর্তন হচ্ছে বাংলাদেশে। ফলে করোনার মতো ভাইরাস প্রবেশ করছে। সারা পৃথিবীতে যে কার্বন নিঃসরণ হচ্ছে, সেই কার্বন নিঃসরণ এই বনের গাছগুলো চুষে নিচ্ছে।

তিনি বলেন, গাছ কাটা হলে নির্গম পরিমাণটা বেড়ে যাবে। ফলে আমাদের ইকো সিস্টেমের ওজোন স্তরের ওপর আঘাত হানবে। এতে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটবে। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশব্যবস্থাকে সংরক্ষণ করার জন্য বনের গাছ কাটা সিদ্ধান্তটা প্রাণঘাতী ছাড়া আর কিছু নয়। তিনি আরও বলেন, বনের গাছ কাটা বন্ধে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। যদি আলোচনা ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে আদালতে মামলা করা হবে।

এ ব্যাপারে টাঙ্গাইলের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ জহুরুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাঙ্গাইল অংশে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপনের জন্য আট একর এবং লাইনের পার্শ্ববর্তী ৫০ একর জায়গা পড়বে। যেখানে পাইপলাইন দেশের বড় কল্যাণের কাজটা করা হচ্ছে, সেখানে কাজ হওয়ার পর বন বিভাগ থেকে পুনর্বনায়ন করা হবে। এতে যে গাছগুলো কাটা পড়বে, সেখানে পুনর্বনায়ন হওয়ার পর গাছগুলো আগের মতোই হবে। এতে পরিবেশের ওপর কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে না।

এনএ